অস্পষ্ট কূটনীতির ‘সুলতান’ এরদোয়ান
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে বৈশ্বিক রাজনৈতিক চিত্রপটে যে পরিবর্তন দেখা গিয়েছে তার অন্যতম একটি কর্মক হলো রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান দেশ তুরস্ক। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পর বিশ্বব্যবস্থা পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র বা একমেরু কেন্দ্রিক হয়ে পড়লেও এর কিছু সময় পরেই, একবিংশ শতকের শুরুতে পারমাণবিক অস্ত্রের সমারোহে শক্তিশালী রূপে রাশিয়ার উত্থান এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান বিশ্বব্যবস্থাকে এখন বহুমেরু কেন্দ্রিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর এই বহুমেরু কেন্দ্রিকতায় তুরস্কও নিজের নাম লেখাতে ভুলে যায়নি। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক দক্ষিণ ককেশাসীয় ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসহ পূর্ব ইউরোপের রাজনীতি ও দ্বন্দ্বে সম্পৃক্ততা এবং ন্যাটোর সদস্য হওয়া ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার প্রচেষ্টা মূলত তুরস্কের বৈশ্বিক রাজনৈতিক মঞ্চে প্রধান শক্তিদের মধ্যে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেই ইঙ্গিত করে।
ত্রয়োদশ শতক থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অটোমানদের অধীনে অনেকটা মোডিফাইড ইসলামিক নিয়ম কানুনেই পরিচালিত হত তুরস্ক। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্র পক্ষের কাছে পরাজয়ের ফলে অটোমান সম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং মিত্রপক্ষ যখন তুরস্ককের মূল ভূমির ভাগ বাটোয়ারা করতে উদ্ধত হয় তখন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক বৈদেশিক দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তুরস্কের মূলভূমি থেকে তাদেরকে উৎখাত করেন। তুরস্কের স্বাধীনতার জনক কামাল আতাতুর্ক পরিচালিত এই যুদ্ধ তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবেই পরিচিত। ১৯২৩ সালে কামাল আতাতুর্ক প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তুরস্কের সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। তিনি ইউরোপিয় পোশাক, সংস্কৃতিকে তুরস্কে প্রোমোট করেন। ফলে তুরস্কের অধিকাংশ ভূমি এশিয়ার অন্তর্গত হলেও তার্কিশ জনগণ নিজেদেরকে ইউরোপিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
প্রেসিডেন্ট আতাতুর্কের সময় থেকে তুরস্ক ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নীতিধারা অনুসরণ করলেও বর্তমান সময়ে এসে এরদোয়ান নেতৃত্বাধীন তুরস্ককে পশ্চিমাদের সাথে প্রায়ই বাকযুদ্ধে লিপ্ত হতে দেখা যায়। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাধারী পাঁচ রাষ্ট্রকে নির্দেশ করে বলেছিলেন, "পৃথিবীটা পাঁচ শক্তির চেয়েও বড়"। এরদোয়ানের একথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে পাঁচ বৃহৎ শক্তিকে টক্কর দিয়ে তুরস্ককে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মঞ্চের কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াই তার মূল লক্ষ্য। তবে তুরস্কের এমন আকাঙ্ক্ষাকে পশ্চিমাবিশ্ব স্বাভাবিকভাবেই ভালো চোখে দেখছেনা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাক্রন তুরস্কের এমন আচরণকে "অতীতে ফিরে যাওয়ার কাল্পনিক আশা" হিসেবে কটাক্ষও করেছেন।
সাংবিধানিকভাবে তুরস্ক সেক্যুলার রাষ্ট্র হলেও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মনে করেন তুরস্কের জনগণের প্রকাশ্যে নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার রয়েছে। এমনটি তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণাও দিয়েছেন। এরদোয়ানের এমন মনোভাব মুসলিম প্রধান দেশগুলোয় তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করলেও পশ্চিমাদের কাছে এটা অনেকটা অটোমান সম্রাজ্যের "সুলতান" সুলভ আচরণ। এছাড়া অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নেতৃত্বাধীন দল হামাসকে (যেটা পশ্চিমাদের কাছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত) তুরস্ক সমর্থন করে। সম্প্রতি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইউরোপিয় ও আমেরিকান বিশ্বনেতাদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি শান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যা মুসলিম বিশ্ব হতে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। যদিও অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা তুরস্কের কাছ থেকে আরও বড় ধরণের পদক্ষেপ চেয়েছিলো, তারপরেও তারা একেবারে নিরাশ হয়নি। এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে যে ভূমিকা সৌদি আরবের নেয়ার কথা ছিলো বিশ্ব মিডিয়ায় সে ভূমিকার জায়গায় মানুষ তুরস্ককে দেখেছে। একথা সবারই জানা যে, মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের মর্যাদা বেশ উপরে। কিন্তু তুরস্ক সেক্যুলার রাষ্ট্র হলেও মুসলিম বিশ্বে নিজের জায়গা ধরে রাখতে ও মর্যাদায় সৌদি আরবকে টক্কর দিতে প্রায়শই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। তবে এটাও সত্য যে, ১৯৪৯ সালে মুসলিম দেশ হিসেবে তুরস্কই সর্বপ্রথম ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। এক্ষেত্রে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অনেকটা সংশোধনবাদী (Revisionist) নেতা হিসেবে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করছেন।
এছাড়া সিরিয়া ও লিবিয়া যুদ্ধে তুরস্কের সামরিক বাহিনীর সম্পৃক্ততা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তুরস্ককে আরও বেশি সক্রিয় করে তুলেছে। নাগার্নো কারাবান নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মাঝে দ্বন্দ্বে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বরারই আজারবাইজানের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে থাকেন এবং দেশটির সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া থেকে শুরু করে নানা ধরণের সামরিক সহায়তাও করে থাকেন এমন কথা প্রচলিত আছে। আর আজারবাইজান তুরস্কের এমন সমর্থনকে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। অর্থ্যাৎ, তুরস্ক বৃহৎ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ইতোমধ্যেই এবং প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বর্তমান প্রচেষ্টা হলো বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের নেতৃত্বের একটি শক্তিশালী জায়গা তৈরি করা।
২০০৩ সালে এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশ উন্নতি করেছিলো দেশটি। কিন্তু গত এক দশক যাবত ডলারের বিপরীতে তার্কিশ লিরার মূল্য বেশ কমেছে। এর মাঝে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর একই বছর তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় সংশোধন এনে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন এবং রাষ্ট্রপতির অর্থাৎ নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। তবে সাংবিধানিক এমন পরিবর্তনকে দেশটির একদল সামরিক অফিসার সমর্থন করেনি এবং ২০১৬ সালে তারা একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান চালায়। সেই অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিলো। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিদ্রোহকারী অফিসারদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার সাথে সাথে সংবিধান সংশোধনেও সফল হন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।
বেকারত্ব বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বর্তমানে সংকটে থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় সাহায্য প্রেরণে তুরস্ক মুক্তহস্তের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে এখনো। এছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী আশ্রয় দাতা দেশ হিসেবেও তুরস্ক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেছে। সিরিয়া গৃহযুদ্ধের ফলে যে অভিবাসী সংকট তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলায় তুরস্কের ভূমিকা সত্যিই অতুলনীয়। দেশটি ৩.৬ মিলিয়ন সিরিয়ান অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং অন্যান্য দেশের প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ অভিবাসীর আশ্রয় মিলেছে তুরস্কে। মানবিক সহায়তায় ও মানবাধিকার রক্ষায় শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পশ্চিমাদের সামনে এক অনন্য নজির স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন।
২০০২ সালে প্রথম যখন এরদোয়ানের জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতায় আসে তখন থেকেই মানবাধিকার উন্নয়ন, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাসহ উন্নত ও প্রাণবন্ত এক নাগরিক সমাজ গঠনের চেষ্টা, দেশে ও বিদেশে বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে তুরস্কের গ্রহণ যোগ্যতাকে বাড়িয়ে তুলেছিলো। ফলে এসময়ের মধ্যে দেশটি পশ্চিমাদের চোখের সামনেই শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এরদোয়ান তুরস্ককে এমনভাবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছেন যে, পাশ্চাত্যের ইসলামোফোবিয়ার এ যুগেও গণতন্ত্র ও ইসলাম যে সহাবস্থানে থাকতে পারে, তুরস্ক যেনো তারই প্রমাণ।
বোঝা যাচ্ছে তুরস্ক তার সফট পাওয়ারকে পুঁজি করেই বিশ্ব নেতৃত্বস্থানে আসার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে তুরস্কের অনন্য সংস্কৃতি ও পর্যটন শিল্পও বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
অন্যদিকে, আঞ্চলিকভাবে তুরস্কের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে নীতি ও মতের বিরোধ থাকলেও সেটা শান্তিপূর্ণভাবেই সব সময় সমাধানের চেষ্টা করেন এরদোয়ান। পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে পারস্পারিক সহাবস্থানে থাকাটাই তুরস্কের জন্য যৌক্তিক হবে সেটা তুরস্ক ভালোভাবেই বোঝে।
বিশ্লেষকগণ শুরু থেকেই তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিকে অনেকটা অস্পষ্ট বলে মনে করেন। মুসলিম ঐতিহ্য ধরে রেখে প্রো ওয়েস্টার্ন নীতি অনুসরণ, ইসায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক ধরে রাখা, আবার অন্যদিকে হামাসকে সমর্থন দেয়া, সেই সাথে ন্যাটোর সদস্যপদ ধরে রেখে সৌদি আরবকে টক্কর দিয়ে মুসলিম বিশ্বে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো; এই সবকিছুর ফলে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধোঁয়াশা দেখা দিলেও এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বিশ্ব মঞ্চে বহুমেরুর এক হওয়ার প্রচেষ্টায় দেশের সফট পাওয়ারকে খুব তীক্ষ্ণভাবে ব্যবহার করছেন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উত্তরোত্তর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির মাধ্যমে জাপান, অস্ট্রেলিয়া বা ব্রাজিলের মত মধ্যম সারির শক্তি হিসেবে তুরস্কের উত্থান ইতোমধ্যেই ঘটেছে, যা তৃতীয় বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলো মনেপ্রাণে সমর্থন করছে। তবে পারমাণবিক অস্ত্রের দাপট ছাড়া বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে তুরস্ক নিজের অবস্থান কতটা দৃঢ় করতে পারবে সে এক বড় প্রশ্ন। যদিও একমাত্র মুসলিম পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য বৈশ্বিক নেতৃত্ব পর্যায়ে দেশটির তৎপরতা নেই বললেই চলে; তবে এক্ষেত্রে আবার তুরস্কের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বেশ স্থিতিশীল। একাবিংশ শতকে এসে পারমাণবিক অস্ত্রের সরাসরি ব্যবহার যদিও দেখা যায়না, তথাপি নিবারণ নীতি কার্যকর, মার্যাদা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় পারমাণবিক অস্ত্রের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের মিত্ররা কখনই চাইবে না আর কোনো মুসলিম দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকুক। যদি তুরস্ক পারমানবিকীকরণের ঝুঁকি নেয় তাহলে ইউরোপের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা যতটা বৃদ্ধি পেয়েছে সেটা হারাতে পারেন এরদোয়ান, সেই সাথে অর্থনৈতিক অবরোধের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। কেনোনা, ইউরোপ তুরস্কের অন্যতম বাণিজ্যিক গন্তব্য। সুতরাং শুধুমাত্র সফট পাওয়ার দিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বিশ্বমঞ্চে নিজের অবস্থান তৈরির স্বপ্ন পূরণে কতটা সক্ষম হবেন সেটা নিশ্চয়ই সময়ই বলে দিবে।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- ইমেইল: [email protected]