কোভিড-১৯ ও বিউটি অ্যান্ড গ্রুমিং ইন্ডাস্ট্রি
আমি মনে করি কোভিড-১৯-এ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিউটি অ্যান্ড গ্রুমিং ইন্ডাস্ট্রি। আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রির কাজটি সরাসরি স্পর্শের সঙ্গে জড়িত। সেখানে, কোভিড-১৯ সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব রাখার কথা বলছে। সেক্ষেত্রে আমরা চাইলে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে সার্ভিস চালিয়ে যেতে পারতাম বা পারব। তবে সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা চার মাসেরও অধিক সময় এই সেক্টর বন্ধ রেখেছি।
এখন দেখতে পাচ্ছি, করোনাভাইরাসকে ভয় করে লাভ নেই; জয় যেহেতু করতে হবে, সেহেতু আমরা আবার সিদ্ধান্ত নিয়ে এ মাস থেকে আমাদের সার্ভিস সেন্টার বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে শুরু করেছি। সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে, এবার আমরা স্বল্প পরিসরে, স্বল্প সেবা নিয়ে আসছি।
করোনাভাইরাসের ছোবলে ইতোমধ্যেই আমাদের সেক্টরের শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি মানুষ ব্যবসা হারিয়েছেন, কাজ হারিয়েছেন। এই সেক্টরে ১০ লাখ মানুষ কাজে জড়িত। এতগুলো মানুষের মধ্যে ৬০ শতাংশ যদি কাজ হারায়, তাহলে সেটি দেশের জন্য একটা বড় ধরনের ক্ষতি বলে আমি মনে করি। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে ১০ বছর লেগে যাবে বলে আমার ধারণা।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যেহেতু আমি শুধু একজন বিউটি-আর্টিস্ট হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছি না, একটি সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজও চালাচ্ছি। 'উজ্জ্বলা লিমিটেড'। এটি সারা দেশে বিউটি অ্যান্ড গ্রুমিং সেক্টরে উইমেন ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছে। এতদিনের পথ চলায় সগর্বে নিজের একটি জায়গা করতে পেরেছে।
'উজ্জ্বলা' যখন পথ চলছিল, তখন দেখেছি, মেয়েরা এই জায়গাটিতে শেখার জন্য আসছে বা আসতে চায়। সাধারণত সেই মেয়েরই আগ্রহ বেশি, যার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। আবার সেই মেয়েও আসতে চায়, যার ভীষণ ভালোবাসা আছে কাজটির প্রতি; সেই আগ্রহের জায়গা থেকে তাকে কেউ চাইলেও সরাতে পারবে না।
যেহেতু দুই ধরনের মানুষের ইচ্ছে বেশি এ সেক্টরে কাজ করার, তাই জোর করে কেউ তাদের এ কাজ বন্ধ করাতে পারবে না। তাই কোভিড-১৯ সামগ্রিকভাবে আমাদের বড় ধরনের বিপদে ফেলে দিলো। অবশ্য আমার ধারণা, এটা থেকে হয়তো আমরা বের হয়ে আসতে পারব; তবে কবে সেটা- তা বলা মুশকিল।
বর্তমান পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনকভাবে চলছে। আমরা সরকারের কাছ থেকে শুধু একটি গাইডলাইন পেয়েছি। সেটি মাথায় রেখে, সচেতনতা নিশ্চিত করে, সরকারি গাইডলাইনের ১৬টি পয়েন্টের সঙ্গে আরো ১২টি পয়েন্ট যোগ করে, সেগুলো মেনে কাজে নেমেছি।
আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি ভালোভাবে আবারও এই সেক্টরের কাজ শুরু করে দেওয়ার। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সবাই খোলার প্রস্তুতি নিয়েছি। যে যার জায়গা থেকে, যখন আত্মবিশ্বাস এসেছে, 'আমি খুলতে পারি, আমি প্রস্তুত সেবা দেওয়ার জন্য', তখনই খুলছি। তবে আমরা এখনো সন্দিহান, খোলার পর আদৌ গ্রাহক পাব কি না, গ্রাহক আসবেন কি না; কেননা, খোলা রাখলে যে দৈনন্দিন খরচ চলবে, গ্রাহক না পেলে বিপদে পড়ে যাব।
উত্তরণের উপায় যদি বলতে চাই, যেখানে উপায় একটাই, সচেতনতা। এখানে যদি শুধু আমরা সচেতন হই, গ্রাহক না হন, তাহলে হবে না। আবার গ্রাহক সচেতন, আমরা নই, তাহলেও হবে না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা কোনো একটা জায়গায় স্ট্রিক্ট থাকতে পারছি না। যেমন ধরুন, আমরা সবাই যদি প্রমিজ করে ফেলি, থ্রি লেয়ার মাস্কটা পরবই পরব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধু মাস্কটা মেইনটেইন করব; বাংলাদেশে যত মানুষ আছি আমরা, যদি শুধু মাস্কটাই নিয়ম মেনে পরি, তাহলেও কিন্তু সংক্রমণের হার কমে যাবে।
আরেকটি হলো, দূরত্ব বজায় রাখা। আমরা দেখতে পাই, আমি দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালেও আমার পাশে যিনি এসে দাঁড়াচ্ছেন, তিনি তা করছেন না; তাহলে সমস্যা।
স্বপ্ন দেখতে আমি খুব ভালোবাসি। সব সময় কোনো না কোনো একটি নতুন স্বপ্ন আমার ঝুড়িতে যুক্ত হয়। আমি মূলত একবার যে স্বপ্ন দেখে ফেলি, সেটি আজ হোক, বা ৫ বছর পরে হোক, পূরণ করি। অবচেতনে সেই স্বপ্নকে বয়ে নিয়ে যাই আমি। জোর দেই না, হয়ে যায় কীভাবে যেন! তাই আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি স্বপ্ন দেখে, সেটি সত্য করা সম্ভব হবেই।
সেক্ষেত্রে, আমার স্বপ্ন কখনোই একা বেড়ে ওঠা ঘিরে ছিল না। আমি ভালো থাকব, কিন্তু সবাইকে নিয়েই। সেটা পরিবার ও কাজের জায়গায়ও। সব সহকর্মীকে নিয়ে আমি আবার কাজের জায়গায় আগের মতো উচ্ছলতা নিয়ে, আনন্দ নিয়ে ফিরে আসতে চাই; স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই। তাহলে এই সেক্টর আরও অনেক বড়, অনেক গোছানো, অনেক সুন্দর হবে।
আমরা যারা কাজ হারিয়েছি, আবার কাজে ফিরতে পারব। হতে পারে, যিনি উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে তার কাজটি চলে গেছে। হতে পারে তিনি আরেকজনের প্রতিষ্ঠানে কাজ দিয়েই না হয় শুরু করবেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের জায়গা শক্ত করে আবার গুছিয়ে নিয়ে আসবেন। আবার তিনি ফিরে যেতে পারবেন উদ্যোক্তার ভূমিকায়।
আমি চাই, বাংলাদেশের কোনো মেয়ে বেকারত্বে ভুগবে না। ঘরে ঘরে একজন করে নারী উদ্যোক্তা থাকবে। তারা উপার্জন করবে এবং আত্মসম্মানের সঙ্গে পরিবারে কন্ট্রিবিউট করতে পারবে। কেননা, যখন মেয়েরা নিজেদের পরিবারে কন্ট্রিবিউট করতে পারবে, তখন ওই পরিবারে সুখ শান্তি বজায় করে।
- লেখক: বিউটি এক্সপার্ট; উদ্যোক্তা; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উজ্জ্বলা লিমিটেড