বলিউডের অন্ধকার অতীত ফিরে আসছে!
ডিজাস্টার। ফ্লপ। অ্যাভারেজ। ২০২৪ সালে বলিউডের কোনো ছবির ভাগ্য নিয়ে যদি বাজি ধরতে হলে এই তিনটে শব্দ বেছেই নেওয়াই হতো সবচেয়ে নিরাপদ। এ বছর বলিউডের চলচ্চিত্রগুলোর বক্স-অফিস আয় কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।
বিশ্বের সবচেয়ে রমরমা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির এখন নিভু নিভু দশা। মরিয়া হয়ে আশায় বুক বেঁধে বসে আছে, হয়তো ২০২৫ সালে অবস্থা সামান্য এরচেয়ে ভালো হবে। একই আশায় বুক বেঁধেছে মুম্বাইয়ের পুলিশও। কারণ সিনেমাহল যখন ফাঁকা হয়ে যায়, তখন শহরের রাস্তায় বাড়তে শুরু করে খুনের সংখ্যা। ১৯৯০-এর দশকে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানীর দিনগুলো এমনই ছিল। মানুষের মনে এখন আশঙ্কা, সেই আইনহীনতার দিন আবার ফিরতে পারে।
এই ভয় কোনোভাবেই অতিরঞ্জিত নয়। অক্টোবরেই গাড়িতে ওঠার সময় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী বাবা সিদ্দিককে। বলিউডের বহু তারকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি।
হত্যার দায় স্বীকার করা একটি গ্যাংয়ের সদস্য ফেসবুকে লিখেছিল, 'এই খুনের নেপথ্যের কারণ বলিউড, রাজনীতি এবং সম্পত্তি ব্যবসা।'
বোম্বের (১৯৯৫ সালের আগে মুম্বাইয়ের নাম) অপরাধ জগত আর শোবিজ—এই দুটি অঙ্গন দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
১৯৪৮ ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দেশটিতে সিনেমার যে স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছিল, তা টিকে ছিল প্রায় ২০ বছর। তবে ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে রাজনীতিতে আদর্শচ্যুতি দেখা দেয়। রাজনৈতিক আদর্শের সেই অধঃপতনের প্রতিফলন ঘটতে শুরু করে পপ কালচারে। বলিউড তখন সামাজিক সমস্যা তুলে ধরা বাদ দিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখানোর কারখানায় পরিণত হয়, যা অব্যাহত আছে আজও।
১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে ভারত প্রতি বছর শত শত হিন্দি ছবি মুক্তি দিতে শুরু করে। তবে ব্যাংকগুলো এসব সিনেমায় অর্থায়ন করত না। ঠিক এই সুযোগ নিয়েই বলিউডে ঢুকে পড়ে হাজি মস্তান-এর মতো লোকেরা।
ওই সময় মুম্বাইয়ের অন্যতম প্রভাবশালী ডন হাজি মস্তান ছিলেন গ্ল্যামারের ভক্ত। পরনে সবসময় থাকত ধবধবে সাদা পোশাক। তার প্রেমিকার ছিলেন অভিনেত্রী। প্রেমিকার জন্য তিনি সিনেমায় লগ্নি শুরু করেন। সেই থেকে হাজি মস্তান এক অর্থে বলিউডের জন্য প্রাইভেট ইকুইটি প্লেয়ার হয়ে ওঠেন।
মুম্বাইয়ের অপরাধ জগত প্রাথমিক পুঁজি তোলে বন্দর থেকে। সোনা আর ইলেকট্রনিক্স চোরাচালান করত তারা। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে ভারত অর্থনৈতিকভাবে আরও উন্মুক্ত হওয়ার পথে হাঁটলে এই অপরাধচক্রও নিজেদের নতুনভাবে গড়ে তোলে। অবৈধভাবে মাদক সরবরাহ ও চাঁদাবাজি বাদ দিয়ে তারা প্রবেশ করে টাকা পাচার, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান…এবং সিনেমার দুনিয়ায়।
২০০৩ সালে ইনস্টিটিউট অভ পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময় থেকে ডনরা আর স্রেফ লাভের হিস্যা নিয়েই তুষ্ট রইল না। তারা সরাসরি প্রযোজক হয়ে এবং চলচ্চিত্র ও সংগীতের আন্তর্জাতিক বিপণনের স্বত্ব নিয়ে অংশীদারত্ব দাবি করতে শুরু করে।
এই পরিবর্তনের নেতৃত্বে ছিলেন দাউদ ইব্রাহিম। হাজি মস্তান-পরবর্তী যুগে মুম্বাইয়ের সবচেয়ে ভয়ংকর গ্যাংস্টারে পরিণত হন পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে দাউদ।
১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে দাউদ দুবাই থেকে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করেন। তবে তার গ্যাং 'ডি কোম্পানি' মুম্বাইয়েই ত্রাস ছড়াচ্ছিল। ধারণা করা হয়, ১৯৯৭ সালে তারাই ভারতের অন্যতম সফল সংগীত প্রোডাকশন হাউস টি-সিরিজের প্রতিষ্ঠাতাকে হত্যা করে।
এরপর আরেক তারকা হৃতিক রোশনের প্রযোজক বাবাকেও হত্যার চেষ্টা করে ডি কোম্পানি। এ দুটি ঘটনা ভারতের বিনোদন জগকে কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৯৩ সালের মুম্বাই বোমা হামলাতেও দাউদ ইব্রাহিম জড়িত বলে ধারণা করা হয়। ওই সিরিজ বোমা হামলায় ২৫৭ জন নিহত হওয়ার পর, প্রশাসন মাফিয়াদের দমনে আরও কঠোর হয়।
বলিউডের আবার তথাকথিত 'এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট'-প্রীতিও আছে। এই এনকাউন্টার স্পেশালিস্টরা অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আদালতে না তুলে সরাসরি গুলি করে হত্যা করে। এদের নিয়ে এন্তার সিনেমা হয়েছে বলিউডে। এমনই একটি জনপ্রিয় সিনেমা 'আব তক ছাপ্পান' (এখন পর্যন্ত ৫৬ জন')। ছবির প্রধান চরিত্র এনকাউন্টারে হত্যা করা অপরাধীর সংখ্যা গুনে রাখত এভাবে।
যখন মনে হচ্ছিল মুম্বাই সহিংসতার সেই চক্র থেকে মুক্তি পেয়েছে, তখন ফের দেখা গেল নতুন অস্বস্তির লক্ষণ।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানির বাড়ির সামনে থেকে বিস্ফোরকভর্তি একটি গাড়ি উদ্ধার হয়। এই ঘটনায় অভিযুক্ত একজন সাবেক 'এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট' গোয়েন্দা এখনও বিচারকাজ শুরু হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। ২০২৩ সালে আদালত তার জামিনের আবেদন খারিজ করে দেন।
বাবা সিদ্দিকের হত্যাকাণ্ড মুম্বাইয়ের আকাশে অশনিসংকেতকে আরও গাঢ় করেছে। ১৯৯৯ সালের কঠোর সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন আইন প্রয়োগ করেছে পুলিশ। তবে তারা এখনও জানে না আন্ডারওয়ার্ল্ডের বর্তমান প্রভাব কতটা গভীর।
২০০১ সালে এক সাক্ষাৎকারে দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছোটা শাকিল বলেছিলেন, 'আমরা ২০-২৫টা ছবি বানিয়েছি, ওগুলো থেকে মুনাফাও করেছি। ফিল্মের লোকজনের কাছ থেকে চাঁদাবাজি না করে আমরা তাদের সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা করতে চেয়েছিলাম।'
বলিউডের কর্পোরেটাইজেশনের মুখোশের আড়ালে কি এ জগতে আবারও অপরাধের অর্থ ঢুকে পড়েছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ভারতের অনুসন্ধানী সাংবাদিক স্বাতী চতুর্বেদী সম্প্রতি লিখেছেন, "বিশ্বের আর কোথাও এত বড় একটি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি এরকম সংঘবদ্ধ হুমকির মুখে নেই।'
এই অপরাধজগতের প্রভাব শোবিজ জগতকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাবা সিদ্দিককে হত্যায় মূল সন্দেহভাজন গ্যাংটির নেতা লরেন্স বিষ্ণোইয়ের নাম শুধু ভারতেই নয়, কানাডায়ও আলোচনায় এসেছে।
কানাডা পুলিশ অভিযোগ করেছে, বিষ্ণোই ভারতের সরকারি এজেন্টদের সঙ্গে আঁতাত করে কানাডায় বসবাসরত শিখ প্রবাসীদের হত্যার এবং হয়রানির পরিকল্পনা করেছিলেন।
শুধু একটি কূটনৈতিক সংকটের কেন্দ্রই হয়ে ওঠেননি এই গ্যাংস্টার, ভারতের অন্যতম বড় তারকা সলমন খানকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন তিনি।
ভারতের আর্টহাউস সিনেমা বরাবরই চটকদার গান, নাচ ও অ্যাকশনের রঙিন জগতের নিচে চাপা পড়ে গেছে। ডানপন্থি প্রোপাগান্ডামূলক চলচ্চিত্রগুলো প্রথাগত নাচ-গান-অ্যাকশনে ভরপুর চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামায় গত কয়েক বছরে এ অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
তবে এখন পরিস্থিতি এমন যে, মুম্বাই তার নিজস্ব অতিনাটকীয় বিনোদন জগতের নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলছে।
২০২৪ সালে বলিউড যখন মন্দায় ডুবে আছে, তখন দক্ষিণ ভারতীয় শহর হায়দরাবাদের স্টুডিওগুলো সবচেয়ে বড় দুটি হিট ছবি উপহার দিয়ে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। এ যেন অনেকটা ১৯৮৪ সালের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি। তখনও বলিউড অপরাধ জগতের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।
এদিকে সারা বিশ্বে প্রশংসিত ভারতীয় সিনেমা 'অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট'—যা দুটি গোল্ডেন গ্লোবের মনোনয়ন পেয়েছে এবং কান উৎসবে গ্র্যান্ড প্রিক্স বিজয়ী—ভারতে সিনেমাহল পেতেই হিমশিম খাচ্ছে।
সম্প্রতি মুম্বাইয়ের দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন প্রযোজক প্রযোজনা সংস্থার অর্ধেক মালিকানা বেচে দিয়েছেন ধনকুবের আদর পুনাওয়ালার কাছে। কোভিড মহামারির সময় টিকা উৎপাদন করে বিপুল মুনাফা করেছিলেন আদর।
বিনোদন জগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে মহামারি। মহামারির সময় সিনেমাহল বন্ধ থাকায় নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম ও হটস্টার প্লাস-এর মতো অরিজিনাল কনটেন্ট তৈরি করা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের চাহিদা বাড়ে। সে সময় এসব প্ল্যাটফর্মই ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম।
কিন্তু এখন সবকিছু খুলে যাওয়ার পরও দর্শক বড় পর্দায় ফিরতে তেমন আগ্রহ পাচ্ছে না। বড়পর্দার নিষ্প্রাণ গল্পে আগ্রহ হারিয়েছে মানুষ। সিনেমা দেখতে দলবেঁধে হলেও যাচ্ছে না তারা। এছাড়া বড় বাজেটের ওয়েব সিরিজ ও ড্রামাতেও আগ্রহ হারিয়েছে তারা।
আর বলিউডে যখন একের পর এক ব্যর্থতা দেখা যায়, মুম্বাইয়ের পরিস্থিতি তখন খারাপ মোড় নেয়।