নেটফ্লিক্সে সেন্সরশিপ! বন্ধ আনকাট ভারতীয় সিনেমার সম্প্রচার
বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স সারা বিশ্বে ভারতীয় সিনেমাগুলোর সেন্সরবিহীন স্ট্রিমিংয়ের চর্চা থেকে সরে আসছে। চলতি বছর এতে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর একটি সার্বিক পর্যালোচনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এটি ভারতীয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ও দর্শকদের জন্য বেশ শঙ্কার। কেননা নেটফ্লিক্সই সম্ভবত একমাত্র স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম যারা ভারতীয় সিনেমার আনকাট সংস্করণ আগেভাগে সম্প্রচার করতো। এরপরে দেশটির সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন (সিবিএফসি) ক্রমবর্ধমানভাবে রাজনৈতিক রেফারেন্সের সিনেমাগুলোকে কাঁটাছেড়া করছে, বিশেষ করে যা ক্ষমতাসীণদের জন্য বিব্রতকর।
করোনাকালীন সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় 'ভেদ' সিনেমায় সেন্সর আরোপ করা হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ভয়েস-ওভারের পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক রেফারেন্সের বিষয়গুলোও ছিল। এমতাবস্থায় সেন্সর বোর্ড ঐ ক্লিপগুলো সরিয়ে ফেলার পর প্ল্যাটফর্মটি তা বিশ্বব্যাপী মুক্তি দিয়েছে।
সেক্ষেত্রে সিনেমাটির মূল নির্মাণের সকল অংশ দেখার থেকে বঞ্চিত হয়েছে দর্শকেরা। শুধু 'ভেদ' সিনেমাই নয়, নেটফ্লিক্সে বরং সমস্ত ভারতীয় সিনেমাতেই সেন্সরশিপের ব্যাপারটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যদিও সেন্সরশিপ ফর্মের কিছু বিষয় নেটফ্লিক্সের অভ্যন্তরীণ নীতির বিরুদ্ধে যায়।
তামিল অভিনেতা বিজয় অভিনীত সিনেমা 'লিও' নেটফ্লিক্সে বৈশ্বিকভাবে সেন্সরকৃত ফরম্যাটেই মুক্তি পেয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটির আনকাট ভার্সনটিই মুক্তি পেয়েছিল।
'ওএমজি ২' সিনেমাটিতে যৌন শিক্ষার পক্ষে সামাজিক আন্দোলনের একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেখানে অক্ষয় কুমারকে হিন্দু দেবতা শিবের ভূমিকায় দেখা যায়।
কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, সিনেমাটিকে শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের দেখার উপযোগী ক্যাটাগরিতে (এ গ্রেড) ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এটি নিয়ে সিনেমাটির নির্মাতা এক সাক্ষাৎকারে নিজের হতাশা প্রকাশ করেছেন।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অন্যান্য স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর মাঝেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে এর ফলে শুধু ভারতের প্রেক্ষাগৃহে নয়, বরং অনলাইনে ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও সিনেমাগুলোকে দেশটির সেন্সর বোর্ডের দৃষ্টিভঙ্গির আদলে দেখতে হচ্ছে।
শুধু রাজনৈতিক রেফারেন্সই নয় বরং সিনেমায় থাকা বিশিষ্ট ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বদের উপস্থাপন নিয়েও সেন্সরশিপ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, 'জাপান' সিনেমায় 'আম্বানি [এবং] আদানি' এর নাম উল্লেখ করে একটি দৃশ্য ছিল। নেটফ্লিক্স ঐ ব্যবসায়ীদের নাম ছাড়াই সিবিএফসির সেন্সরকৃত সংস্করণটিই নিজেদের প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করেছে।
অন্যদিকে নেটফ্লিক্স ও অন্যান্য স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোও নিজেদের অরিজিনাল সিরিজগুলিতে সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা সতর্কতার সাথে যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করছে বলে জানা গেছে। এমন পদক্ষেপ গ্রহণের পেছনে সম্ভবত অনলাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পরা এবং রাজনৈতিকভাবে স্পষ্ট অবস্থানের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের মতো বিষয়গুলো ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে।
এছাড়াও দেশটির স্ক্রিনরাইটার এ্যাসোসিয়েশন সমিতি এক বিবৃতিতে জানায়, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, ইন্ডাস্ট্রির লোকজন ও লেখকেরা একটি চুক্তির আওতায় আসতে বাধ্য হচ্ছে। ঐ চুক্তি অনুযায়ী, সিনেমার স্ক্রিপ্টের ফলে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে প্রযোজকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
এই বিষয়ে অ্যামাজন প্রাইমের অরিজিনালস টিমের হেড অপর্ণা পুরোহিতকে ২০২১ সালে রাজনৈতিক সিরিজ 'তান্ডব' এর জন্য পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সেক্ষেত্রে তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়েছিল। একইসাথে সুপ্রিম কোর্টও ঐ আদেশ বহাল রাখে।
তবে লাইসেন্সকৃত কন্টেন্টগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্য এমনটা বেশ কম দেখা গিয়েছে। কেননা এগুলোকে সরকারের অধীনে থাকা সেন্সর বোর্ড পূর্বেই যাচাই-বাছাই করেছে।
মূলত ভারতের ২০২১ সালের প্রণয়নকৃত 'দ্য সিনেমেটোগ্রাফ এক্ট এন্ড আইটি রুলস' অনুযায়ী সিনেমা ও স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো পরিচালিত হচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রে সিবিএফসি কর্তৃক সেন্সর করা সিনেমাই যে অনালাইনে মুক্ত করতে হবে তেমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তবুও বেশিরভাগ ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো ঝুঁকি না নিয়ে বরং সেন্সরকৃত সিনেমাটিই প্রকাশ করছে। যদিও কিছুদিন আগেও নেটফ্লিক্স এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম ছিল।
নেটফ্লিক্স যখন প্রথমে ভারতের বাজারে প্রবেশ করে তখন তারা আনকাট ভার্সনের সিনেমাগুলো খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই নিজেদের প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করেছে। সেক্ষেত্রে সিনেমা 'গান্ডু' ও ২০০৬ সালের ডকুমেন্টরি 'দ্য পিংক মিরর' এর কথা বলা যেতে পারে। এই দুটি কাজকেই সেন্সর বোর্ড কর্তৃক প্রেক্ষাগৃহ ও টেলিভিশনে সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।
এদিকে সেন্সরশিপ মেনে চলার বিষয়ে জানতে চাইলে নেটফ্লিক্সের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে দ্য হিন্দুর কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়, "আমাদের কাছে ভারতীয় মূল সিনেমা এবং টিভি শো-এর বিস্তৃত সংগ্রহ রয়েছে। যার সবকটিই সৃজনশীল অভিব্যক্তির প্রতি আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সমর্থনের বিষয়টি প্রকাশ করে। এই বৈচিত্র্য আমাদের দর্শকদের ভিন্ন পছন্দের পাশাপাশি অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতা থেকে আলাদাও করে।"