আমরা ভেবেছিলাম করোনা চলে গেছে, আর তাই...
কাজলীর বাবা, সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে একটি সরকারি হাসপাতালের গেটে মারা গেলেন। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে মেয়ের হাতের উপর তার মাথা হঠাৎ এলিয়ে পড়লো। কাজলী বুঝলো বাবা আর নেই। এতক্ষণ উনি টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন এবং তাকে নিয়ে গাড়িতে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে আইসিইউতে একটি বেডের জন্য ঘুরছিলেন। এভাবেই শেষ হয়ে গেল একটি জীবন, একটি পরিবারের স্বপ্ন।
সহকর্মীর খালা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রত্যক্ষ করছেন তার চারপাশে একজন একজন করে রোগী মারা যাচ্ছে, আর একটি করে বিছানা খালি হচ্ছে। পাশাপাশি শুনছেন স্বজনের কান্না, আহাজারি। এরপর কিছুক্ষণ হাসপাতালের লোকজনের ছুটোছুটি এবং নতুন রোগীর প্রবেশ।
একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার হাতে পাওয়ার জন্য সজল দৌঁড়াচ্ছে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে। কারণ তার মেয়ের জন্য বাসাতেই জরুরি অক্সিজেন লাগবে, কোনো হাসপাতালে জায়গা খালি নেই। এভাবেই প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। মৃতের সংখ্যা ৩০ ছাপিয়ে এখন একশো পার হয়ে গেছে।
মৃত্যুর এই চিত্রগুলো যেমন সত্য, তেমনি সত্য সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট 'ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে ১০ মাস ধরে পড়ে আছে অক্সিজেন সরবরাহকারী যন্ত্র এবং কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে পড়ে আছে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্র ৩০০ ভেন্টিলেটর।' রিপোর্টটি পড়ে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আমরা কি তবে এভাবে করোনা আক্রান্ত মানুষগুলোকে খুন করছি? হ্যাঁ আমাদের সিস্টেম মানুষগুলোকে খুনই করছে। কিছু দুর্নীতিপরায়ণ, অসৎ এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাকে গ্রাস করে রেখেছে।
কোথাও কারো কোন জবাবদিহিতা নেই। আর নেই বলেই এত মানুষ যখন অক্সিজেন ও হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে নতুন করে মারা যাচ্ছেন, তখন সেই দেশেই একবছর ধরে বিমানবন্দরে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পড়ে থাকে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে দুটি প্রকল্পের কাগজ ঘাঁটতে গিয়ে এই ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।(সূত্র: প্রথম আলো)
করোনা চিকিৎসার জন্য আনা মালামাল কে ছাড়াবে, শুধু এই সমস্যার কারণে মালামালগুলো বিমানবন্দরে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। যে দাতা সংস্থাগুলো যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য টাকা দিচ্ছে, তারা কি এগুলো মনিটর করেনি? গত একবছরে ইউনিসেফও কি খোঁজ নেয়নি, তাদের মাধ্যমে আনা জিনিসগুলো কোথায় আটকে আছে?
উল্লেখ্য, গত বছর প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর জুলাই মাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে জরুরি ভিত্তিতে ১০২ কোটি টাকার চিকিৎসা সামগ্রী সংগ্রহ করেছিল ইউনিসেফ। অবাক করা বিষয় হচ্ছে গত ১০ মাস ধরে এসব সামগ্রী বিমানবন্দরে পড়ে আছে কিন্তু কোন স্টেকহোল্ডার এটি ছাড়িয়ে আনার উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু কেন?
এ প্রসঙ্গে একটি স্মৃতি মনে পড়লো। আমি একটি সরকারি সংস্থায় কর্মরত ছিলাম। অনেক বিদেশি সংস্থার প্রজেক্ট ছিল আমাদের সাথে। তখন কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, সংস্থাগুলোর কোনো মনিটরিং ও অডিট অবজেকশন ছাড়াই যেনতেন প্রকারে অনেক কাজই শেষ করা হচ্ছে। ঠিক এরকমই এটি প্রোগ্রামে কাজ করতে গিয়ে আমি তৎকালীন (খন্ডকালীন) মহাপরিচালক এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হান্নান স্যারকে বললাম, স্যার এত ভেবে বাজেট করে কী হবে? বিদেশি সংস্থার টাকা, কারো তেমন কোন মনিটরিং নাই। খরচ করলেই হয়। স্যার আমাকে বেশ জোরে ধমকে বলে উঠলেন, "এইসব কথা বলবা না মেয়ে। এগুলো সবই আমাদের দেশের মানুষের টাকা। ওরা দান দেখাইয়া দেয়, কিন্তু আমাদের মাথার দামে বদলাও নিয়ে নেয়। জনগণের টাকা আমরা নষ্ট করতে পারিনা।"
এ এক বড় শিক্ষা ছিল আমার জন্য। এখনো এভাবে টাকা বা যে কোনো জিনিস নষ্ট হতে দেখলে কলিজা কেঁপে উঠে। আর যখন সেই জিনিস হয় জীবন রক্ষাকারী ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন সিলিন্ডার, আইসিইউ শয্যা এবং আরও অনেক যন্ত্রপাতি।
বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ করোনা মহামারি মোকাবেলা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, স্পেন, ইতালি এমনকী চীনকেও খুব দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে, তাদেরও হাসপাতালে জায়গা হচ্ছিল না, আইসিইউ হয়ে উঠেছিল দুর্লভ, অধিকাংশ মানুষ ঘরে থেকে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছেন। এসব দেশসহ অনেক দেশেই দুর্বলতা, রোগ, শোক, মৃত্যুর কাহিনী থাকলেও এত অবহেলা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কাহিনী কোথাও নেই। করোনার প্রথম ঢেউতে তারা যতোটা দিশেহারা হয়েছিল, দ্বিতীয় বা তৃতীয়তে তা হয়নি। কারণ তারা দূরদর্শী এবং সেভাবেই ব্যবস্থা নিয়েছে।
অথচ করোনা ঢেউয়ের দ্বিতীয় আঘাত আসার পরেও দেখা গেল আমাদের বিবেকের কোন পরিবর্তন আসেনি, দুর্নীতিতেও কোন কমতি পড়েনি। আর তাই স্বাস্থ্যবিভাগে করোনাকালে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা আবারও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছি। ২০২০ সালে যা করেছি, ২০২১ এ এসেও সেই একই কাজ করছি। মৃত্যুভয়েও কম্পিত নয় আমাদের হৃদয়। তবে হ্যাঁ, করোনা টেস্টের রিপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে শাহেদের মতো নতুন কোন জালিয়াতি চক্রের খবর এখনো পাইনি। মাস্ক ও জীবাণুনাশক নিয়ে বাজার কুক্ষিগত করার বা দুই নম্বরীর সংবাদ খুব বেশি পাচ্ছিনা।
গত একমাস ধরে যখন মানুষর মধ্যে করোনা চিকিৎসা নিয়ে হাহাকার শুরু হয়েছে, তখন সরকার করোনা চিকিৎসায় সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বললেও, আদতে এখনো কিছু করতে পারেনি। পত্রিকার খবরে দেখলাম, আইসিইউ আশানুরূপ বেড বাড়েনি। পুরোনো দুই হাসপাতাল চালু, ফিল্ড লেভেলে হাসপাতাল তৈরি, নতুন কোভিড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসহ আরো কিছু উদ্যোগ নেওয়ার কথা থাকলেও সবই এখনো পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। ( সূত্র: দেশ রুপান্তর)
নতুন কোভিড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথায় মনেপড়ে গেল মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় গত বছর একটি হাসপাতাল বানানো হয়েছিল করোনা মহামারি মোকাবিলার জন্যে। সেটি নাকি এখন ধুলাবালির আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে। টিভিতে দেখলাম সরকার তড়িঘড়ি করে, নতুন বাজেটে সেই মার্কেটেরই পঞ্চম তলায় আরেকটি হাসপাতাল বানাচ্ছে একই উদ্দেশ্যে। করোনাতো দেশ থেকে কখনোই চলে যায়নি, তাহলে এর জন্য নির্মিত হাসপাতালগুলোর এই দুর্দশা কেন হলো? করোনা মোকাবেলায় শুধু অর্থ ব্যয় করাটাই কি তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য, চিকিৎসা নয়?
প্রতিদিন কাতারে কাতারে রোগী মারা যাওয়ার পরও সরকারের সব উদ্যোগ কেন এখনো পরিকল্পনা পর্যায়ে আটকে আছে, এ বোঝা আমাদের মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এদিকে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আগে যেখানে ১০- ২০ ভাগ রোগীর অক্সিজেন লাগতো, এখন তা শতকরা ৮০-৯০ এ এসে পৌঁছেছে। সরকারি কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেড় মাসে রোগী বেড়েছে ৩০০ শতাংশ, শয্যা বেড়েছে ৪ শতাংশ, তাহলেই বোঝা যাচ্ছে করোনা মোকাবেলার বা সক্ষমতা বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগ কী গতিতে এগুচ্ছে।
পত্রিকার রিপোর্টে দেখছি অনেক কোভিড রোগী হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌঁড়াচ্ছেন খালি বেড পাচ্ছেন না বলে। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাও তাই বলছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে সারাদেশে কোভিড হাসপাতালগুলোতে এখনো প্রায় অর্ধেক শয্যা খালি পড়ে আছে !! তাহলে আমরা কাকে বিশ্বাস করবো? আমাদের অভিজ্ঞতা, গণমাধ্যমের রিপোর্ট নাকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যকে? তথ্যের মধ্যে এই ফাঁকটা কেন?
বিশ্বের সেরা সেই হাসপাতাল তৈরির কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। সেদিন ৭১ চ্যানেলে সংবাদটি না দেখলে মনেই করতে পারতাম না এই অর্জনের কথা। ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই দুই হাজার শয্যার যে হাসপাতালটি বানিয়েছিল স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সেই হাসপাতালটি হঠাৎ আলাদ্দীনের দৈত্য এসে তুলে নিয়ে গেছে।
করোনা মহামারি মোকাবেলার জন্যে বসুন্ধরায় এই আইসোলেশন হাসপাতালটি বানানোর সময় বলা হয়েছিল, পৃথিবীর আর কেউ এত অল্প সময়ে এত বড় হাসপাতাল বানাতে পারেনি। অথচ আজ যখন করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা এসে আমাদের অবস্থা আবার নাস্তানাবুদ হতে চলেছে, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানালেন, বানানোর ছয় মাস পর্যন্ত দুই হাজার শয্যার হাসপাতালে একজনও রোগী ছিল না। তাই তারা এটি তুলে ফেলেছেন।
একটা হাসপাতাল কি তাঁবুর মতো কিছু, যে মন চাইলো তাঁবু গাড়লাম, আবার উঠিয়ে নিলাম। গতবছরও রোগীরা সরকারি হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে পথে পথে ঘুরেছেন তাহলে এখানে কেন রোগী এলো না? করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যে আসতে পারে, তাও আমরা ভাবিনি। একেই বলে চরম অদূরদর্শিতা এবং দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা।
প্রথম দফার মহামারি আসার পরই বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের স্বাস্থ্যখাত কতোটা অযোগ্য এবং দুর্নীতিপরায়ণ। করোনা বিষয়ক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢাকা শহর কেন্দ্রিক এবং এইখাতে প্রশাসনিক দুর্বলতাও চূড়ান্ত। কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ এলে বা অভিযোগ প্রমাণিত হলে, তাকে শুধু বদলি করা হয় বা ওএসডি করা হয়। বড়জোর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কাজের কাজ কিছুই হয়না। এই অবস্থার ন্যূনতম কোনো উন্নতি হয়নি এবছরও।
কেন হয়নি, এই প্রশ্নের সবচেয়ে সহজ উত্তর হলো, আমরা ভেবেছিলাম করোনা চলে গেছে। আর ফিরে আসবেনা। আল্লাহ আমাদের সাথে আছে, তাই বাংলাদেশ রক্ষা পেয়ে গেছে এত দুর্নীতি ও দুর্বলতা থাকা সত্বেও। আর তাই করোনা চিকিৎসার কোন পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা করিনি। বিশ্বের আরো অনেক দেশে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ এসে লেগেছে কিন্তু আমরা সেদিকে তাকাইনি। আর তাকাইনি বলেই আজকে আবার মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, মারা যাচ্ছে।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন