চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করেন এম এ আজিজ
১৯৫২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক 'ইত্তেফাক'র খবরে বলা হয়, "চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক এম এ আজিজের উদ্যোগে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠনের উদ্যোগ চলছে। একুশে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল পালনের জন্য আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিসের কর্মীদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।"
'৫২ সালেই নয়, ১৯৪৭ সালে যখন আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠিত হয়নি, তখন থেকেই এম এ আজিজ বিরোধী দলীয় যে কোন আন্দোলনে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন। বিভাগীয় শহরে অবস্থান করেও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে অপরিহার্য প্রভাব বিস্তারের ইতিহাস রচনা করেছিলেন এই এম এ আজিজ।
১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন নিয়ে সংগঠন হিসেবে তমদ্দুন মজলিশের সক্রিয়তা ছিল বেশি। আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তমদ্দুন মজলিশকে সহযোগিতা করতে দ্বিধা করেননি এম এ আজিজ।
এমএ আজিজ ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম জেলার হালিশহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোহাববত আলী ও মাতা রহিমা খাতুন। এম এ আজিজ ১৯৪০ সালে পাহাড়তলী রেলওয়ে হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এ সময়ে তিনি অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগে যোগ দেন। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য ১৯৪৪ সালে তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৪৮ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হালদা নদীর বাঁক কাটা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এম এ আজিজের নতুন পথচলা শুরু হয়।
১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পর থেকে এম এ আজিজ চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫০ সালের ১৫ জানুয়ারি জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বার্মা অয়েল কোম্পানীর শ্রমিকদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এম এ আজিজ।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা', মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই ঘোষণার পর মাওলানা ভাসানী ছাত্রদের সংগঠিত করতে শামসুল হককে চট্টগ্রামে পাঠান। গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে পর্যটক বেশে সস্ত্রীক চট্টগ্রাম এলেও তিনি রেহাই পাননি। শামসুল হককে গ্রেপ্তারে আওয়ামী লীগ অফিসে হানা দেয় গোয়েন্দারা। সেদিন গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ নগরের চকবাজারের একটি হোটেলে আশ্রয় দেন শামসুল হক দম্পতিকে। সেখান থেকেই শামসুল হক চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজে আন্দোলন বেগবানের রূপরেখা দেন।
১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের কর্মসূচি অনুযায়ী, ৪ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ অফিসে সভা আহ্বান করা হয়। সভায় এম এ আজিজকে যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়।
সেই ঘটনা স্মরণ করে ভাষা সৈনিক আব্দুল্লাহ আল হারুন বলেন, "এম এ আজিজ চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছাত্রদের সংগঠিত করতেন। কলেজের ছাত্ররাও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।"
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'নওবেলাল'-এর খবরে বলা হয়, "চট্টগ্রামে সর্বদলীয় ভাষা কমিটি গঠিত হয় জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের এম এ আজিজ এবং তমদ্দুন মজলিসের আজিজুর রহমানের উদ্যোগে।"
ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের খবর ২২ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম এসে পৌঁছায়। এরপর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের আগুন। মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে পুরনো ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট চত্বরে। ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে একটি সভায় এম এ আজিজ বক্তব্য রাখেন। সেদিন চট্টগ্রামে ২৩ ফেব্রুয়ারী হরতাল ও ২৪ ফেব্রুয়ারী জনসভার সিদ্ধান্ত হয়। পরে এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর যৌথ মিছিল লালদীঘি ময়দানে গিয়ে মিলিত হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারী লালদীঘি ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের মাঝে বক্তব্য রাখেন এম এ আজিজ। সেই সভাতেই একুশের প্রথম কবিতা 'কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি' পাঠ করা হয়।
১৯৫২ সালের ৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ 'শহীদ দিবস' পালন করে। এটি ঢাকায় তেমন সফল না হলেও চট্টগ্রামে সবচেয়ে বড় জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বক্তব্য রাখেন জননেতা এম এ আজিজ। সেদিন তিনি সরকারি প্রচারপত্র ও তথাকথিত মুসলীম নেতাদের বিবৃতির কঠোর সমালোচনা করেন। তার যুক্তিগুলো এতটাই অকাট্য ছিলো যে, উপস্থিত জনতা মুহুর্মুহু আওয়াজ তুলে তাকে সমর্থন জানান।
এর পরপরই এম এ আজিজ গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনিবাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এম এ আজিজ। ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী এম এ আজিজকে গ্রেপ্তার করেন।
১৯৬৪ সালে লাহোরে বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা ঘোষণা করেন, খোদ আওয়ামী লীগও তখন ৬ দফাকে ঠিক গ্রহণ করে নিতে পারছিল না। ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ান এম এ আজিজ। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে ৬ দফার সমর্থনে জনসভারও আয়োজন করেন তিনি। সেই জনসভার কারণে ১৯৬৬ সালের ৮ই মে নিরাপত্তা আইনে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন আহমেদ, জহুর আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হন।
এম এ আজিজ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কোতোয়ালী-ডবলমুরিং আসন থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা আন্দোলনের উন্মাতাল সময়ে ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি ফটিকছড়িতে জনসভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ