বিগ বসজয়ী মুনাওয়ার ফারুকি: স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানের জেলখানা থেকে রিয়েলিটি তারকা হওয়ার যাত্রা
'মানুষ সাধারণত ঠাট্টা করার আগে ক্ষমা চেয়ে নেয়। তবে আমি আগেভাগে ক্ষমা নিয়ে নিলেই সবচেয়ে ভালো হবে।'
কথাটা ভারতের স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান মুনাওয়ার ফারুকির। জনপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি শো বিগ বসের একটি পর্বে এ কথা বলেছিলেন তিনি।
'বিগ বস ১৭'-এর পুরো মৌসুমজুড়েই অবশ্য তার রসবোধ দেখা গেছে। এই শোতে ২১ জন প্রতিযোগী একটি কাস্টম-বিল্ড বাড়িতে থাকেন। সেখানে চব্বিশ ঘণ্টা তাদের কর্মকাণ্ড ভিডিও করা হয়। তারপর দর্শকদের ভোটে প্রতি সপ্তাহে একজন করে প্রতিযোগী বাদ পড়েন।
২১ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে এবারের মৌসুমে বিজয়ীর মুকুট জিতেছেন মুনাওয়ার। ২০২১ সালে কৌতুকের মাধ্যমে হিন্দুদের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মুসলিম মুনাওয়ার। আদতে মুনাওয়ার ওই কৌতুক বলেননি। পাঁচ সপ্তাহ জেল খাটার পর আদালত থেকে জামিন পান তিনি।
এর তিন বছর পর জনপ্রিয় এই রিয়েলটি শো জিতলেন ৩২ বছর বয়সি মুনাওয়ার। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ৫০ লাখ রুপি।
ফারুকির থাকেন মুম্বাই নগরীর উপকণ্ঠে মুসলিম অধ্যুষিত ডংরি তল্লাটে। গত সোমবার সেই ডংরি মোটামুটি জনসমুদ্রে পরিণত হয়। দলে দলে মানুষ আসতে থাকে তাকে অভিনন্দন জানাতে। এরকম উষ্ণ অভ্যর্থনা সাধারণত চলচ্চিত্র তারকারাই পেয়ে থাকেন। গত এক সপ্তাহ ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব হয়ে গেছে বিগ বসে দেওয়া মুনাওয়ারের সংলাপে (ওয়ান-লাইনার)।
সবাই অবশ্য তার জয়ে খুশি হননি। একটি জনপ্রিয় হিন্দি টিভি চ্যানেলের একজন উপস্থাপক বলেছেন, 'হিন্দু দেবতা ও ধর্মকে অপমান করে ক্যারিয়ার শুরু করা' একজন কমেডিয়ানকে নিয়ে লাখ লাখ হিন্দুসহ গোটা দেশ যেভাবে উচ্ছ্বাসে মেতেছে, তা রীতিমতো 'উদ্বেগজনক, পীড়াদায়ক এবং হতাশাজনক'।
অনেকেই বলছেন, ফারুকি যেভাবে অপ্রথাগত পদ্ধতিতে ভারতের 'সবচেয়ে ঘৃণিত' তরুণ পারফর্মারদের তালিকা থেকে বেরিয়ে 'গণমানুষের নয়নমণিতে' পরিণত হয়েছেন, তার স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আসিম আলি বিবিসিকে বলেন, 'তিনি জেল খেটেছেন, মিডিয়ায় বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণের শিকার হয়েছেন—কিন্তু ফিরে এসে সর্বভারতীয় পর্যায়ে তারকা খ্যাতি অর্জন করেছেন।'
কিন্তু এই দুঃসাধ্য কাজ তিনি করলেন কীভাবে? উত্তর লুকিয়ে আছে ফারুকির জীবনেই।
মুনাওয়ার ফারুকির জন্ম গুজরাটের এক ছোট শহরে। তার শৈশব ছিল দুঃখে-কষ্টে জর্জরিত। মুনাওয়ার ছোট থাকতেই তার মা আত্মহত্যা করেন। তার বাবা ২০০২ সালের ধর্মীয় সহিংসতার শিকার। একবার কারফিউর সময় ১২ দিন গৃহবন্দি হয়ে ছিলেন বলে জানিয়েছিলেন এই কমেডিয়ান। কৈশোরে তিনি চলে আসেন 'স্বপ্নের শহর' মুম্বাইয়ে।
বিগ বসে মুনাওয়ার এসব অতীত-বাস্তবতাকে ভুলে থাকতে চাননি। উল্টো নিজের অতীত, বর্তমান, সাধারণ মানুষের ভাষাকে আপন করে নিয়েছেন।
মজার ছলে বাকি প্রতিযোগীদের তিনি বলেছিলেন, 'বিগ বস, এই জাঁকালো জীবন আর বাড়িটাকে বোধহয় না বলার ক্ষমতা আমার ছিল না।
'আমি এসেছি ডংরি থেকে। বিগ বসে ভোট না পেলে বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের ছোট্ট বাড়িতে ঘুমের মধ্যে বাড়তি এক ইঞ্চি নড়াচড়া করলেও বের করে দেওয়া হয়।'
স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান হিসেবে শুরুর দিনগুলোতেও তিনি অনায়াসে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আত্মিক যোগসূত্র স্থাপনের সক্ষমতা দেখিয়েছিলেন।
মঞ্চে মুনাওয়ার উপস্থিত হন খানিকটা বিষণ্ণ ও তীক্ষ্ণ তির্যক রসবোধসম্পন্ন কলেজ শিক্ষার্থী হিসেবে। দাঙ্গার মধ্যে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া নিয়ে উদাসীন চেহারায় কৌতুক বলতেন তিনি। ইয়ার্কি করতেন মুসলিমদের নিয়ে প্রচলিত ক্লিশে আর স্টেরিওটাইপ ধ্যানধারণা নিয়ে। পারফর্মার হিসেবে তিনি ধারাবাহিক ছিলেন না, তবে একবার ঠিকঠাক সুরটা ধরে ফেলতে পারলে দারুণ রোমাঞ্চকর পারফর্ম্যান্স উপহার দিতে পারেন। মুনাওয়ারের র্যাপ সংগীতেও এসব বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।
একবার তিনি বলেছিলেন, 'নিজের বেড়ে ওঠা নিয়ে আমি কতটা গর্বিত, তা বোঝাতে আমি অতীত নিয়ে কথা বলি। কাজটা স্রেফ লোকের সহানুভূতি কুড়ানোর জন্য করি না, বরং আমি কোথা থেকে কোথায় এসেছি মানুষকে তা জানানোর জন্য করি।'
এই খেয়ালি আচরণ ও রসবোধের জন্য অজস্র ভক্ত জুটে যায় মুনাওয়ারের। কিন্তু তা সত্ত্বেও কারাবরণ ঠেকাতে পারেননি তিনি।
২০২১ সালের কথা। ইন্দোরে ১৪ দিনের একটি ট্যুর চলছিল তার। ওই সময়ই স্থানীয় এক হিন্দু গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মানুভূতিকে 'অপমান' করার অভিযোগ আনে। মুনাওয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ গঠন করা হয় তার বিরুদ্ধে।
এই মামলা ব্যাপক আলোড়ন ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা সাংবাদিকদের জানান, মুনাওয়ারকে যখন শো থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, ওই সময় তিনি ধর্ম নিয়ে কোনো কৌতুকই করেননি। এছাড়া তার শোকে যখন বাধা দেওয়া হয়, তখন পর্যন্ত তিনি রুটিন পারফর্ম্যান্স শুরুই করেননি। পুলিশও পরে স্বীকার করে যে এই কমেডিয়ানের বিপক্ষে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে কৌতুক করার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
কিন্তু তারপরও ৩৫ দিন জেলে কাটাতে হয় মুনাওয়ারকে। ছাড়া পাওয়ার পর কমেডিতে ফেরার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু হিন্দু গোষ্ঠীদের প্রতিবাদের মুখে তার কয়েক ডজন শো বাতিল হয়ে যায়।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে মুনাওয়ার ঘোষণা দেন, তিনি কমেডি ছেড়ে দিচ্ছেন। ওই সময় এক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে তিনি লেখেন, 'ঘৃণা জিতে গেছে, হেরেছে শিল্পী।'
এর দুমাস পর ক্যারিয়ারের বাঁক বদলের সিদ্ধান্ত নেন মুনাওয়ার। 'লক আপ' নামে একটি টিভি শোতে অংশ নেন তিনি। একে তিনি নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ও তাকে নিয়ে মানুষের মনে আগে থেকে গেঁড়ে বসা বদ্ধমূল ধারণা বদলানোর সুযোগ হিসেবে দেখেন। একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমি কখনোই বিতর্কিত হতে চাইনি, লোকে আমাকে বানিয়েছে। কমেডি করেই খুশি ছিলাম।'
কিন্তু মুনাওয়ারের বেছে নেওয়া মাধ্যমটা বেখাপ্পা হয়ে গেল। '১৬ কন্ট্রোভার্সাল সেলেব্রিটিজ' নামের ওই শোর উপস্থাপক ছিলেন বলিউড তারকা কঙ্গনা রানাওত, যিনি আবার মাঝে মাঝেই মুসলিমবিরোধী মন্তব্য করে খবরের শিরোনাম হন।
ওই শোতে মুনাওয়ার নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন। মঞ্চে কাজ করার সময় তিনি ডার্ক হিউমারের সঙ্গে সামান্য রাজনৈতিক বক্তব্য দিতেন। টিভিতে তিনি আরও সতর্ক ও আত্মসচেতন হয়ে ওঠেন। ধর্ম ও পরিচয়-সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্ন থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু তাই বলে নাটকীয়তার কমতি হয়নি ওই শোতে। এক পর্বে মুনাওয়ার জানান, বহু বছর ধরে বিবাহিত—যদিও সেই বিয়েতে ভালোবাসা নেই—এবং তার একটি ছেলেও আছে। এরপরই এতদিন মুনাওয়ারের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা দর্শক যেন হুট করেই তার অকপট ব্যক্তিত্বকে ভালোবেসে ফেলল। এমনকি কঙ্গনাও তাকে প্রশংসায় ভাসাতে লাগলেন। ৭০ এপিসোড পর সেই শোর বিজয়ী হলেন মুনাওয়ার।
সেটা ছিল স্রেফ শুরু। ওই জয় মুনাওয়ারের ক্যারিয়ারকে নতুন জীবন দিল। র্যাপ সংগীত তৈরিতে ফিরে গেলেন তিনি। স্পটিফাই ও ইউটিউবে তার মিলিয়ন মিলিয়ন শ্রোতা রয়েছে। এছাড়া ইনস্টাগ্রামেও সক্রিয় হলেন মুনাওয়ার। সেইসঙ্গে ফিরে গেলেন কমেডিতেও।
পুরো বিগ বসজুড়েই মুনাওয়ারের নির্বিবাদী আচরণ, কবিতা—সবই উপভোগ করেছে দর্শকেরা।
বিগ বসের বিজয় তার গল্পের বৃত্তকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। মুনাওয়ার যেন বুঝিয়ে দিচ্ছেন, জেলখাটা কমেডিয়ান, গায়ক কিংবা রিয়েলিটি তারকা—এসব সাধারণ লেবেলের কোনোটাই তার ব্যক্তিত্বের নির্যাস পুরোপুরি তুলে ধরতে পারেনি।
আসিম আলি বলেন, দর্শক-শ্রোতারা মুনাওয়ারের মাঝে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছেন। মুনাওয়ার হয়ে উঠেছেন দর্শকদের আয়না—সেই আয়নায় নিজেদের সংগ্রাম আর আশার প্রতিচ্ছবি দেখেছেন তারা।
এই বিজয় ডংরির মানুষদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন আসিম আলি। এই এলাকা অপরাধের আখড়া হিসেবে কুখ্যাত। দাউদ ইব্রাহিমসহ অনেক ডন ও মাফিয়া ডনের উত্থান ঘটেছে এখান থেকে।
আসিম আলি বলেন, তরুণ মুসলিমরা কীভাবে চ্যালেঞ্জ জয় করে নিজেদের মতো করে নিজেদের পরিচয় তৈরি করে নিতে পারে, ডংরির মানুষের জন্য সেই উদাহরণ তৈরি করেছেন মুনাওয়ার।
- অনুবাদ: মারুফ হোসেন