চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জোগান কথাশিল্পী শওকত ওসমান
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে চট্টগ্রামে ১৯৪৭ সাল থেকে জনমত তৈরি করার জন্য প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সাংস্কৃতিক কর্মীরা পাকিস্তানের শুরু থেকেই একটি প্রগতিশীল ধারা নির্মাণ করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান।
'একটা নতুন সমাজ' যেখানে 'শ্রেণিভেদ থাকবেনা কোনো বর্ণভেদ থাকবেনা, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে না' এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে মাহবুব উল আলম চৌধুরী 'সীমান্ত' নামক একটি পত্রিকা প্রকাশে আগ্রহী হন। সেসময় মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরীর যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত 'সীমান্ত' পত্রিকা প্রকাশনায় উৎসাহ জোগান পশ্চিমবঙ্গ থেকে সদ্য আগত শওকত ওসমান। চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন 'সীমান্ত' পত্রিকা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথমদিকে চট্টগ্রামে একটি অসম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। 'সীমান্ত' পত্রিকাকে ঘিরে গড়ে ওঠে 'সাংস্কৃতিক বৈঠক' নামে একটি সংগঠন। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে 'সীমান্ত' পত্রিকা দৃঢ় ভূমিকা পালন করে। পত্রিকায় 'রাষ্ট্রভাষা' নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এসবের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শওকত ওসমান।
প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে 'সাংস্কৃতিক বৈঠক' এবং 'প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ' যৌথভাবে ১৯৫১ সালের ১৬-১৯ মার্চ হরিখোলার মাঠে দেশের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করে।
সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবুল ফজল। এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনের মূল সভাপতি ছিলেন আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ। সম্মেলনের অফিস ও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ। সায়দুল হাসান ও শওকত ওসমানের যুগ্ম স্বাক্ষরে ওই সম্মেলনের আবেদনপত্র প্রকাশিত হয়েছিল।
শওকত ওসমান ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার সবল সিংহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা শুরু করলেও পরবর্তীকালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও অর্থনীতি বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
আইএ পাস করার পর শওকত ওসমান কিছুদিন কলকাতা কর্পোরেশন এবং বাংলা সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন। এমএ পাস করার পর ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে প্রভাষক পদে নিযুক্ত হন।
১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্সে (বর্তমানে সরকারি কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম) যোগ দেন এবং ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৭২ সালে স্বেচ্ছা অবসরে যান।
চাকরি জীবনের প্রথমদিকে কিছুকাল তিনি 'কৃষক' পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেন। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ শওকত ওসমানকে বলতেন 'অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ'। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর তিনি চলে আসেন পূর্ববঙ্গে।
শওকত ওসমান বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের একজন স্বনামখ্যাত লেখক ও কথাসাহিত্যিক। তার আসল নাম শেখ আজিজুর রহমান।
শওকত ওসমান একাধারে নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রাজনৈতিক লেখা ও শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী হিসাবে সমধিক পরিচিত ছিলেন।
'ক্রীতদাসের হাসি' তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৭), ১৯৮৩ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ইত্যাদি শীর্ষপর্যায়ী পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হন। তিনি ১৯৯৮ সালের ১৪ মে পরলোক গমন করেন।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ