গর্ভধারণ এবং কোভিড-১৯ প্রসঙ্গ
৮ এপ্রিল। রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। আমি কোভিড ইউনিটে মর্নিং ডিউটি করছিলাম। হঠাৎ নার্স এসে খবর দিলো আইসিইউতে একজন পেশেন্টের খুব খারাপ অবস্থা। আমি যেয়ে দেখলাম, মোছাঃ আয়েশা আক্তার (ছদ্মনাম), বয়স ২৮ বছর, কোভিড আক্রান্ত এবং সিজারিয়ান সেকশন হয়েছে ৮ দিন, একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং সঙ্গে আরও দুই মেয়ে রয়েছে, ওনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ক্রমাগত নেমে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি মারা গেলেন তিনটি বাচ্চা রেখে। আমাদের কিছুই করার ছিল না।
ওনার মতো অসংখ্য গর্ভবতী মা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন এবং গর্ভকালীন সময়ে অথবা ডেলিভারির পরে মারা যাচ্ছেন। করোনায় আমরা আগে এরকম দেখিনি। ডেল্টা ভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যু হার বেড়ে গেছে। কিন্তু গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে এর আগে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতেও তেমন ট্রায়াল বা কোনো স্ট্যাটিস্টিক্স করা হয়নি।
মহামারি শুরুর পর স্বনামধন্য জার্নাল 'দ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন' (JAMA) ভারতসহ বিশ্বের ১৮টি দেশের ২১০০ জন গর্ভবতী নারীর উপর গবেষণা করে দেখেছেন, করোনায় গর্ভবতী মায়েরা উচ্চ মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন। এই মৃত্যুঝুঁকি যারা গর্ভধারণ করেননি তাদের চেয়ে ৭০% বেশি। সেই সঙ্গে গর্ভধারণের ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারে, অ্যাবোরশনসহ আরও নানা জটিলতা এই ভাইরাসের কারণেই দেখা যেতে পারে।
এই সময় যারা ফ্রন্টলাইনার্স এবং বাসায় প্রেগন্যান্ট মা রয়েছেন এবং বাচ্চার জন্ম দিচ্ছেন, তাদের অতিরিক্ত যত্নের দরকার আছে। কারণ তারা উচ্চ মৃত্যুঝুঁকিতে চরম উদ্বেগ এবং ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
প্রথমে 'আর্লি প্রাইমারি স্টাডি ইন চায়না অ্যান্ড সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) জানিয়েছিল, গর্ভবতী মায়েরা কোভিড-১৯ রিস্কের বাইরে। কিন্তু ডেল্টা ভাইরাস সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছে এবং আমাদের গর্ভবতী মায়েরা ব্যপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন।
তবে এটা এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে জানা যায়নি যে, মায়ের গর্ভে অথবা জন্মের পরে অথবা বুকের দুধ খাওয়ানোকালীন সময়ে ভাইরাল ট্রান্সমিশন মায়ের থেকে বাচ্চার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কতটুকু।
গর্ভবতী মায়েদের ব্যাপারে জন হপকিন্সের ম্যাটারনাল ফিটাল এক্সপার্ট ডা. শেফিল্ড বলেন, গর্ভবতী মায়েদের নিরাপদ সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, ভিড় এড়িয়ে চলা, মাস্ক পরা, যথাসম্ভব বাসায় অবস্থান করা এবং হাসপাতালে ভর্তির সময়ে স্ক্রিনিং টেস্ট করা বিশেষত যাদের জ্বর, কাশি, গলাব্যাথার মতো কোভিডের উপসর্গ আছে তাদের জন্য অত্যাবশকীয়।
এই মুহূর্তে বিশ্বে ৪১টি দেশ গর্ভবতী মায়েদের কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়ার বিপক্ষে এবং ৪৫টি দেশ ভ্যাকসিন নেয়ার অনুমতি দিয়েছে। এক্ষেত্রে এমআরএনএ ভ্যাকসিন (ফাইজার, মডার্না) নেওয়া যেতে পারে।
গর্ভবতী মায়েরা কোভিড ১৯ ভ্যাক্সিন নিতে পারবেন?
গর্ভধারনের ১৪-৩৩ সপ্তাহের মধ্যে যেকোনো ধরনের কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন নিতে পারবেন (যদি সরকার অনুমোদন দেয়)।
গর্ভের শিশু কি সুরক্ষা পাবে?
১৪-৩৩ সপ্তাহের মধ্যে ২ ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ সম্পন্ন করতে পারলে মায়ের শরীরে তৈরি হওয়া এন্টিবডি রক্তের মাধ্যমে গর্ভের শিশুর শরীরে যাবে এবং শিশু করোনাভাইরাস আক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাবে।
মা ও বাচ্চার কোনো ক্ষতি হবে কি না?
গবেষণায় (বিএমজে) দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত যেসব দেশে গর্ভবতী মায়েরা ভ্যাকসিন পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে মায়েদের ভ্যাকসিন পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (যেটা সবারই হতে পারে) ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা হয়নি। বাচ্চার কোনো সমস্যা হয়েছে বলেও গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
দুগ্ধদানকারী মা ভ্যাকসিন নিতে পারবেন?
অবশ্যই পারবেন এবং মায়ের কাছ থেকে বুকের দুধের মাধ্যমে বাচ্চার শরীরে এন্টিবডি গিয়ে বাচ্চাকে সুরক্ষা দেবে। এতে মায়ের (ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বাদে) এবং বাচ্চার কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মা ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে বা পরে কোনো সতর্কতা অবলম্বন করবেন কি না?
না। তেমন কোনো সতর্কতার দরকার নাই। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন।
ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে?
জ্বর, মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, ক্লান্তি লাগা, ভ্যাকসিন দেওয়ার জায়গায় মাংসপেশিতে ব্যথা বা লাল হয়ে যাওয়া। এগুলো যে কারোরই হতে পারে।
যেসব মায়ের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হাঁপানি বা কিডনি রোগ আছে, তারা কি ভ্যাকসিন নিতে পারবেন?
হ্যাঁ। তারাও নিতে পারবেন; তবে ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে এসব রোগ থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে তারপর ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। সেজন্য নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হবে এবং ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কারা ভ্যাকসিন নিতে পারবেন না?
জ্বর, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, ক্যানসার আক্রান্ত রোগী যিনি কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি পাচ্ছেন, ২ সপ্তাহের মধ্যে অন্য কোনো ভ্যাকসিন নিলে, যাদের প্রকট এলার্জির সমস্যা এবং যাদের ভ্যাকসিনের কোনো একটি উপাদানে এলার্জি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে (আগে যদি এমন হয়ে থাকে), তারা নিতে পারবেন না।
এ সময় গর্ভবতী মায়েদের একজন চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসাধীন থাকা উচিত নিয়মিত। সেইসঙ্গে আগে যেমন প্রতি মাসে হয়তো-বা যেরকম চেকআপের জন্য তারা হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে যেতেন, সেরকম যাবেন না। এক মাসে টেলিমেডিসিন, এরপরের মাসে চিকিৎসকের কাছে যথাসম্ভব বিরতি দিয়েই যাওয়া উচিত। মোদ্দাকথা, এ সময় গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। সেইসঙ্গে যদি সরকার অনুমতি দেয়, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন নিয়ে নেওয়াই উত্তম।
গর্ভবতী এবং সেইসঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের ভাইরাস সংক্রমণরোধে নিয়ম মেনে চলা, একজন চিকিৎসকের অধীনে থাকা এবং ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে আমরা অবশ্যই গর্ভবতী মায়েদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত এবং মৃত্যুরোধ করতে পারি।
- লেখক: প্রভাষক, ফিজিওলজি (বর্তমানে সংযুক্তিতে কোভিড ইউনিট), শেই-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বরিশাল