নিরাপত্তা পরিষদ কি মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে আদৌ ব্যবস্থা নিতে চায়?
পৃথিবীতে সেই পুরাতন শিক্ষা নতুন ভাবে প্রমাণিত হল। নিরাপত্তা পরিষদে দীর্ঘ বিতর্কে চীন, রাশিয়া, এবং ভারত (নন পারমানেন্ট মেম্বার), ভিয়েতনাম মিয়ানমারের বিষয়ে একই অবস্থান গ্রহণ করল। ভিয়েতনাম বর্তমান নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি। সভাপতি হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদে একমত হওয়া বিষয়বস্তুকে নিয়ে পহেলা এপ্রিল একটি সংবাদ সম্মেলন করেন ভিয়েতনামের কূটনীতিক দাং দিন কিউ, যিনি বর্তমান নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি।
অং সাং সু চি ২০২০ সালে নির্বাচনে ব্যাপক জয়লাভ করেছিল তখনই বোঝা গেছিল যে জান্তা এই নির্বাচনের ফলাফল মানবে না। কারণ জান্তা প্রণীত যে সংবিধান বহাল ছিল অং সাং সু চি'র নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে সেই সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলা ছিল। যে সংবিধানে পার্লামেন্টের আসন সংখ্যার ২৫ শতাংশ সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। পৃথিবীতে এই রকম সংবিধান আর কোথাও নাই। সরাসরি সংবিধানের অংশ হবে সেনাবাহিনী। এর হেরফের সেনাবাহিনী হতে দেবে কেন? ফলে যা ঘটার তাই ঘটল, সেনাবাহিনীর পুরনো অভ্যাসমতো ক্ষমতা দখল করল।
মিয়ানমারে প্রায় ৮৯ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। শান্তির ধর্ম, অহিংসার ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম। সেই বুদ্ধধর্মের অনুসারী বামার সম্প্রদায়, মূলত তারাই দেশটি নিয়ন্ত্রণ করে। মিয়ানমার নামের এই দেশটির ইতিহাস একটি জটিল ইতিহাস। বহুকাল থেকেই দেশটি পারস্পরিক হানাহানির মধ্যে রয়েছে। অং সাং সু চি'র পিতা জেনারেল জেনারেল অং সাং ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের পরিসমাপ্তির মাত্র নয় মাস আগে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেরই শিকারে পরিণত হয়ে নিহত হন। ব্রিটিশদের দখল করার আগেও কিংবা তার পরেও এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মিয়ানমারে বহাল ছিল। মিয়ানমারের বিশাল ভূখণ্ডের নানা অংশে নানা রাজা ব্রিটিশ দখলদারিত্বের আগেই নিজেদের মধ্যে বিবাদে লিপ্ত ছিল। এই ভূখণ্ডে পঞ্চাশোর্ধ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অবস্থান। যার মধ্যে ১২ থেকে ১৫ টা প্রধান। এরা রাজায় রাজায় যুদ্ধের মতো ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরেও জাতিগত দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় বলা যায়, এখনকার এই সামরিক জান্তা অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসার পরও বিদ্রেহী জাতিগোষ্ঠির উপর বিমান আক্রমণ করেছে, নিজ দেশে। কারণ সেনাবাহিনীও সরাসরি এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী দ্বারা ইতিমধ্যেই কয়েকদফা আক্রান্ত হয়েছে।
দেশটিতে এখন পর্যন্ত সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে যে জনরোষ সৃষ্টি হয়েছে তাতে সেনাবাহিনী পুলিশ যৌথভাবে পাঁচ শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশু আছে। সাম্প্রতিককালে কোথাও এত ব্যাপক সংখ্যক নারী শিশু হত্যার উদাহরণ নাই।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের অন্যতম অংশ ছিল একে হত্যাকাণ্ড বলা। মানুষকে হত্যা করা হয়েছে শব্দটি ছিল কিলিং। চীনের আপত্তিতে কিলিং শব্দ পাল্টে মৃত্যু লেখা হয়েছে। চীন, রাশিয়া এবং ভারতের মতো দেশ অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্যই মিয়ানমারের এই হত্যাকাণ্ডকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জুগিয়েছে। দেশগুলো নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করায় নতুন করে দেশটিতে সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র জনগণের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে । আর এত হত্যার পরেও এখন পর্যন্ত সেনাশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে।
প্রশ্ন হল চীন রাশিয়া এবং ভারত দেশ দুটো একই সূত্রে এরকম একই জায়গায় পৌঁছালো কি করে?
চীন এবং ভারতের মধ্যে চরম কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছে লাদাখকে নিয়ে। তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের সম্পদ লুণ্ঠনে দুটি দেশেই এক পদ্ধতি নিয়েছে। তারা উভয়েই সেনাবাহিনীর এই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থনযোগ্য মনে করছে। তা না হলে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি শক্ত প্রস্তাব উত্থাপিত হত, এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব অনুসারে অর্থনৈতিক অবরোধের বিষয়টা সামনে আসতো। তবে গত পরশু হঠাৎ করে ভারত তার অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। এটি ভারতের একটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান। নিরাপত্তা পরিষদের অবস্থানের সঙ্গে ভারতের এই পদক্ষেপের মিল নাই বললেই চলে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।
মিয়ানমারের ঘটনায় সমর্থন জানানোর পেছনে আরেকটি কারণ আছে । ভারতের ক্ষেত্রে কাশ্মীর আর চীনের ক্ষেত্রে জিনজিয়ান, আর রাশিয়ার ক্ষেত্রে ইউক্রেন, ক্রিমিয়া, জর্জিয়া-- এ প্রতিটি স্থানেই গণহত্যার অভিযোগ বিশ্বে আলোচিত হচ্ছে, সে কারণে সম্ভবত মিয়ানমারের হত্যাকাণ্ডকে তারা বৈধতা দিচ্ছে। তারা প্রেস কনফারেন্সে যে ভাষা ব্যবহার করেছে মিয়ানমারে বিরুদ্ধে তা যথেষ্ট নয়। সমঝোতার ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান মূল ধারা। তারা মিয়ানমার বিষয়ে একমত হতে পারেনি। এরকম একটি ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের পরেও চীন তার পক্ষ নিতে পারে এটা স্বাভাবিক বুদ্ধির মানুষ পৃথিবীতে গ্রহণ করবে না।
প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের ধারক মোদিজীর ভারত সরকার পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেদেরকে যে দাবি করে তার সঙ্গে মিয়ানমারের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে তাদের ভূমিকা ও চীন রাশিয়াকে সমর্থন করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সমর্থনের ফলে মিয়ানমারে ভবিষ্যতে সামরিক শাসনের অবসান হওয়ার কোন কারণ আছে বলে মনে করা যাচ্ছে না। সেনা শাসন অতীতের মতোই দীর্ঘায়িত হবে। দীর্ঘকাল পরে, মিয়ানমারে ২০১৫ সালে সেনাশাসনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।
৬৪ বছরের জেনারেল মিন অং হ্লাইং ক্ষমতায় ফিরে এসে আবার মিয়ানমারের সম্প্রদায়গুলোর ভেতর থেকে কিছু মানুষকে তার দলে টেনে নিয়েছে । যে কারণে এই বিদ্রোহ অভ্যুত্থানের পক্ষে কিছু মানুষের পদচারণাও দেখা যাচ্ছে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা জাতিসংঘের ব্যর্থতা প্রকট করে তুলল। জাতিসংঘের আগামীতে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের কর্তৃত্ব এই ৫ নিয়ন্ত্রক শক্তির কাছে থাকার ফলে এরাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকারী। পৃথিবীর যে কোন সঙ্কটে এরাই সিদ্ধান্ত দেয়। কেবলমাত্র এদের অর্থনৈতিক শক্তির কারণে নয় এদের সামরিক শক্তি অন্যতম কারণ।
সেই বিবেচনায় বিশ্বে তারা তাদের সর্বক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্যই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি এবং তার বাস্তবায়নের জন্য একজোট । ইরানের ঘটনায় তাই প্রমাণ করে। জো বাইডেন নির্বাচনের পূর্বে ঘোষণা করেছিল ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে ইরানের পারমাণবিক চুক্তিতে আমেরিকা ফেরত যাবে। আজ নির্বাচনের তিন মাস পরেও জো বাইডেনের মুখ থেকে নতুন কোন কিছু শোনা যায়নি। এখনও জো বাইডেনের আমেরিকা সেই পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরত যায় নি। নতুন নতুন অজুহাত সৃষ্টি করা হচ্ছে। জো বাইডেনের টিম বলছে ইরান চুক্তি চলাকালীন সময়ে যে নিয়মকানুনগুলো মেনে চলছিল তা পুনরায় শুরু করতে হবে, তাহলে মার্কিনিরা এই চুক্তিতে ফেরত আসবে এবং আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। এভাবেই ৫ শক্তিধর দেশ পৃথিবীর ক্ষুদ্র দেশগুলোকে নানানভাবে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে । মার্কিনীরা ইরানের তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্যই এই অর্থনৈতিক অবরোধ বজায় রেখেছে। ইরানি তেল আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাভাবিকভাবে প্রবেশ করলে তেলের বাজারের উপর চাপ সৃষ্টি হবে যা সৌদি আরব এবং খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় না, এগুলো সবই বিশ্ব ভূ-রাজনীতির অংশ।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক