ধর্ষণের দায় থেকে বাঁচার বুদ্ধিই কি বাতলে দিলেন বিজ্ঞ আদালত?
একজন যৌনকর্মীকে ধর্ষণ করা কী জায়েজ?
খুব বেদনায়ক একটি প্রশ্ন। কিন্তু দেশের বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় এই বেদনায়ক প্রশ্নের মাধ্যমেই প্রচলিত সাক্ষ্য প্রমাণ আইনে ধর্ষণ মামলা পরিচালনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাতে হয়। এই আইনের ফলে আইনগতভাবেই অভিযোগকারী নারীকে 'দুশ্চরিত্র' প্রমাণের সুযোগ থাকে, পার পেয়ে যেতে পারে অপরাধী। এ নিয়ে নারী অধিকারকর্মীরা অনেক আগে থেকেই এ আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন।
চরিত্র কী? দুশ্চরিত্রের সংজ্ঞা কী? একজন নারী বিয়ে ছাড়া সেক্সুয়ালি এক্টিভ থাকলে, আদালতে এ নিয়ে ধর্ষণ মামলায় প্রশ্ন তোলার যৌক্তিকতা কী? এর অর্থ কি আদালত এই বার্তা দিচ্ছেন না যে, সেক্সুয়ালি এক্টিভ থাকলেই তার সঙ্গে ধর্ষণ 'জায়েজ'?
'ধর্ষণ'- কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম করা। 'ইচ্ছা', 'কনসেন্ট'- ধর্ষণ মানেই যে কনসেন্টের অনুপস্থিতি, এটিই যে একেবারে মৌলিক বিষয়- এ বিষয়টি কি বিজ্ঞ আদালত জানেন না? এ অনুযায়ী বিয়ের আগে যৌনসম্পর্ক থাকা কি তাহলে একজন নারীকে ধর্ষণের সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়ার শামিল নয়? নাকি আমাদের বিজ্ঞ আদালত একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মনে করেন, সারাজীবন এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকা ও বিয়ে ছাড়া যৌন সম্পর্ক থাকা মানেই সে নারী যে কারো সঙ্গেই যৌন সম্পর্ক করতে প্রস্তুত?
আবার, ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ঘটনার তিনদিন পর মামলা না নেওয়ার 'পরামর্শ' দেওয়া, বিজ্ঞ আদালতের সময় নষ্ট- ভুক্তভোগীদের জন্য এ ধরনের মন্তব্যের চেয়ে অপমানজনক আর কী হতে পারে? পুরো দেশ এর মাধ্যমে কী বার্তাই বা পাচ্ছে?
বনানীর রেইনট্রি ধর্ষণ মামলা ও রায় পরবর্তী বিজ্ঞ আদালতের দেওয়া পর্যবেক্ষণের পর দেশের স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ বোধহয় এরপর থেকে অবাক হওয়াও ভুলে যাবেন।
শুধু ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নই নয়, কোনো অপরাধের ক্ষেত্রেই বিচার চাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় নেই। কোনো অপরাধের ১০,২০,৩০ বছর পরও মামলা হয়। ঘটনাভেদে কিছু অপরাধ প্রমাণিত হয়, কিছু প্রমাণিত হয় না। কিন্তু, আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হওয়া তো পরের বিষয়। প্রশ্ন ওঠে, বিজ্ঞ আদালতের এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দেওয়ার এখতিয়ার আছে কি না?
আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের দেওয়া এই পর্যবেক্ষণ উচ্চ আদালতের নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক শুধু তা-ই নয়, আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
২০২১ সালে এসে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে জোয়ার দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের উন্নয়নের ছোঁয়া যখন সুদূর বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ছোট্ট এ দেশটিতেও এসে পৌঁছেছে, এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাপী এ ধরনের ঘটনাগুলোতে কী হচ্ছে- সেই বোধের আলো কেন আর এখানে পৌঁছাচ্ছে না?
মি-টু মুভমেন্টের কথাই ধরা যাক। ২০০৬ সালে তারানা বার্কের 'সহানুভূতির মাধ্যমে ক্ষমতায়ন অর্জন' এ মন্ত্রকে সামনে রেখে মি-টু আন্দোলনের সূত্রপাত। ২০১৭ সালে বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম ও দ্য নিউ ইয়র্কারে প্রথম এ অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনের পর ৮০'র বেশি নারী ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন। সে বছরেরই নভেম্বরে ইতালিয়ান অভিনেত্রী আসিয়া আর্গেনোর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী নারীদের এক দল ওয়াইনস্টিনের দ্বারা ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার শতাধিক নারীর নাম প্রকাশ করেন।
এই ১০৭ জন নারী ১৯৮০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তরুণ অভিনেত্রী বা মডেলদের তাদের ক্যারিয়ার ও কাজের কথা বলতে অফিস বা হোটেল রুমে ডেকে নিতেন তিনি।
দ্য গার্ডিয়ানের এ সম্পর্কিত 'প্যাক অব হায়েনাস: হাও হার্ভে ওয়াইনস্টিন'স পাওয়ার ফুয়েলড আ কালচার অব এনাবলারস' শীর্ষক প্রতিবেদনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, তার সাবেক সহকর্মী ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, তার কর্মচারী, এসোসিয়েট ও এজেন্টরা এসব মিটিংয়ের আয়োজন করতেন। পরবর্তী সময়ে এসব নারীরা অভিযোগ তুললে আইনজীবী ও বিভিন্ন পাবলিসিস্টের সাহায্যে তা চাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের 'ওয়াইনস্টিন'স কমপ্লিসিটি মেশিন' প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে ভুক্তভোগী তিনজন নারীর সঙ্গে সেটেলমেন্টে আসতে জড়িত ওয়াইনস্টিনের ভাই বব ওয়াইনস্টিন। মিরাম্যাক্সের ভুক্তভোগী এক নির্বাহী কর্মী ও তার নারী সহকর্মীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছিলেন, ওয়াইনস্টিনকে সুরক্ষা দিতে প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কর্মীর চেয়েও ওতপ্রোতভাবে বেশি জড়িত ছিল মিরাম্যাক্সের হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট।
অনেক বছর আগের এসব ঘটনা নিয়ে তোলা অসংখ্য অভিযোগের পর, লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনে অন্তত ছয়জন ভুক্তভোগীর অভিযোগ দায়েরর পর ২০১৮ সালের মে-তে নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াইনস্টিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির রায়ে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও থার্ড ডিগ্রি ক্রিমিনাল সেক্সুয়াল এসোল্ট প্রমাণিত হয়। সাজা হয় ২৩ বছরের কারাদণ্ড।
এ ঘটনার পরই সারা বিশ্বজুড়ে মি-টু মুভমেন্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ আসতে থাকে অসংখ্য 'নামী-দামী', প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। অনেক ঘটনাই আদালত পর্যন্তই গড়ায়, কিছু প্রমাণিত হয়, সাজা ঘোষণা হয়।
২০১১ সালে এক নারীকে ধর্ষণের দায়ে ২০১৮ সালে কারাদণ্ড দেওয়া হয় ফরাসী ফটোগ্রাফার জঁ ক্লভ আর্নল্টকে। ২৬০ জনের বেশি নারী ও শিশুকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আসে যুক্তরাষ্ট্রের জিমন্যাস্টিক জাতীয় দলের চিকিৎসক ল্যারি নাসারের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালে তাকে ৪০-১৪৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আলোচিত এ সবগুলো মামলার অপরাধের সময়কালই অভিযোগ তোলা ও মামলা হওয়ার অনেক বছর আগের।
আমাদের দেশের আইন এ সময়কাল নিয়ে কী বলছে? এমন কোনো আইন কি আছে তিনদিন সময় পার হলে পুলিশ মামলা নিতে পারবে না?
খুলনার দাকোপ উপজেলায় ২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল কিশোরী ধর্ষণের রায় দেওয়া হয় ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় আসে ১৪ অক্টোবর। হাইকোর্ট ওই রায় দেওয়ার সময় বলেন,
"শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে ধর্ষণ প্রমাণ হয়নি বা আপিলকারী ধর্ষণ করেনি, এই অজুহাতে সে (আসামি) খালাস পেতে পারে না। ভিকটিমের মৌখিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ভিত্তিতেই আসামিকে সাজা প্রদান করা যেতে পারে।"
অথচ, রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের মামলার রায়ে নিম্ন আদালতের দেওয়া পর্যবেক্ষণে ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশকে মামলা না নিতে বলেন।
"তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভিকটিমদের ডাক্তারি রিপোর্টে কোনো সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের বিবরণ নেই। ভিকটিমের পরিধেয়তে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিলল না। … ৩৮ দিন পর এসে তারা বললো 'রেপড হয়েছি', বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিৎ ছিল।"
এই কথার সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র জমা দিয়ে আদালতের সময় নষ্ট করেছে এমন মন্তব্যও করেন এই বিচারক।
ভিক্টিমের পরিধেয়তে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিলল না- এ মন্তব্যে অভিযোগকারীর যৌনজীবন নিয়ে তীর্যক মন্তব্য, ৩৮ দিন পর অভিযোগ করায় তদন্ত কর্মকর্তা কেন অভিযোগ পত্র জমা দিয়ে সময় 'ক্ষেপণ' করলেন- এ ধরনের মন্তব্য শুধু এই মামলার অভিযোগকারীদের জন্যই আশঙ্কাস্বরূপ তা নয়।
ভবিষ্যতে নির্যাতনের শিকার যে কোনো নারীর বিচার প্রত্যাশার রাস্তায় বিরাট এক দেয়াল হয়ে দাঁড়াল নিম্ন আদালতের এ বিচারকের এ মন্তব্য।
ট্রমা রেসপন্স, ভুক্তভোগীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় তার সিদ্ধান্ত নেওয়া, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে তার দ্বারা ক্ষমতার ব্যবহারের মাধ্যমে ভুক্তভোগীকে চাপ দেওয়া- এসব বিষয়ের অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে- এমনটাই মনে হতে পারে আদালতের দেওয়া পর্যবেক্ষণ শুনে।
হার্ভি ওয়াইনস্টিনের ঘটনাতেই বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল ক্ষমতার ব্যবহার করে কীভাবে অভিযোগকারীদের দমিয়ে রাখা হতো। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে দাঁড়িয়ে শতাধিক নারীকে নিপীড়নের পরও শুধু ক্ষমতার ব্যবহার করে বছরের পর বছর অপরাধী সসম্মানে ঘুরে বেড়িয়েছে।
এ দিকটি বিজ্ঞ আদালত কি জানেন না এমন প্রশ্নও শিশুতোষ। রেইনট্রি'র রায়ের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়ানো একটি প্রশ্নই রেখে যেতে চাই:
ধর্ষণের দায় থেকে বাঁচতে ধর্ষণের পর ভিক্টিমকে তিনদিন আটকে রাখার বুদ্ধিই কি বাতলে দিলেন বিজ্ঞ আদালত?
লেখক: সাংবাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী