কোরবানি ঈদ বিষয়ক রম্য কড়চা
নেহারি
প্রতিবেশি একটি পরিবারে ছেলেমেয়ে ১১ জন ও বাবা মাসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৩ জন। সাথে দুই জামাই ও নাতিসহ ১৬ জন। সারা বছর ওদের বাসায় হল্লা লেগেই থাকত। বিশেষ করে ঈদের সময় এতগুলো মানুষ এবং ওদের আরও আত্মীয় স্বজন যখন একসাথে কথা বলত, হইচই করত, তখন আশেপাশের আরও দু'চারটা বিল্ডিং থেকে সবাই সেই হট্টগোল শুনতে পেত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই বাসার সব মানুষ সাধারণত সমস্বরে কুমিল্লার ভাষায় কথা বলত। মানে সবাই একসাথে কথা বলত; কেউ কারও কথা শুনত না।
বেশি লোকসংখ্যার কারণে সাধারণত ওরা একটা আস্ত গরু কোরবানি দিত। কোরবানির দিন ভাগ বাটোয়ারা শেষে ওদের বাসায় বড় হাড়িতে করে গরুর পায়া বসানো হতো নেহারি বানানোর জন্য। তখন আমাদের জীবনে গ্যাস আসেনি বলে আমরা কেরোসিনের চুলায় রান্না করতাম।
তো, সেই বাসায় বিশাল এক হাড়িতে করে কেরোসিনের চুলায় নেহারি বসানো হয়েছিল। কলোনির ছোট রান্নাঘরে ২ জন মানুষ ঢুকলেই চাপাচাপি হতো, সেখানে ওরা প্রায় ৪/৫ ঢুকে গিয়েছিল ঈদ উন্মাদনায়। কেউ নেহারির জন্য পরোটা বানাচ্ছেন, কেউ ভাজছেন, কেউ গরুর ভুনা করছেন, কেউবা শুধু উৎসাহই দিয়ে যাচ্ছেন। একসাথে তিনখানা কেরোসিনের চুলায় রান্না চলছে।
রাত প্রায় ৮/৯ টার দিকে ঐ ফ্ল্যাট থেকে মহা শোরগোল উঠল 'আগুন আগুন' বলে। সবাই দৌঁড়ে গেলাম। ঘরময় ধোঁয়া আর ছুটাছুটি, ১১ ভাইবোন শুধু তাদের নাম ধরে চিৎকার চেঁচামেঁচি করছে। সাথে আমরা পাড়া প্রতিবেশি, সে এক ধুন্ধুমার অবস্থা। আমাদের বিল্ডিংটার সামনেই আসাদগেট ফায়ার সার্ভিস, বারান্দা থেকে ডাকতেই ওরা শুনতে পেল। সাইরেন বাজিয়ে ফায়ার ব্রিগেড এসে হাজির।
এত মানুষ জড়ো হয়েছে যে, ফায়ার ব্রিগেডের লোক ঢুকতেই পারছিল না। শেষে যখন ঢুকল, দেখল সব নেহারি রান্নাঘর জুড়ে ছড়ানো, ভাজা পরোটা তার উপরে ভাসছে, আর গরুর কষানো মাংস চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু কোথাও আগুন জ্বলছে না, শুধু ধোঁয়া উঠছে। এর মানে হচ্ছে নেহারির হাড়িটা উল্টো পড়তেই কোনোকিছু লক্ষ্য না করেই 'আগুন আগুন' করে চিৎকার শুরু করেছে রান্নাঘরে থাকা লোকজন। সবার দৌড়াদৌঁড়িতে বাকি হাড়িগুলোও উল্টে পড়েছে। কেউ আর তা দেখার প্রয়োজন বোধ না করেই হৈচৈ শুরু করে দিয়েছিল।
সে যাত্রায় আগুন না লাগলেও ওদের আর নেহারি খাওয়া হয়নি। এই কাহিনির সময়টা ছিল ১৯৮০ সাল।
গরুর ব্যবসা
সাদেক এবং তার কয়েক বন্ধু মিলে চাকরির পাশাপাশি শুরু করেছিল গরুর ব্যবসা। ২০১৮ সালে কোরবানির ঈদে তারা কমলাপুর গরুর হাটের ভিআইপি গ্যালারিতে, মানে ছাউনির নিচে স্টল পেয়েছিল। ভিআইপি গ্যালারির আরও সুবিধা ছিল যে, সেখানে বসবার ৫টি চেয়ারও ছিল।
ঈদের আগের দিন বিকেল নাগাদ বিক্রির জন্য তাদের আর একটিমাত্র গরু বাকি ছিল। পরদিন ঈদ বলে সাপোর্ট স্টাফরাও বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। ওরা খেয়াল করল, দুপুর থেকেই একজন বয়স্ক মানুষ ২/৩ বার ঘুরেঘুরে এসে ওদের শেষ গরুটি কেনার জন্য দরদাম করেছেন। ৭০/৭৫ বছরের ঐ বৃদ্ধের পরনে সাদা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি, ধবধবে সাদা চুল-দাঁড়ি, বেশ নূরানী চেহারা। দামে বনিবনা হচ্ছিল না বলে লোকটি বারবার আসা-যাওয়া করছিলেন।
বিকেলে উনি আবার এলেন। ওরা ওনার কথা মতো ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দামের গরুটি এক লাখে দিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। কারণ প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, ওরাও আর বসে থাকতে চাইছিল না। যাক, বুড়া চাচা এক লাখ টাকায় গরুটি কিনতে রাজি হলেও, শেষ অব্দি উনি ৯৯ হাজার টাকা দিলেন। কিছুতেই তার পকেট থেকে পুরো এক লাখ বের করা গেল না।
গরুটি কেনার পর চাচা ওদের পাশেই একটি চেয়ারে বসলেন। আর গরুটিকে সেখানেই বেঁধে রাখলেন। ওরা দেখল চাচা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন। ১০ মিনিটের মধ্যে দু'জন এলো, আর চাচা ওদের কাছে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় ঐ গরুটিই বিক্রি করে দিলেন। এই ঘটনা দেখে সকলের ভিরমি খাওয়ার দশা। একি! বুড়ো চাচা ওদের কাছ থেকে গরুটি ৯৯ হাজার টাকায় কিনে, ওদেরই পাশে বসে সেটাই ২৬ হাজার টাকা লাভে বিক্রি করে দিলেন। কী তামশা, কী কেরামতি! নূরানী বুড়ো ওদের মতো ৬/৭ জন উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদস্থ চাকুরিরত যুবককে ঘোল খাইয়ে দিল।
প্রায় হতভম্ব অবস্থায় চাচা মিয়াকে সালাম করতে চাইলে, চাচা বলে উঠলেন, 'বাবারা সালাম করন লাগব না। আমি তোমাদের বুদ্ধির বই পড়তে দিমু। ব্যবসার জন্য বুদ্ধি লাগে।' এ কথা বলে হাসতে হাসতে পগাড় পার হয়ে গেলেন।
স্কুল ছুটি
লালমাটিয়া এলাকায় একটা অনেক বড় স্কুল আছে। কিন্তু আজ থেকে ৪৫ বছর আগে এই বিশাল স্কুলটি ছিল ছোটখাট টিনশেডের একটি স্কুল। ছাত্ররা যখন তখন ক্লাসে ঢোকার ও বের হওয়ার অপার স্বাধীনতা ভোগ করত। কিন্তু এরপরেও সকাল থেকে বিকেল ক্লাস চলত। একদিন আমার ফুপাতো ভাই গিয়াস, যে ঐ স্কুলেরই ছাত্র ছিল, দেখলাম দুপুরের মধ্যে বাসায় ফিরে এসেছে।
বাসায় জিজ্ঞাসা করা হলো, ব্যাপার কী? স্কুল কি ছুটি দিয়ে দিয়েছে? গিয়াস ভাই জানাল, তাদের হেড স্যার কোরবানির গরু কিনে আনার পর হারিয়ে গেছে, তাই স্কুল ছুটি দেওয়া হয়েছে, যেন ছাত্ররা গরুটা খুঁজে বের করতে পারে। ওরা সকাল থেকেই খুঁজেছে; কিন্তু গরুর দেখা মেলেনি। এই কথা শুনে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল, স্যারের কোরবানির গরু খোঁজার জন্য স্কুল ছুটি!
ফ্রম হাট টু হাসপাতাল
আমাদের দূরবর্তী পরিবারে এক বোনজামাই আছেন, যিনি প্রায় রামগরুড়ের ছানা টাইপ মানুষ, মানে গম্ভীরমুখো। কোনোরকম ঠাট্টা ইয়ার্কি, ফাইজলামি উনি পছন্দ করেন না। ওনার সামনে ভদ্রতা সহকারে হাটুঁভাজ করে বসে থাকতে হয়। এইসব কারণে পারতপক্ষে তার সাথে কেউ কথাও বলতে চায় না, গল্পগুজব করার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।
প্রতি ঈদেই উনি হাটে যাওয়ার জন্য সবাইকে পীড়াপীড়ি করলেও ওনার সাথে কেউ কোরবানির হাটে যেতে চায় না। সেই আহসান দুলাভাই গেলেন হাটে গরু কিনতে, সাথে এক স্যাঙ্গাতকে নিয়ে। গরুর গলা, মাথা, পা সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন, হঠাৎ এক বেয়াদব গরু আহসান দুলাভাইকে পা দিয়ে আৎকা এমন আঘাত করল যে, উনি হাটে ধরাশায়ী হয়ে গেলেন। এরপর পা ভেঙে হাট থেকে সোজা হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। অতঃপর সেবারে আহসান ভাইদের পরিবারের ঈদ মাথায় উঠেছিল।
তোতন
স্কুলে পড়ার সময় আব্বা ঈদের প্রায় সপ্তাহখানেক আগে একখানা চমৎকার ছাগল নিয়ে এলো কোরবানির নিমিত্তে। আমরা বেজায় খুশি। কিছুদিন ওকে নিয়ে কলোনির মাঠে ঘুরলাম, ঘাস খাওয়ালাম। ক্রমশ মনে হলো ছাগলটি আমাদের কথা বুঝতে পারছে। ওর নাম দিলাম তোতন। কেমন যেন পোষা হয়ে গেল।
এদিকে কোরবানির সময় যতোই ঘনিয়ে আসতে থাকল, ততই আমার মন খারাপ হতে থাকল। শুনেছি সব বাচ্চাদেরই এটা হয়। বাচ্চারা তো এত ব্যাখ্যা বোঝে না। গরু বা খাসিটি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক ধরনের মায়া জন্মে যায়। আমারও তেমনটিই হয়েছিল।
হঠাৎ ঈদের আগের রাতে কে যেন এসে কলোনির বিল্ডিংয়ের নিচে বেধে রাখা ছাগলটা চুরি করে নিয়ে গেল। বাসায় এই চুরি নিয়ে তোলপাড়। কিন্তু তখন মনখারাপ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। আব্বা শুধু বলল, নিয়তেই বরকত। আমরা নিয়ত করেছিলাম, কাজেই কোরবানি হয়ে গেছে।
আমি অবশ্য মনে মনে খুশিই হলাম যে, চোখের সামনে তোতনকে মারা যেতে দেখব না। মনে মনে ভাবলাম, যে নিয়েছে, সে যেন তোতনকে পালে, তোতনকে আদর করে।
এক হালি খাসি
প্রায় ২৫/২৬ বছর আগের গল্প। এক পরিবারে ঈদের আগের দিন রাতে সিদ্ধান্ত হলো গরুর ভাগের সাথে একটা খাসি দিলে কেমন হয়। বাড়ির সবচেয়ে হিসাব জানা ছেলেকে দায়িত্ব দেওয়া হলো একটা জুৎসই খাসি কিনে আনতে। অনেক রাত অব্দি ঘোরাফেরা ও দামদর করে সেই ছেলে যখন ফিরে এলো, তখন তার হাতে বান্ধা একটি নয়, চারটি খাসির দড়ি।
রাতের অন্ধকারে সেই ছায়ামূর্তি গেটের ভেতরে প্রবেশ করার পর দেখা গেল তার হাতে ধরা চারটি খাসি। তবে সমস্যা হলো একটাই, খাসি চারটি এতটাই দুবলা যে সব খাসির মাংস যোগ করলেও ৭/৮ কেজি হবে কি না সন্দেহ।
যখন পরিবারের অন্যান্যরা এটা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করল, তখন সেই ভাই জানালেন, রাস্তার আলোতে খাসির সাইজ উনি বুঝতে পারেন নাই, তাই এই বিপর্যয়। উনি ভেবেছিলেন জিতেছেন ১টার টাকায় ৪টা খাসি পেয়ে। অগত্যা কোরবানি বাদ দিয়ে খাসিগুলো পালার জন্য অন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেদিনের পর থেকে পরিবারের সেই হিসাব জানা ছেলেকে কখনো গরু বা খাসি কিনতে দেওয়া হয়নি।
১৭ জুলাই, ২০২১
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন