দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষমতাসীনদের দল ও প্রশাসনের মধ্যে সীমারেখা স্পষ্ট করে রাখা উচিত
বাংলাদেশের প্রথম সারির প্রায় সকল দৈনিকই তাদের প্রথম পাতায় উচ্ছ্বসিত পরীমনির তিন কলামের ছবি দিয়ে তার মুক্তির খবর ছেপেছে। প্রায় ২৮ দিনের কারাবাস। ৪ আগস্ট গ্রেফতার। প্রথমে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ, এরপর তিনবারে মোট ৭ দিন পুলিশী হেফাজতে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ।
ম্যাজিট্রেট আদালতে প্রতিবার রিমান্ড শুনানিতে পরীমনির পক্ষ থেকে রিমান্ডের বিরোধিতা এবং জামিন প্রার্থনা করা হলেও সেটা মঞ্জুর করা হয়নি। অবশেষে দায়রা জজ আদালতে জামিন প্রার্থনা করা হলে এমন বিলম্বে শুনানির দিন ধার্য করা হয় যা সকলকে বিস্মিত করে। শুনানির জন্য এতো দীর্ঘ বিলম্বের কারণ জানতে চায় মাননীয় হাইকোর্ট। শুনানির দিন এগিয়ে আনতে দায়রা জজ আদালত অনেকটা বাধ্য হয়ে ৩১ আগস্ট দিন নির্ধারণ করেন এবং শুনানি শেষে জামিন প্রদান করেন। জামিন লাভের পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন পরীমনি। ২৮ দিনের এই দীর্ঘ পরিক্রমা আমাদের অনেকগুলো প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যে প্রশ্নগুলো আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকার ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার সাথে সস্পর্কিত।
আমাদের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা এবং নিশ্চয়তার জন্য অনেকগুলো ধারায় সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত বলা আছে। সংবিধানের ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে গ্রেফতার ও পুলিশ হেফাজতে আটককৃত ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এই অধিকারের মধ্যে অন্যতম হলো, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ জানানো এবং তার পছন্দের আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করতে দেওয়া। গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করা। ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া পুলিশ হেফাজতে আটক রাখা এবং সকল প্রকার নির্যাতন থেকে মুক্ত রাখা। এছাড়াও সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রত্যেক নাগরিকের সমান আইনগত সুরক্ষা, গ্রেফতার, আটক এবং বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষাকবচ হিসেবে অনেকগুলো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে।
নাগরিকের জন্য সংবিধান প্রদত্ত সুরক্ষাবলয় আইন প্রয়োগকারীর হাতেই সবচেয়ে বেশিবার লঙ্ঘিত হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের নিয়ে সংবাদপত্রের পাতার প্রতিদিন বহু খবর ছাপা হয়। বহু ঘটনা অপ্রকাশিতও থেকে যায়। তবে এটাও ঠিক, অপরাধী চিহ্নিত করা গেলে তাকে বিচারের আওতায় আনা হয়। দিনাজপুরের সেই ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলাসহ এই সময়ের আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার বিচার হয়েছে। এই ধরনের বিচারের তালিকা নেহায়েত কম নয়, এটা আশার দিক কিন্তু অন্যদিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারার অপপ্রয়োগের তালিকা দীর্ঘ এবং হতাশাজনক। পুলিশ হেফাজতে নিষ্ঠুর নির্যাতন, ক্রসফায়ারের হুমকি এমনকি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু আমাদের দেশে কম নয়। নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ পুরাতন। 'গ্রেফতার বাণিজ্য' বহুল ব্যবহৃত শব্দযুগল।
১৯৯৮ সালে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যু হয়। ডিবি পুলিশ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন করলে ২৩ জুলাই মিন্টু রোডে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়। সারা দেশে ঘটনাটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। পুলিশের নির্যাতনে একজন ছাত্রের মৃত্যু সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। দেশ প্রতিবাদমুখর হয়েছে। বেসরকারি মানবাধিকার ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো সোচ্চার হয়েছে। এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে গ্রেফতার ও রিমান্ডের প্রচলিত ধরনের পরিবর্তনের জন্য সরকারের উপর নির্দেশনা জারি করে আদালত। পুলিশ হেফাজতে রুবেল নিহত হওয়ার পর ঘটনাটির প্রতিকার চেয়ে রিট আবেদনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের নজরে নিয়ে আসা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় সন্দেহবশত কাউকে গ্রেফতার এবং ১৬৭ ধারায় অধিকতর তদন্তের নামে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ফলে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাটির সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হলে আদালত সরকারের প্রতি রুল জারি করে। এবং কেন এগুলো বেআইনি ঘোষণ করা হবে না তা জানতে চায়। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি মোঃ হামিদুল হক এবং বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য সরকারকে ৬ মাসের সময় দিয়ে নির্দেশনা জারি করেন। কেবল তাই নয়, যতদিন ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধন না হচ্ছে ততদিনের জন্য আদালত ১৫ দফা নির্দেশনা জারি করে সরকারের সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে মেনে চলতে নির্দেশনা দেয়। সরকারের করা আপিল খারিজ করে ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে।
১৫ দফা নির্দেশনার উল্লেখযোগ্য দিক হলো ডিটেনশনের জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় আটক করতে পারবে না। গ্রেফতারের সময় পুলিশ পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেফতারের কারণ ও গ্রেফতারের সময় শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন থাকলে হাসপাতালে চিকিৎসা এবং ডাক্তারের সনদ নিতে হবে। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কারণ পুলিশের নথিতে লিখতে হবে এবং আটক ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের কাঁচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে।
জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদের বিষয় তারা দেখতে পারবেন কিন্তু শুনতে পারবেন না। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। নির্যাতনের সত্যতা পাওয়া গেলে পুলিশের বিরুদ্ধে ৩৩০ ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হবে। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার সাথেও অনুরূপ নির্দেশনা দেওয়া আছে যার ফলে নাগরিকের জানমালের হেফাজত হতে পারে।
এখন যদি আমরা আমাদের চেনা বাস্তবতায় ফিরে আসি তা হলে কী দেখি! পুলিশ রিমান্ড এখনো এক আতঙ্কের নাম। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জেনেছি, রিমান্ডে আসামিদের ১৪ ধরনের নির্যাতন করা হয়। এগুলোর মধ্যে ডলা দেওয়া, গিট থেরাপি, বাদুড় ধোলাই, ওয়াটার থেরাপি, উলঙ্গ করে নির্যাতন, সারাদিন না খাইয়ে নির্যাতন, টানা নির্যাতন, বাতাস নির্যাতন, বোতল থেরাপি, ডিম থেরাপি, ডিস্কো ড্যান্স নির্যাতন, সেলাই নির্যাতন, ঝালমুড়ি নির্যাতন উল্লেখযোগ্য। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নিষ্ঠুর ও অমানবিক এইসব কৌশল অবলম্বন করা হয়। পুলিশ রিমান্ডে এ ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হননি এমন মানুষ পাওয়া কঠিন।
যে কোন ধরনের নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অমর্যাদাকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর এক সনদ স্বাক্ষরিত হয়। ৮৪ সালের মানবাধিকার দিবসের ঐ ঘোষণায় বলা হয়, মানুষ একে অন্যের এমনকি রাষ্ট্র তার নাগরিকের উপর কোন ধরনের অমানবিক, নিষ্ঠুর, অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি প্রয়োগ করবে না। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর জাতিসংঘ ঘোষিত সনদে স্বাক্ষর করে। আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের ৫ ধারায় বলা আছে, কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না। বা কাহারো সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না। জাতিসংঘ সনদের অঙ্গীকার এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের কার্যকারিতা বিধানের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে 'নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়।
প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের সুরক্ষা দেবার জন্য দেশের সংবিধান, আইন ও আইনের বিধি-বিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সনদ থাকার পরও উচ্চ আদালতের হতাশা প্রকাশ করতে দেখি। হাইকোর্টে গতকাল এক রিমান্ড প্রদানের যৌক্তিকতা নিয়ে শুনানি চলাকালে, রিমান্ডের উপাদান না থাকা সত্ত্বেও রিমান্ড প্রদান করার প্রেক্ষিতে বিচারপতি বলেন, "পুলিশ রিমান্ড চাইলো আর দিয়ে দিলেন! সভ্য দুনিয়ায় এটা চলতে পারে না"। একইভাবে আমাদের দেশে জামিন প্রদানের কোন নীতিমালা নেই। হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দেবার অভিযোগে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ফেসবুকের কথিত পোস্ট দেবার অভিযোগে ঝুমন দাস নামের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। ঝুমনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। এ পর্যন্ত সাতবার ঝুমনের জামিন আবেদন নাকচ করা হয়। ঝুমন দাস এখনো কারাগারে। নোয়াগাও গ্রামের সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আটক ৫২ জনের সবাই অনেক আগেই জামিনে মুক্ত হয়েছেন। ঝুমন দাসকে নিয়ে তেমন কাউকে কথা বলতে শুনি না। কিছু অনলাইন আন্দোলনকারী ঝুমন দাসের মুক্তির কথা বলছেন।
সরকার ও পুলিশের 'ঘনিষ্ঠতা' আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে পুলিশ অনেকটা সেই দলের লোকদের মত আচরণ করতে থাকে। এই উপমহাদেশের কোন দেশ এর থেকে মুক্ত নয়। ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা পুলিশের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে বলেন, "পুলিশের যে সব কর্মকর্তা ক্ষমতাসীন দলের সুনজরে থাকতে চান, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন এবং বিরোধীদের উপর চড়াও হন"। এই কথা থেকে আমাদের দেশ পিছিয়ে নেই বরং এগিয়ে। অনেক সময় প্রশাসন ও দল আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ক্ষমতাসীনের সুনজরে পড়ার আশায় দলীয় কর্মসূচীতে শ্লোগান দিতে শোনা যায়। তারা সকলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এদেশের মানুষের করের টাকায় সকলের বেতন হয়। ক্ষমতাসীনদের দল ও প্রশাসনের মধ্যকার সীমারেখাটা স্পষ্ট করে রাখা উচিত দেশের বৃহত্তর কল্যাণে।