জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা ছাপান যিনি
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তার সমসাময়িককালে পিছিয়ে থাকা মুসলমান সমাজে তিনি ছিলেন চিন্তায় ও মননে অগ্রগামী। বাঙ্গালি মুসলিম সমাজকে বিশ্বের সাথে যুক্ত করার প্রয়াসে তিনি প্রকৌশল পেশা ছেড়ে প্রকাশনায় আসেন। প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। শোষকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই প্রেস থেকে তিনি ছাপিয়েছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত ভাষা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় কবিতা 'কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি'।
তৎকালীন নুরুল আমিন সরকারের প্রশাসনের নির্যাতনের ভয়ে সেই কবিতা ছাপাতে কেউই রাজি হননি। অমিত সাহসের অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধার কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার আন্দরকিল্লার কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি নেন।
তবে পাক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজটি সমাধান করাও এক দুরূহ ব্যাপার। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী সারারাত গোপনে প্রেসে কাজ করে ভোরে ১৭ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকায় ছাপা হয় 'কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি'।
শীতের গভীর রাত, কম্পোজ ও প্রুফের কাজ প্রায় শেষ- এমন সময় পুলিশ হানা দিল প্রেসে। প্রেসে দলের সাথে থাকা ভাষা আন্দোলনের আরেক নায়ক, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস লুকিয়ে পড়লেন। প্রেসের কর্মচারীরা অতি দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার এমনভাবে লুকিয়ে ফেললেন যে পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেল না। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আবার পুরোদমে শুরু হল ছাপার কাজ। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের কর্মচারীদের উদ্যম এবং তৎপরতায় গোপনে পুস্তিকাটির প্রায় ১৫ হাজার কপি বিক্রয় ও বিতরণের জন্য মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কাজ শেষ হয়। এর দাম রাখা হয় দু'আনা।
২৩ ফেব্রুয়ারি লালদিঘীর ময়দানে কবিতাটি প্রথম জনসম্মুখে আবৃত্তি করেন আরেক ভাষা সৈনিক চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতা শুনে ময়দানে জড়ো হওয়া জনতা ফেটে পড়ল বিক্ষোভে। মুহুর্মুহু স্লোগানে কেঁপে উঠল পাক মসনদ। শত সহস্র বুলেটের চাইতেও এই ক'টি লাইন কত শক্তিশালী তার প্রমাণ মিলল যখন পাক সরকার কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করে। কবিতাটি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, প্রতিবাদ সভায় কবিতাটির পাঠক চৌধুরী হারুনুর রশীদ, প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ বিএ'র বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরীকে দ্রুত গ্রেপ্তারও করা হয়।
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের জন্ম ১৮৯৬ সালের ২০ জুলাই চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে তিনি মা, ভাই-বোনদের নিকট হতে প্রারম্ভিক পড়ালেখার অনেকটাই আয়ত্ব করেছিলেন। পাঁচ বছর বয়সেই ভর্তি হন রাউজান স্টেশন প্রাইমারি স্কুলে। দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার মাধ্যমে আবদুল খালেকের মেধার পরিচয় ঘটে। ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাউজান আর আর এসি ইনস্টিটিউশানে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন আবদুল খালেক। সেখানে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে বঙ্গীয় বৃত্তি লাভ করেন। একই স্কুল হতে ১৯১২ সালে এন্ট্রান্স (এসএসসি) পরীক্ষায় চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম হয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৪ সালে জেলা বৃত্তি নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন।
পরে তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। কর্মজীবনের শুরুতে ১৯২০ সালে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি নেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। পেশাগত জীবনে চট্টগ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এ অঞ্চলটিকে মননশীল ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর লাইব্রেরি। ১৯২৯ সালে এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। পরের বছর প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস, যা চট্টগ্রামে ছাপাখানার জগতে বিপ্লবের সূচনা করে। সে সময় মননশীল বিভিন্ন সাহিত্য সংকলন সহ বেশ কিছু পত্রিকা এই প্রেস থেকে ছাপা হতো।
আবদুল খালেকের কোহিনূর প্রেস থেকেই ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তার সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদী। আজাদী প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে আধুনিক বিশ্বের সাথে যোগ করার। এই পত্রিকা প্রকাশে তিনি যে পরম নিষ্ঠা ও অক্লান্ত শ্রম দিয়েছেন তা সাংবাদিক হিসেবে তার সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় তুলে ধরে। তিনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন, কিন্তু রক্ষণশীলতা তাকে আচ্ছন্ন করেনি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী এই ব্যক্তিত্ব মানুষকে দেখেছেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মারা যান।
টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ