মেরিলিন মনরোর বাড়ি কেনা ধনকুবের দম্পতি এবার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের বিরুদ্ধে মামলা করলেন!
৩৫ বছর বয়সে যখন মেরিলিন মনরো তার প্রথম ও একমাত্র বাড়িটি কিনেছিলেন, তার নিজেরই যেন এ কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না।
মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে লাইফ ম্যাগাজিনকে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়া সময়, তিনি ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিকদের তার নতুন বাড়িটি দেখতে দিয়েছিলেন।
জানা যায়, সেদিন পুরো বাড়ি ভরা সদ্য মেক্সিকো থেকে কেনা বিভিন্ন পণ্যের খালি বাক্স এবং হস্তশিল্প সামগ্রী ছিল।
এটা ছিল সত্যিই তার বাড়ি, কারণ এর একমাত্র মালিক ছিলেন তিনি। বাড়িটি লস অ্যাঞ্জেলেসের পশ্চিমে ব্রেন্টউডের একটি অভিজাত এলাকায় অবস্থিত। ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে এই বাড়িতেই তার মৃত্যু হয়। তার এই শখের বাড়িটিতে মাত্র কয়েক মাস বসবাস করেছিলেন তিনি।
মনরোর মৃত্যুর পর ৬০ বছরে একাধিক বার বাড়িটির মালিকানা বদল হয়েছে। এমনকি মূল বিষয়গুলো অক্ষত রেখে কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কারও করা হয়েছে।
সর্বশেষ এক কোটিপতি দম্পতি বাড়িটি কিনেছেন এবং তারা বাড়িটি ভেঙে ফেলতে চাইছেন।
নিজেদের এই সিদ্ধান্তে অটল এই ধনকুবের দম্পতিকে কেউ থামাতে পারবে বলে মনে হয় না, শহরটিও না। এমনকি এই জুটি এবার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে, যাতে তারা বাড়িটি ভেঙে জমিটি তাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারে।
গত ৬ মে মামলাটি দায়ের করা হলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত এর কথা গোপন ছিল।
এই দম্পতির নাম- ব্রাইনাহ মিলস্টাইন এবং প্রযোজক রয় ব্যাংক। তারা দুজন গত আগস্টে প্রায় ৮.৩৫ মিলিয়ন ডলারে মনরোর লস অ্যাঞ্জেলেসের বাড়িটি কিনেছিলেন।
আগে থেকেই এই বাড়ির ঠিক পাশের প্রাসাদেই বাস করেন তারা।
শুরু থেকেই তাদের উদ্দেশ্য ছিল মনরোর বাড়িটি ভেঙে ফেলা। তারা পুরোনো বাড়িটি ভেঙে সেখানে একটি নতুন বাড়ি তৈরি করতে চান।
এই সংবাদে লস এঞ্জেলেসে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে সংরক্ষণ ও যত্নের অভাবে বাড়িটির বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভবন নষ্ট হয়ে গেছে।
গত সেপ্টেম্বরে বাড়িটি কেনা এই দম্পতির পরিকল্পনা জানাজানি হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই, লস অ্যাঞ্জেলেস নাগরিক পরিকল্পনা বিভাগ শহরের ১২০০টি অন্যান্য সুরক্ষিত স্থানের সঙ্গে মনরোর বাড়িটিকেও ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ (এইচসিএম) হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য মনোনীত করেছিল। যার ফলে বাড়িটি ভাঙার চেষ্টা ভেস্তে যায়।
শহরটি এখনও বাড়িটি রক্ষার জন্য সচেষ্ট রয়েছে এবং মার্চ মাসে সিটি কাউন্সিলকে বাড়িটির এইচসিএম উপাধি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ভোট আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
আগামী গ্রীষ্মে এই ভোট অনুষ্ঠিত হবে। তবে বাড়িটিকে রক্ষার জন্য এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট নাও হতে পারে।
লস এঞ্জেলেস টাইমস জানিয়েছে, মামলার এজাহারে মিলস্টেইন ও ব্যাংক বলেছেন, মনরোর মৃত্যুর পর এই ছয় দশকে বাড়িটির ১৪ জন মালিক বদল হয়েছে। তারা কেউই মনরোর কথা মনে রাখেনি। বাড়িটিতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং বহুবার সংস্কারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ওই দম্পতির মতে, নগর কর্মকর্তারা বাড়িটির সুরক্ষা চাওয়ার মাধ্যমে একটি অসাংবিধানিক এবং তাদের অধিকার ক্ষুন্ণ করার মতো কাজ করেছেন।
এই বিলিয়নেয়াররা শহরটিকে এই বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য 'গোপন ষড়যন্ত্র' করার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন এবং তারা বিশ্বাস করেন যে এই বাড়িটি স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয়।
অভিনেত্রী সেখানে আসলেই সময় কাটিয়েছেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নতুন মালিকেরা।
মৃত্যুর মাত্র দেড় বছর আগে ২৯০০ বর্গফুটের স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক স্টাইলের বাড়িটি কিনেছিলেন মনরো। এর গঠন আজকালকার সেলিব্রিটিদের ব্যবহৃত ম্যানশন থেকে অনেকটাই আলাদা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।
কিন্তু বাড়ির বর্তমান মালিকেরা এ কথা মানতে নারাজ।
তাদের দাবি, 'ওই বাড়ির এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে এমন কোনো চাক্ষুষ প্রমাণ আছে যে মিস মনরো বাড়িটিতে একটা দিনও কাটিয়েছেন। কোনো আসবাবপত্র, পেইন্টিং, কার্পেট কোনো কিছুতেই তার কোনো প্রমাণ নেই।'
ব্রেন্টউড হোমওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা গত আগস্টে ইএল পাইসকে বলেছিলেন, তারা এই বাড়িটি ধ্বংসের কথা শুনে 'খুব দুঃখিত' বোধ করেছেন। তবে তাদের এ বিষয়ে 'হস্তক্ষেপ করার কোনো ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেই।'
শহরের অন্যান্য অংশের মতো ব্রেন্টউড এলাকাটিও এসব বিলিয়নিয়ারদের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে, যারা এর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে সম্মান করে না।
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে অভিনেতা ক্রিস প্র্যাট এবং তার স্ত্রী লেখক ক্যাথরিন শোয়ার্জনেগার একই পাড়ায় জিমারম্যান হাউস ভেঙে একটি প্রাসাদ তৈরি করেছেন।
১৯৫০ এর দশকের বাড়িটি আমেরিকান স্থপতি ক্রেগ এলউড ডিজাইন করেছিলেন এবং আধুনিক উদ্যানের অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে বিবেচিত গ্যারেট একবো এর ল্যান্ডস্কেপ করেছিল। অথচ আজ তা ধ্বংসস্তূপ।
মনরোর বাড়ির সামনের বারান্দায় একটি টালিতে ল্যাটিন ভাষায় 'কার্সাম পারফিসিও'- বাক্যাংশটি লেখা ছিল। যার অর্থ 'যাত্রা এখানেই শেষ'।
তার তিন স্বামীর বাড়িতে, রুজভেল্ট হোটেলে (হলিউড ওয়াক অব ফেমের পাশে) এবং বেভারলি হিলস হোটেলের একটি বাংলোতে থাকার পরে, সবশেষে এটিই ছিল তার প্রথম এবং একমাত্র বাড়ি।
বাড়িটিতে লম্বা কাঠের বিম এবং একটি কিডনি আকৃতির পুল রয়েছে। কথিত আছে, মনরো কখনো এই পুল ব্যবহার করেননি।
মনরো বাড়িটি ৭৫ হাজার ডলারে (২০২৪ সালের হিসাবে প্রায় ৭ লাখ ৭৫ হাজার ডলার) কিনেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এর মূল্য কয়েক মিলিয়ন ডলার।
ফোর্বসের ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ব্রিনাহ মিলস্টাইনের পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি। মিলস্টাইন পরিবার বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাশিয়া থেকে নিউইয়র্কে চলে এসেছিলেন। এরপর তারা একটি বিশাল নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং ব্যাংকে বিপুল অর্থ সঞ্চয় করেন। তারা পরোপকারী, শিল্প ও চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়নে প্রায়ই অর্থ দান করেন।
রায় ব্যাংক একজন প্রযোজক এবং ব্যাংকা স্টুডিও'র মালিক, যেখানে বিভিন্ন টেলিভিশন প্রোগ্রাম তৈরি হয়। এই দম্পতি এক দশক ধরে বিবাহিত।
রাস্তা থেকে ১২৩০৫ পঞ্চম হেলেনা ড্রাইভের বাড়িটি দেখা যায় না। তবে সর্বদা এটিতে কয়েকজন কৌতূহলী দর্শকের আনাগোনা থাকেই। এছাড়া প্রায়ই এর গেটের সামনে বিভিন্ন রঙিন পর্যটন বাস এসে দাঁড়ায় এবং ইশারায় বাড়ির বাইরের প্রাচীরটি দেখিয়ে পর্যটকদের খুশি করেন।
সর্বপ্রথম ২০১৩ সালে শহরটি বাড়িটি রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রস্তাবটি এগোয়নি, কারণ এটি ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বর্তমানে নাগরিক পরিকল্পনা বিভাগ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কমিশন এবং সিটি কাউন্সিল এটি রক্ষার চেষ্টা করছে।
ব্রেন্টউডের বাসিন্দারা জানেন, তাদের পাশে থাকা বিখ্যাত এই মানুষটির প্রিয় বাড়িটি রক্ষার জন্য তাদের লড়াই করতে হবে।