চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন যা মনে করিয়ে দেয়
বেশ কয়েকদিন ধরে চলতে থাকা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করেছেন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, নির্বাচনের আগের দিনেই নির্বাচনে ঘোষিত বিজয়ী প্রার্থীর বিজয় র্যালি করার জন্য প্রস্তুতি ও জনসম্মুখে হাজির হওয়ার ভেতর থেকেই এই নির্বাচনী ফলাফল একটি পূর্বনির্ধারিত ফলাফল হিসেবেই মানুষের কাছে হাজির হয়েছে।
ফলাফলে দেখা যায়, শতাংশের হারে ভোট প্রাপ্তির পরিমাণ ৯০:১০। ফলে দেশের প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলো ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে তেমন মনোযোগী হয়নি। হওয়ার প্রয়োজন হয়নি। এই ভূখণ্ডে নির্বাচনের ইতিহাসটি অনেক লম্বা, কিন্তু যারা আমরা এখনও বেঁচে আছি এই পৃথিবীর এই ভূখণ্ডে, তাদের অনেকেরই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ইতিহাস জানা নেই।
এই ভূখণ্ডের ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর প্রথম নির্বাচন ছিল সেটা। সেই নির্বাচনের ফলাফল এবং তার কার্যকারিতা ছিল এক বছরেরও কম সময়। সে নির্বাচনে সার্বজনীন ভোটের অধিকার ছিল না। আর এখন সার্বজনীন ভোটের অধিকার, অর্থাৎ আঠার বছর বয়স হলেই ভোট প্রদান করা যায়।
এর পরের নির্বাচনটি বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৯৭০ সালের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে প্রথম বাংলাদেশের মানুষ সার্বজনীন ভোটের অধিকার লাভ করে, যার পুরো কৃতিত্ব সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল ছিল। সেই অর্জন ছয় দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক আন্দোলনের অর্জন ছিল।
সেই সার্বজনীন ভোটাধিকারের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা যাদের মনে আছে, আমরা তারা জানি কতটা সতস্ফুর্ত ছিল সেই নির্বাচন। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই নির্বাচন ব্যবস্থার নানা দিক তখন সর্বস্তরের মানুষের সামনে উঠে আসে। সেই নির্বাচনের ফলাফলে প্রাদেশিক পরিষদের ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ। স্বতঃস্ফূর্ততার কাছে ভিন্নমত দারুণভাবে পরাজিত হয়েছিল, ফলে নির্বাচনে ভিন্নমতের বিষয়টি অনুধাবনই করা যায়নি।
তবে ১৯৭০ সালের সেই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্মের পথ প্রশস্ত করেছিল। এরপরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল ১৯৭৩ সালে।
১৯৭৩-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে। সংবিধান গৃহীত হয়েছিল চৌঠা নভেম্বর ১৯৭২ সালে। এই ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার একটি দারুণ সক্ষমতা প্রকাশ করেছিল, কারণ পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে ততদিনে ২৩ বছর হয়ে গেছে। পাকিস্তান একটি স্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন করতে পারেনি তখনো। অন্যদিকে, ভারতের স্বাধীনতা লাভের দুই বছরের কিছু বেশি সময় নিয়ে তাদের সংবিধান রচনা করে। এখানে বাংলাদেশ সক্ষমতার অনন্য উদাহরণ রাখে মুক্তিযুদ্ধ বিজয় অর্জনের ১১ মাসের মাথায় সংবিধান রচনার সম্পন্ন করার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের এই সংবিধান প্রথম এ ভূখণ্ডের মানুষকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত করেছিল। এর আগে এই ভূখণ্ডের মানুষ এ শব্দ শুনতেও পায়নি। সংবিধানের সেই মৌলিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গঠনের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু তার সময়কালে কিংবা বঙ্গবন্ধু উত্তর বাংলাদেশে কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা আমাদের ভাবতে হবে।
গতকাল বাংলাদেশ সময়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের একটি ভার্চুয়াল সভায় নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার প্রশংসা করেছেন; অন্যদিকে অধ্যাপক রেহমান সোবহান সমাজে বৈষম্যের কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যথার্থভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল কি না, সেটাও আমাদের গবেষণা করে দেখতে হবে। সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ধারণ করেছিল, কিন্তু এই শব্দের অর্থ কী দাঁড়ায়, তা আমরা সংবিধানের কোনো অংশেই স্পষ্ট করতে পারিনি। তার কারণ কী ছিল? তখন কেন এটা হয়নি, সে প্রশ্ন নিয়েও অবশ্যই এখন ভাবতে হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতার একটি ব্যাখ্যা আমরা রাজনৈতিক মাঠে দেখতে পেয়েছি- ধর্ম যার যার। এবং সব মানুষই তার নিজস্ব ধর্ম প্রচার করবেন এবং তা পালন করবেন। এই কথার সঙ্গে কোনো দ্বিমত নাই। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে?
পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে ধর্মীয় বিষয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা সীমিতকরণের কথা বলা হয়েছে। যে দেশগুলো ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে, তাদের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে এর কথা উল্লেখ করেছে। সেখানে কোনো অস্পষ্টতা তারা রাখেনি। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধান ও বাংলাদেশের সংবিধান- উভয়ই এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এবং কথা বলা যায়, এর ভেতর থেকেই পচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক ধারা স্থাপিত হওয়া শুরু হয়।
এই ধারার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে নির্বাচনের নামে এক ধরনের প্রতারণার কথা। যার প্রথম নজির আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময়ে। তিনি রেফারেন্ডাম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার ওপর 'আস্থা আছে কী নাই', যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৩ সালের ভোটার লিস্ট ধরে তিনি হ্যাঁ-না ভোট করেন। ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, প্রায় ৯০ শতাংশের ওপরে- যা ছিল শতভাগের কাছাকাছি একটি ফল। নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করলেন, 'হ্যাঁ' ভোটের পক্ষেই ভোট দিয়েছে দেশের মানুষ। এই নির্বাচন কমিশনে তখন কারা ছিলেন?
প্রশ্ন জাগে, আমাদের মতো অনুন্নত, পিছিয়ে পড়া একটি রাষ্ট্র, যার জন্ম হয়েছে মাত্র পাঁচ বছর আগে, যার সক্ষমতা সৃষ্টি হয়নি, তেমন একটি রাষ্ট্রের ভোটকেন্দ্রগুলোয় ৯০ শতাংশের ওপরে ভোটার উপস্থিতি- বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই। যে নির্বাচন কমিশন এত বড় একটা জালিয়াতিতে স্টাম্প লাগাল, তাদের আজ মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত।
নির্বাচন কমিশন পরবর্তী সময়েও নানা অনিয়মে জড়িয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের কোনো রকম আর্থিক সুবিধা সম্পন্ন কাজে জড়িত হওয়া, রাষ্ট্রের আনুকূল্য পাওয়ার বিধান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটানোর কাজটিও প্রথম সম্পন্ন হয় ১৯৭৫ সালে। আজকের বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির উত্তরাধিকার জেনারেল জিয়াউর রহমান এটি করেছিলেন। তিনিই উদ্যোগী হয়ে প্রথম এ ব্যাপারে একটি সাংবিধানিক সংশোধনী সৃষ্টি করে বিচারপতিদের লাভজনক কাজে অংশ নেওয়ার বিধান সৃষ্টি করেন। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে যোগদান করলেন।
তারপর থেকে পেছনে তাকালে দেখতে পাই, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রায় সবসময়ই বিচারপতিগণই দায়িত্ব পালন করেছেন।
নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিয়ে ১৯৭৩ সাল থেকে রাজনৈতিক বিতর্ক চলে আসছিল, তারই ধারাবাহিকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে পার্লামেন্ট ও পার্লামেন্টের বাইরে ব্যাপক বিতর্ক হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হয়। এই সরকার ব্যবস্থা থেকে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই নির্বাচনে ওই সময়ের বিরোধী দল, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু ২০০১ সালে সেই নির্বাচন আবারও বিতর্কের মুখে পড়ে। এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতের মাধ্যমে বাতিল করা হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন- এই বিতর্কে ২০১৩ সালে দেশে প্রলয় ঘটে যায়। সারা দেশে আগুন, বোমা এবং অব্যাহত অবরোধ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। বিপুল প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তখনকার বিরোধী দলের ডাকা সেই অবরোধ আজও আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা হয়নি। ফলে এখনো ধরে নেওয়া যেতে পারে, তাদের সেই ঘোষিত কর্মসূচি অব্যাহত আছে। এখন সেই ঘোষিত অবরোধ কর্মসূচী ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। এখন আর ভোট দিতে আগ্রহ বোধ করে না দেশের মানুষ । যার ফলে ভোটকেন্দ্রগুলোতে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চেহারা প্রমাণ করছে, এরা সবাই একই দলের কর্মী।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর বা ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রপরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলের। আমাদের দেশে বেশ কিছু সাংবিধানিক পদ আছে, যা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের গণতন্ত্র- এসব কিছু নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এই পদগুলোতে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কার্যকরী নিরপেক্ষ আইন সৃষ্টি হয়নি। যে কারণে এই দীর্ঘ ৫০ বছর যাবত ব্যক্তির পছন্দ অনুসারেই এই পদগুলোতে পদায়ন হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে এটা শতভাগ তাই সত্য।
নির্বাচন কমিশনের এই অবস্থার পরিবর্তন, সংস্কার করা না গেলে মানুষের রাজনৈতিক আস্থা ফেরত আসবে না। মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবে না। আর এর পরিণতি দেশের জন্য, সমাজের জন্য কখনোই মঙ্গল বয়ে আনবে না।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক