চাইনিজ মার: লাঠিও ভাঙবে না, সাপও মরবে
প্রসঙ্গক্রমে দুটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করছি:
১. কিছুদিন আগে দেশে এক চাইনিজ বয়স্ক মহিলার সঙ্গে দেখা। কথাবার্তায় জানতে পারলাম, ভদ্রমহিলা ইপিজেডে একটি তাইওয়ানিজ জুতার ফ্যাক্টরিতে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেন। চীনের একটি অজপাড়াগাঁয়ের বাসিন্দা, স্বল্পশিক্ষিত, বঙ্গদেশে তার বেতন ৮০০০ আরএমবি ( ৯০ হাজার টাকা প্রায়)। তার এমন অনেক চাইনিজ সহকর্মী আছেন একই পদে, আর তাদের অধীনস্ত বাঙালি কর্মচারীর বেতন ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা।
২. করোনার উৎপত্তি চীনের উহান হলেও দেশে করোনা আমদানি ঘটে ইতালি থেকে। করোনার সময় চীনের উহান থেকে যে ফ্লাইটটি দেশে আসে, তাদের প্রায় সবাই মাস্টার্স, পিএইচডি স্টুডেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা।
এ দুটি ঘটনা থেকে একটু আঁচ করা যায়, দেশে বসবাসকারী চাইনিজ আর চীনে বসবাসকারী বাঙালিদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান।
এবার আসি সাপ-লাঠির প্রসঙ্গে:
এইমধ্যে সবাই জেনে গেছে, পহেলা জুলাই থেকে বাংলাদেশের ৯৭% পণ্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। এই যে চীনের শুল্ক সুবিধা (ভারতের ভাষায় খয়রাতি) নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে এত তোলপাড়, তাতে চীনের লাভটা কী, আর আমরাই-বা কি করব 'খয়রাত' নিয়ে? স্বাধীনতার পর থেকে তো কম দান-খয়রাত পাওয়া হলো না, সেটার ব্যাবহার করে কী করে ফেলেছি আমরা?
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক (নাম মনে আসছে না) বলেছিলেন, যদি তুমি কাউকে সাহায্য করতে চাও, কোনো দেশকে উন্নত করতে চাও, তবে তার কাছে গিয়ে সাহায্য করো। অনুদান, রেমিট্যান্স এবং মাইগ্রেশন প্রসঙ্গে তিনি একথা বলেছিলেন উন্নত দেশগুলির প্রতি। আসলেই তাই, বাংলাদেশের তো প্রতি ১৬ জনে একজন দেশের বাইরে থাকে, তাইলে দেশ উন্নত হয় না কেন? তার মানে, আসল সমস্যা অন্য জায়গায়। ওষুধ সেখানে দিতে হবে, যেখানে ব্যথা। চীন তাহলে হঠাৎ করে এই 'দয়া' কেন করবে? কারণ আছে।
১. করোনাভাইরাস আমেরিকা-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ, শ্রমের দাম বাড়াসহ অনেক কারণে অনেক দেশই তাদের কারখানা চীন থেকে সরিয়ে অন্য দেশে নিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। সেগুলোর একটি সম্ভাব্য দেশ হতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে চীনের দূরত্বও কম; আর যদি শুল্কমুক্ত হয়, তাইলে চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে কম দামে পণ্য সরবরাহ ঠিক থাকবে। সেক্ষেত্রে চীনের অন্তত কিছু পণ্যের দাম জনসাধারণের নাগালের বাইরে যাবে না। আবার অনেক চীনা কোম্পানিও এদেশে এসে ব্যবসা করে চীনে অথবা অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে টাকা আবার সেই চীনেই পাঠাবে।অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলে, 'lessening the price escalation'।
তাহলে আমরা কী পেলাম, আর পাব? সুযোগ তো অবশ্যই আছে, দেশ আমাদের, লেবার আমাদের, মুক্তবাজার অর্থনীতি। যুদ্ধক্ষেত্র এক, যার যেমন অস্ত্র আর কৌশল।
২. আমার জানামতে, চীন সাধারণত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে নাক গলায় না। আবার নিজে থেকে অন্যের ওপর কিছু চাপিয়েও দেয় না। এরা খুবই ব্যবসায়িক জাতি। কিন্তু নিজেদের জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় খুবই বদ্ধপরিকর। সেটার একটা অংশ হতে পারে এই শুল্কমুক্ত ব্যবস্থা। চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব অনেক দিন ধরেই, আর এখন মনে হয় ভারত সবচাইতে বেকায়দা অবস্থায় আছে।
পাকিস্তান আর মিয়ানমার তো আছেই, যাদের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক রমরমা, এখন নেপালও বুঝি গেল। বাকি রইল বাংলাদেশ, সেটা গেলেই দাদারা অনেকটা একা!
করোনাকালীন আপন পরাণ বাঁচা-মরার সময়ে দিল্লির আশেপাশে কেউ নেই। না আমেরিকা, না ন্যাটো, না জাপান কিংবা রাশিয়া। এখন শুল্কমুক্ত ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ আরও কাছে এলে পিঁয়াজ ব্যবসায়ীদের একটা শিক্ষা দেওয়া যাবে।
চাইনিজ লাঠি না হয় ভাঙল না, সাপও মরল- তাতে কি আমাদের দরজা খুলে বের হওয়ার সময় এলো?
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার চীন। দুঃখজনকভাবে অসম এই বাণিজের সুফল অনেকটাই চীন ভোগ করে। সাদামাটা চোখে অনুপাতটা হলো ১:১৭! মানে চীন ১৭ টাকা পেলে আমরা পাই ১ টাকা! অংকের হিসেবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ১২.৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৪.৪৮ বিলিয়ন ডলার। এই শুল্কমুক্ত ব্যবস্থা আমাদের জন্য বিশাল এক সুযোগ সেই অসম ঘাটতিকে কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার।
কেমন সুযোগ সেটার ছোট একটা উদাহরণ দেই। ঢাকা থেকে সরাসরি চীনের বাণিজ্যিক নগরী গুয়াংজোতে যাওয়া যায়, সময় লাগে ৩-৪ ঘণ্টা। ২০১৫ সালে সে গুয়াংজো শহরের জিডিপি ৫২৫ বিলিয়ন ডলার, যেটা সুইজারল্যান্ড পুরা দেশের জিডিপির সমান। এক ঘণ্টার দূরত্বে আছে সেনঝেন শহর, তার জিডিপি ৪৫০ বিলিয়ন ডলার, পুরা সুইডেনের জিডিপির সমান। ২ ঘণ্টার পথ হংকংয়ের কথা ভাবলে তো ইউরোপের অনেক দেশের সমান। সাংহাই, বেইজিংয়ের কথা না-ই বললাম। আর ২০১৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপি কত ছিল জানেন? মাত্র ১৯৫ বিলিয়ন ডলার।
ঢাকা থেকে যে গুয়াংজো যাবেন? তিনটি বিমান সংস্থার দু'টাই আবার চীনের। তাদের ভাড়াও বেশি। দেশি ইউএস - বাংলার ভাড়া কম, আসনও ফাঁকা থাকে। আর সরকারি 'বাংলাদেশ বিমান' আজ ১০ বছর ধরে চালু করছেই...! কবে চালু হবে, আর হলেও লাভের মুখ দেখবে কি না, কে জানে!
এক বাঙালি ব্যবসায়ী বলেছিলেন, আমরা বাঙালিরা ব্যবসার 'ব'ও বুঝি না; আর চীনারা ব্যবসার সঙ্গে পারলে টেনে আরও কয়েকটি বর্ণ বসায়। এক একটা রোগ, দুর্যোগ আসে (যেমন ডেঙ্গু, করোনাভাইরাস), আমরা দুই-তিনজন ব্যবসায়ী কোটিপতি হই ঠিকই, কিন্তু এটার দৌড় সেই 'ব' পর্যন্তই। অপরদিকে চীনাদের পোয়াবারো।
পরিশেষে এই 'খয়রাত' বলি আর যা-ই বলি, এটার সদ্ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশের রপ্তানি ঝুড়িতে পণ্য বৈচিত্র্যের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। সবার আগে তাদের এগিয়ে আসা উচিত, যারা ভারতের 'খয়রাতি' শব্দ ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছেন। শুধু ফেসবুকে রাগ-ক্ষোভ উৎরে দিলে অন্যরা ঠিকই সাপও মারবে, লাঠিও ঠিক রাখবে। আমরা শুধু সেই মরা সাপের গন্ধ নিয়েই বেঁচে থাকব।
- লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস
(লেখাটি তৈরি করতে সহায়তা করেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের চীন প্রতিনিধি ছাইয়েদুল ইসলাম)