৪ লাখ মানুষ নিয়ে 'গান্ধী'তে অভিনয় করেছিলেন বেন কিংসলে!
মহাত্মা গান্ধী, ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বেই নন্দিত এক নাম। গান্ধীকে নিয়ে এযাবত হয়েছে প্রচুর চলচ্চিত্র, বহু খ্যাতনামা অভিনেতা অভিনয় করেছেন সেসব ছবিতে। কিন্তু ১৯৮২ সালে নির্মিত 'গান্ধী' চলচ্চিত্রে ব্রিটিশ অভিনেতা বেন কিংসলেকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি কেউই। কেউ যদি প্রশ্ন করে, কোন ছবিতে সবচেয়ে বেশি এক্সট্রা বা পার্শ্বচরিত্র ছিল? উত্তর আসবে, 'গান্ধী'। সেই পার্শ্বচরিত্রের সংখ্যাটা কত? ৪ লাখ!
না, আপনি ভুল পড়ছেন না। 'গান্ধী' চলচ্চিত্রে মহাত্মা গান্ধীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানের দৃশ্যে বেন কিংসলে অভিনয় করেছিলেন ৪ লাখ সাধারণ মানুষের সাথে। কিংসলের ভাষায়, এটা ছিল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি অভিজ্ঞতা। বলে রাখা ভালো, গান্ধী'র মাধ্যমেই মোশন পিকচারে প্রথম কোনো প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন কিংসলে; আর প্রথমবারেই হয়ে যান বিশ্বনন্দিত!
সিনেমায় মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রে অভিনয় করাকে ভাগ্যের খেলা বলেই মনে করেন কিংসলে। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের দৃশ্য স্মরণ করে তিনি জানান, নিহত গান্ধীকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে প্রথমে মোমের মূর্তি দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন পরিচালক রিচার্ড অ্যাটেনবরো। কিন্তু সেটা বাস্তবধর্মী লাগছিলো না বলে কিংসলেকেই শুয়ে পড়তে বলেন পরিচালক।
'গান্ধী' মুক্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে অভিনেতা জানান, এক্সট্রারা প্রথমে তার মুখের উপরেই ফুল ছুঁড়ে মারছিলো তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য; তবুও সটান শুয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সব শান্ত হয়ে যায় এবং মার্চ করার পায়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিলো না।
এর কয়েক বছর পর জিকিউ-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কিংসলে বলেন, "আমার মনে হয় মহাত্মা গান্ধীর মতো একজন মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা ও তার চরিত্রে অভিনয় করতে পারার গর্ব আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেজন্যেই অতগুলো দিন ভারতে থেকে কাজ করতে পেরেছিলাম আমি। ছবিতে কোনো সিজিআই ছিল না, এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার! ৪ লাখ মানুষ আমার পাশে অভিনয় করছে, এর কোনো তুলনা হয় না।"
গান্ধী চলচ্চিত্রে অভিনয়ের বদৌলতে একাডেমী অ্যাওয়ার্ড ও বাফটা এওয়ার্ড নিজের করে নিয়েছিলেন বেন কিংসলে। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর মতো একজন স্থির ও শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবনকে পর্দায় তুলে ধরা মোটেও সহজ ছিল না তার জন্য। প্রচুর হোমওয়ার্কের মাধ্যমে নানা কলাকৌশল রপ্ত করেছিলেন তিনি।
২০০৯ সালে ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এসে আবারও গান্ধী প্রসঙ্গে কথা বলেন কিংসলে। "গান্ধীর শক্তির মূল উৎস খোঁজার চেষ্টা করছিলাম আমি। সত্যের জয় হবেই- এই ছিল তার দৃঢ় বিশ্বাস এবং শক্তির উৎস", বলেন তিনি। আরও জানান, রাগ ও ক্ষোভ তাকে নিজের সেরাটা ঢেলে দিতে অনুপ্রাণিত করেছে।
"গান্ধীর দেশের মানুষেরা কিভাবে নিপীড়িত হতো, তা কল্পনা করে নিজের মধ্যে গভীর রাগ পুষে রাখতে হয়েছে। এর ফলে আমি ক্ষুদ্ধ পারফরমেন্স দেইনি, কিন্তু সবাই যে গান্ধীকে দেখতে চেয়েছিল, তাকেই তুলে ধরেছি", বলেন কিংসলে।
ভারতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন এবং অহিংস আন্দোলনের জনক মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রে নিজেকে প্রকাশ করা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কিংসলের ভাষ্যে, 'গান্ধী নিজেও একজন জটিল মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার জটিলতাগুলোর মধ্যে ভারসাম্য ছিল। আমাকে তাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে হয়েছে, তা নাহলে এই পারফরমেন্সটা দিতে পারতাম না।"
শুধু মানসিক প্রস্তুতিই নয়, গান্ধী'র জন্য শারীরিক কসরত ও যোগব্যায়ামও করতে হয়েছে কিংসলের। অভিনেতা মনে করেন, যোগব্যায়াম করলে গান্ধীকে অনুভব করা যায়। ঠান্ডা মাথায় সব কাজ করা যায়। আগের ইনজুরির কারণে মেঝেতে বসে যোগব্যায়াম করতে পারতেন না কিংসলে। কিন্তু সেটিও তিনি কাটিয়ে উঠেছিলেন তিনি।
২০১৮ সালে বেন জানান, গান্ধী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেলে আবারও মেক-আপসহ তাকে পারফর্ম করতে বলেন পরিচালক। ১৯৮১ সালে রিচার্ড অ্যাটেনবরো বলেন, "শারীরিক মিল একটা বড় সুবিধা ছিল। আমি ৫ বছর ধরে বেন কিংসলেকে গান্ধী চরিত্রে কল্পনা করেছি। তার মতো করে আর কারো নামই মাথায় আসেনি।"
আমাদের অনেকেরই অজানা যে বাবার সূত্রে বেন কিংসলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত। অভিনেতার আসল নাম কৃষ্ণা পন্ডিত ভানজি। যুক্তরাজ্যে বর্ণবাদের যে চর্চা চলতো, ছোটবেলায় তার শিকার হয়েছেন তিনিও। ১৯৯১ সালে ডিক ক্যাভেট শো'তে এসে কিংসলে জানান, ছোটবেলায় তাকে 'ওগি' বলে গালি দিয়ে ক্ষ্যাপানো হতো। কিন্তু এসব অপমান থেকেই জ্বলে ওঠার শক্তি পেয়েছেন তিনি।
অভিনেতা বলেন, "যেই ছেলে আমাকে ওগি বলেছিল এবং লাথি দিয়েছিল, তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি তাকে বলতে চাই, তুমি কি আমার অস্কার দেখতে চাও? তোমার সেই আচরণের জন্যেই আজ আমি এত বড় সম্মান অর্জন করতে পেরেছি। তাই তোমাকে ধন্যবাদ!"
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস