কেমন হবে আগামীর স্মৃতিস্তম্ভ?
একটা সমাজের মূল্যবোধ ও আত্মপরিচয়ের বার্তা ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রাখে স্মৃতিস্তম্ভ। মিসর, গ্রেট জিম্বাবুয়ে, গ্রিস, রোম-সহ প্রাচীন বহু সংস্কৃতি সম্পর্কে আমরা বেশিরভাগই জানতে পারি পাবলিক মনুমেন্ট বা উন্মুক্ত স্মৃতিস্তম্ভগুলো থেকে। তাই আমাদের সম্পর্কেও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী বার্তা পাবে, সেটি আমরা যেসব স্মৃতিস্তম্ভ গড়ছি ও রক্ষা করে চলেছি, তার ওপর অনেকটা নির্ভর করছে। এ নিয়ে আমাদের তাই ভাবা উচিত।
পাবলিক স্পেসে এর জন্য খুব বেশি জায়গা নেই। বাইরে আমরা যত ইমেজ ও অবজেক্ট দেখি, সেগুলোর বেশিরভাগই বিজ্ঞাপন।
আমি যে দুটি পাবলিক স্কাল্পচার সৃষ্টি করেছি, তার একটির নাম 'ইউনিটি'; আকাশ পানে বাড়িয়ে রাখা একটি বাহুর ভাস্কর্য। নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিন ব্রিজের গোড়ায় এটি বসানো। আমার আরেকটি ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে, 'দ্য এমব্রেস'। বোস্টনের এই ভাস্কর্য মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ও কোরেটা স্কট কিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমাদের সবারই ব্যক্তিত্বকে মূর্ত করে তোলার এক অবিশ্বাস্যরকমের সার্বজনীন ইঙ্গিত রয়েছে এই ভাস্কর্যে।
'ইউনিটি'র বেলায় আমার স্টুডিও ও আমি জোয়েল এমবিদ নামে এক আফ্রিকান অভিবাসী অ্যাথলেটের বাহুর স্ক্যান করে নিয়েছিলাম। আকাশের পানে বাড়িয়ে রাখা সাড়ে ২২ ফুট দীর্ঘ ব্রোঞ্জের সেই বাহু কাব্য ও শক্তি ধারণ করে রয়েছে। এটি এ শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ 'দ্য স্ট্যাচু অব লিবার্টি'রই এক অনুরণন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর তাৎপর্য আরও গভীর হয়ে ওঠার আশা করছি আমি।
স্মৃতিস্তম্ভগুলো মূলত এমন এক স্থানে পরিণত হয়, যেটিকে ঘিরে জড়ো হয় ও সময় কাটায় মানুষ। আমার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের বেশিরভাগ উন্মুক্ত স্মৃতিস্তম্ভই আমাদের জড়ো হওয়ার সেরা জায়গা। ওয়াশিংটন ডিসিতে যখন আমি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র, মনে পড়ে, একদিন সকালে লিংকন মেমোরিয়ালের ভেতর হেঁটে বেরিয়েছিলাম। নিউইয়র্ক শহরেও বেড়ে উঠেছি আমি। 'দ্য কিউব' নামে পরিচিত ভাস্কর্য 'আলামো'র কাছে আমি ও আমার বন্ধুরা জড়ো হতাম; ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগে অ্যাস্টোর প্লেসে স্থাপিত হওয়ার পর থেকে মানুষের সমবেত হওয়ার এক দারুণ জায়গায় পরিণত হয়েছে এটি।
বিশেষ করে, সুইডিশ-আমেরিকান শিল্পী ক্লায়েস ওলডেনবার্গের ভাস্কর্যগুলোর আমি মুগ্ধ দর্শক; বাগানে ব্যবহৃত কোদাল কিংবা ব্যাডমিন্টন বার্ডি- যেকোনো প্রাত্যহিক অনুষঙ্গই তিনি দারুণভাবে তার কাজে ব্যবহার করে স্মৃতিস্তম্ভে জায়গা দিতে জানতেন। আমার মায়ের জন্মস্থান ফিলাডেলফিয়ায় তার বানানো একটি অতিকায় ক্লথপিনের ভাস্কর্য রয়েছে, সিটি হলের ঠিক বাইরে। তবে তার ভাস্কর্যের মধ্যে ওয়েস্টার্ন, আমেরিকান মধ্যবিত্তীয় আইকোনোগ্রাফির প্রবণতা রয়েছে।
আফ্রো-পিক 'অল পাওয়ার টু অল পিপল'-এর প্রথম যখন ডিজাইন করার সময় বিশেষত আফ্রিকান-আমেরিকানদের কথা বলে, এটিকে এমন এক অবজেক্ট করে তুলতে চেয়েছিলাম আমি। ২০১৭ সালে ফিলাডেলফিয়ায় ৯ সপ্তাহ ধরে প্রদর্শিত হয়েছিল সেটির; ব্ল্যাক কমিউনিটি সব সময়ই সেটি দেখতে ভীড় করত; তবে সেই অবজেক্ট তারা বলতে গেলে ধরতেই পারেননি, তাই এ নিয়ে কোনো সাধুবাদও পাইনি তাদের কাছ থেকে। এটি একতা, গর্ব ও আত্ম-যত্নের এক প্রতীক।
আমার ভাস্কর্যটি ছিল ফিনাডেলফিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত ভাস্কর্যগুলোর একটি, সাবেক পক্ষপাতদুষ্ট মেয়র ও পুলিশ কমিশনার ফ্র্যাংক রিজ্জোর ভাস্কর্যের মাত্র কয়েক ফুট দূরে। ২২ বছর পর, সম্প্রতি রিজ্জোর সেই ভাস্কর্য ('ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার') আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ব্ল্যাক কমিউনিটিকে হত্যার বদলে বরং উদযাপনের ইঙ্গিত নিয়ে, রিজ্জোর প্রতিমূর্তির একটি বিকল্প হিসেবে 'অল পাওয়ার টু অল পিপল' আমি সৃষ্টি করেছিলাম।
ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে কনফেডারেট নেতা জেফারসন ডেভিসের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা, যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রান্তে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাস্কর্যের মাথা কেটে টেনে-হিচড়ে নামানো, যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টলে ক্রীতদাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কলস্টোনের ভাস্কর্য পানিতে ফেলে দেওয়া- দুনিয়াজুড়ে স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার ছবি যখন আমরা দেখছি, খেয়াল করবেন, গণমানুষই এই সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে ও কার্যকর করছে। বার্লিন দেয়ালের ক্ষেত্রেও এমনটাই দেখেছি আমরা: অনেক সহ্যের পর আমজনতাই ভেঙে ফেলেছে। আমার ধারণা, ক্রোধ ও হতাশা নিংড়ে দেওয়ার জন্য একটা জায়গা থাকা চাই; তবে সামনের দিকে তাকিয়ে, যুক্তিসঙ্গত পুনর্বিবেচনাও সত্যিকার অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের দিনে কী আমাদের পরিচয়? ২০০ বছরের আগের তুলনায় আজকের দিনে আমাদের মূল্য কী? যে ভাস্কর্য আমরা ভেঙে ফেলছি (যেমন ধরুন- বুডাপেস্টে কমিউনিস্ট যুগের ভাস্কর্যগুলোকে সরিয়ে রাখার জন্য একটি পার্ক রয়েছে), শুধু সেটি নিয়েই ভাবলে আমাদের চলবে না; বরং আমরা যেসব নতুন ভাস্কর্য দাঁড় করাচ্ছি, সেগুলোর 'আয়ু' নিয়েও ভাবতে হবে। আমাদের পাবলিক স্পেস সীমিত; ম্যানহাটনের কলম্বাস সার্কেলের মতো এলাকাগুলোকে নিয়ে বোধহয় নতুন করে ভাবা যায়। ব্রিস্টলের কলস্টোনের ভাস্কর্যটি এক শতকেরও বেশিকাল দাঁড়িয়ে ছিল। যথেষ্টই আয়ু পেয়েছে সেটি। এরপর ওই অঞ্চলে আরও কোটি কোটি মানুষ জন্মেছেন; ওই স্কয়ারে তাদের কারও ভাস্কর্য হতেই পারত। ভাস্কর্যের আয়ু চিরকালীন- এ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার বোধহয় সময় হয়েছে।
যেসব স্মৃতিস্তম্ভ টিকে রয়েছে, সেগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবারও সময় হয়েছে। আমার সাবেক শিক্ষক, অধ্যাপক রবিন ডিজি কেলি একবার আমাকে বলেছিলেন, আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় উত্তরাঞ্চল বিজয়ী হয়েছে ঠিকই, তবে ন্যারেটিভ যুদ্ধে বিজয় হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের। কনফেডারেসি বা জোটশক্তি টিকে ছিল মাত্র চার বছর; অথচ তার পর এক শতকের বেশি সময় কেটে গেলেও, ইউনিয়নের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাকারী লোকগুলোর গুণকীর্তনের ভাস্কর্যগুলো এখনো টিকে রয়েছে। আমার বিশ্বাস, এই যে যুদ্ধের ১৫৫ বছর পর এখন ভাস্কর্যগুলো উপড়ে ফেলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে যুদ্ধটির একটি উপসংহারে পৌঁছতে পারব আমরা।
উন্মুক্ত স্মৃতিস্তম্ভের এখন ব্যাপক দাপট। কোনো এক ব্যক্তিমানুষ কিংবা একদল মানুষের গুণকীর্তন করতে এগুলো সক্ষম ঠিকই, কিন্তু একটি স্মৃতিস্তম্ভের পক্ষে কীভাবে দুনিয়ার বাকি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও এতে ধারণ করা মানুষগুলোর প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব, এ নিয়ে আরও বড় পরিসরে ভাবার দায়ও রয়েছে।
এ কথাও মনে রাখা দরকার, আমরা যা ভুলে যাওয়াই শ্রেয় বলে বেছে নিচ্ছি, তারই মতো যেগুলো রেখে দেওয়ার পক্ষে, সেগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ হবে- তা জরুরি নয়। ইতিহাসের অতলে অনেক মানুষ তলিয়ে গেছেন; কেননা, তাদের তেমন জনসংযোগ কিংবা বলার মতো সহজ আখ্যান ছিল না। ব্যাপক মাত্রায় গুণকীর্তন, সোজাসাপ্টা ন্যারেটিভের বদলে আমাদের বরং বিশেষ মুহূর্তগুলোর কমপ্লেক্সিটি প্রয়োগ করা দরকার। এই একবিংশ শতকে, তথ্য পাওয়ার এক অবিশ্বাস্য সহজ রাস্তা যখন আমাদের সামনে খোলা, তখন দায়িত্ব হলো, ইতিহাসকে কোনো সুনির্দিষ্ট একরৈখিক তরিকায় জাহির না করা; কেননা, অতীত থেকে আমরা এটির অতিসূক্ষ্ম তারতম্যের প্রাচুর্য নিতে সক্ষম।
- লেখক: আমেরিকান ভাস্কর
সূত্র: সিএনএন
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ