চীন: মিয়ানমারের মহাপ্রাচীর
মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় নিন্দা জানাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি নিজেদের ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে আটকে দিয়েছে চীন। এশিয়ার এ দুই দেশের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কের দিকটি খেয়াল করলে বিষয়টি মোটেও অবাক করার মতো নয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে দীর্ঘকাল ধরেই মিয়ানমারের সঙ্গে শক্তিশালী মিত্রতা তৈরি করে আসছে চীন। সেই স্বার্থ থেকেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিটি আটকে দিয়েছে তারা।
এর আগে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন দেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম গণহত্যা চালিয়ে তাদের স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করে, তখনও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ব্যবস্থা নিতে গেলে তা রুখে দেয় চীন।
একের পর এক প্রচেষ্টা নিয়ে ব্যর্থ হয়ে জাতিসংঘের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই পরিষদও একসময় ক্ষান্তি দেয়; রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘ সময়ের জন্য চুপ হয়ে যায় তারা।
গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় বসতে না দিয়ে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের এই ঘটনার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছিল, তা কেবলই নিন্দাজ্ঞাপন সম্বলিত একটি বিবৃতি ছিল। নিষেধাজ্ঞার মতো কোনো কঠোর পদক্ষেপও এটি নয়। তবু সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছে; কারণ, এর বিপরীতে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন।
জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের একজন কূটনীতিক এই বিবৃতিতে দেশটির পক্ষ থেকে সম্মতি দেননি। উপরন্তু তিনি চেয়েছেন, বিবৃতিটি পর্যালোচনার জন্য চীনে পাঠাতে। ওই পর্যালোচনার ফলাফল যে কী হতে পারে, সেটা মিয়ানমারের বিষয়ে চীনের অবস্থান বিবেচনায় নিলে সহজেই অনুমান করা যায়।
সোমবার ভোরে সেনাবাহিনী মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের পর যখন সারা বিশ্ব থেকেই একের পর এক নিন্দা আসতে থাকে, তখন এ ঘটনাকে মিয়ানমারের 'অভ্যন্তরীণ ঘটনা' হিসেবে আখ্যায়িত করে বেইজিং। চীনের ভাষ্য হলো, মিয়ানমারের সব দল মিলে আলোচনার মাধ্যমে এই ঘটনার সমাধান নিজেদেরই করা উচিত।
সুতরাং এটা পরিষ্কারভাবেই নির্দেশ করে, আগামী দিনগুলোতেও জাতিসংঘ যখন মিয়ানমারের এই দখলদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইবে, তখন তাদের রক্ষা করবে চীন। কারণ, এর আগেও এই সামরিক বাহিনী যখন কয়েক দশক দেশটির গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ভূ-লুণ্ঠিত করে ক্ষমতায় টিকে ছিল, তখনও ঢাল হয়ে তাদের নানা সময়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রক্ষা করেছিল চীন।
বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ এলিয়ট প্রাস-ফ্রিম্যান বলেছেন, 'চীনের কার্যকলাপে মনে হচ্ছে, মিয়ানমারে যা ঘটেছে তা কেবলই তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার; যেন আমরা মন্ত্রিসভার রদবদল দেখছি, চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এমনটাই বোঝাচ্ছে।'
তার মতে, জাতিসংঘের বিবৃতি তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি বদলে দিতে না পারলেও সুসঙ্গত আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এর গুরুত্ব থাকত। তবে তেমন কিছু হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।
তবু, জাতিসংঘের সংস্থাটির মঙ্গলবারের ওই পদক্ষেপ আটকে দিয়েছে চীন। এর মাধ্যমে চীন তার 'বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী' দেশটিকে বাঁচাতে সম্পর্কের দেয়ালে আরও একটি ইটের গাঁথুনি দিল।
রাষ্ট্রীয়ভাবে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক যে গণহত্যা ও নিপীড়ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালিয়েছে মিয়ানমার, তার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে একই কৌশলে দেশটিকে রক্ষা করেছে চীন। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যাকেও মিয়ানমারের 'অভ্যন্তরীণ বিষয়' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল দেশটি। এমনকি সেই ঘটনায় যখন সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছিল, তখন স্রেফ 'নিন্দা'টুকুও জানায়নি এশিয়ার এই পরাশক্তি।
যখনই বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রশ্নটি সামনে আসে, তখনই এর সমাধানে একটি 'রেসিপি' দেয় চীন। আর সেটি হলো, ঢাকা-নেপিডোর দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি।
চীনের এই 'রেসিপি' কখনোই কাজ করেনি। নিপীড়নের মুখে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে আসার পর রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরাতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তির দু'বছর পেরিয়ে গেছে; এখনো একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেনি।
মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যতকে আরও কঠিন পথে ঠেলে দিয়েছে। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে ঢাকা-নেপিডোর মধ্যকার যে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক ছিল, সেটিও এখন অনিশ্চয়তার মুখে। তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও প্রতিবেশী দেশটিতে ক্ষমতার পালাবদলকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য 'প্রধান উদ্বেগ' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যার যে ইতিহাস, তাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বেগ ঠিকই আছে। এই সেনা নিয়ন্ত্রিত সামরিক সরকারই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে দশকের পর দশক ধরে তাদের বানিয়ে রেখেছিল রাষ্ট্রহীন মানুষ। এই সামরিক সরকারই সত্তরের দশক ও নব্বইয়ের দশকে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নির্মূল অভিযান চালিয়েছিল এবং তাদের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে করেছিল বাধ্য।
এর আগে দুই দফায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করাতে বাংলাদেশ সরকারকে বছরের পর বছর ধরে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছিল। ২০১৭ সালে গণহত্যার মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পর প্রত্যাবাসনের শর্ত আগের দুইবারের তুলনায় আরও কঠোর করে দেয় মিয়ানমার। ফলে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার আশা আরও ফিকে হয়ে যায়।
মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের কারণে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি বর্তমানে রোহিঙ্গা সংকট থেকে সরে 'গণতন্ত্রে'র দিকে ঝুঁকেছে। একে কেন্দ্র করে এশিয়ার ভূ-রাজনীতি বদলে যেতে পারে। এশিয়ার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন লড়াইয়ের নতুন স্থান হিসেবে বেছে নিতে পারে মিয়ানমারকে।
সদ্য দায়িত্ব নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য নতুন এক পরীক্ষা হয়ে এসেছে মিয়ানমারের এই ঘটনা। অভ্যুত্থানের পর আটক নেত্রী সু চি'কে মুক্তি এবং দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে সামরিক সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে মার্কিন প্রশাসন। এর প্রচেষ্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ফের মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করতে এবং জাতিসংঘকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাগাদা দিতে পারে। এমন প্রেক্ষিতে সাহায্যের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া ছাড়া মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের আর কোনো উপায় থাকবে না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের কৌশলগত প্রভাব আরও বাড়াতে এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের জায়গা থেকে এটিকেই কাজে লাগাবে চীন।
আর এর মধ্য দিয়েই, আন্তর্জাতিক ক্ষমতার এ লড়াইয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি চাপা পড়ে যাবে; আরও বহু বছর পার্শ্ববর্তী দেশের নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের বোঝা বইতে থাকবে বাংলাদেশ।
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: China: The Great Wall for Myanmar
- অনুবাদ: তারেক হাসান নির্ঝর