বন্দরনগরীর নির্বাচনে ‘ক্ষুদ্র মানুষে’র ক্ষুদ্র ভূমিকা!
নির্বাচনের নামে বন্দরনগরীতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাকে আর যাই হোক, অন্তত 'নির্বাচন' বলা চলে না।
চট্টগ্রামে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাঝে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। মুহূর্তেই গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসা দায়হীন এসব ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মোরশেদ আকতার চৌধুরী নির্বাচনকে 'প্রহসন' আখ্যায়িত করে বয়কট করেছেন। আরেক ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ইসমাইল হোসেন বালিকে নগরীর পাথরঘাটার বাড়ি থেকে আটক করেছে পুলিশ। ইসমাইলের সমর্থকদের সঙ্গে আওয়ামী প্রার্থীর অনুসারীদের সংঘর্ষের অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছে।
তবে, এ সকল ঘটনায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
নগরীর পাহাড়তলীর অপর এক ওয়ার্ডে আওয়ামী সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দীন এবং আওয়ামী বিদ্রোহী প্রার্থী মাহমুদুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে আলাউদ্দীন নামের এক পথচারী নিহত হন।
বিভিন্ন কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) গোপন কক্ষে প্রতি ভোটারের সঙ্গে একজন করে উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, কয়েকজন ভোটারের অভিযোগ অনুযায়ী, তারা কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার আগেই তাদের ভোট নেওয়া হয়ে গিয়েছিল।
ওপরের কোনো ঘটনাই নির্বাচনে কাম্য নয়। নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ নিজের পছন্দ মতো এক বা একাধিক প্রার্থীকে প্রাতিষ্ঠানিক পদের জন্য বাছাই করেন। এই প্রক্রিয়ায় ভোটাররাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের দৌঁড়ে কারা এগিয়ে থাকবেন, তাও ভোটারদের নির্ধারণের বিষয়।
প্রায় সাত দশক আগে স্যার উইন্সটন চার্চিল গণতন্ত্রে ভোটারদের অবস্থান নিয়ে এক চমৎকার ব্যখ্যা দিয়েছিলেন। ভোটারদের তিনি বলেছিলেন লিটল ম্যান বা ক্ষুদ্র মানুষ। চার্চিলের ভাষায়, 'গণতন্ত্রের সকল মর্যাদার প্রকৃত দাবীদার হলো ক্ষুদ্র মানুষ। ক্ষুদ্র এক বুথে পেন্সিল হাতে প্রবেশ করা, এক টুকরো কাগজে ছোট একটা দাগ কাটা- রাশভারি বক্তৃতা কিংবা হাজারও আলোচনাও এই একটি বিষয়ের গুরুত্ব কমাতে পারবে না।'
২০১১ সালে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। কেননা, এ ব্যবস্থায় নির্বাচন মধ্যবর্তী প্রশাসনের দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা কেউ জনগণের নির্বাচিত নন। এছাড়াও এ সময় 'লিটল ম্যান' প্রসঙ্গে মুক্ত ও স্বাধীন নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপযোগী পরিবেশের নিশ্চয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
"স্যার উইন্সটন চার্চিলের 'ক্ষুদ্র মানুষদের' পেন্সিল হাতে বুথে ঢুকে এক টুকরো কাগজে নির্বিঘ্ন এবং স্বাধীনভাবে দাগ কাটতে হবে। আর সেই 'লিটল ম্যান" যদি পেন্সিল হাতে বুথে ঢুকে এক টুকরো কাগজে এক ছোট্ট দাগ কেটে নিজের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে গণতন্ত্র হবে এক নামমাত্র বিষয়। সংবিধানে সেই গণতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকবে কেবলমাত্র জনগণের মানসিক প্রশান্তির জন্য।"
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এই ক্ষুদ্র মানুষদের ভূমিকাও ছিল ক্ষুদ্র; কিংবা আসলে তাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না।
সকালের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য মধ্যাহ্ন বিরতির পর অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রই ছিল পরিত্যক্ত।
স্থানীয় ক্ষমতাসীন দল থেকেই কাউন্সিলর পদের জন্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের আবির্ভাব ঘটে। ফলে নির্বাচনের উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। প্রার্থীরা যে কোনো উপায়ে নির্বাচনে জয় লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। পরিণতিতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
সহিংসতা ও অনিয়মের কারণে নির্বাচন বানচাল হওয়ার সম্ভাবনা সপ্তাহখানেক আগে থেকেই দেখা দিয়েছিল। নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালীন ক্ষমতাসীন দলের কাউন্সিলর প্রার্থী এবং বিদ্রোহী প্রার্থী যারা ঐ একই দলের সদস্য- দুই দলের সমর্থকদের সংঘর্ষে দুজন নিহত হন। গত মাস থেকেই কয়েক দফায় মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
নির্বাচন কমিশন পুরো সময় জুড়েই নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করে গেছে। অথচ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব তাদের। নির্বাচনী অনিয়ম ইসির ব্যর্থতার দিকেই ইঙ্গিত করে। সবার জন্য সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র তৈরিতে তারা ব্যর্থ। এখানে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
নির্বাচন কমিশন কী করতে পারত?
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনের হাতে অসীম ক্ষমতা থাকে। নির্বাচনের দায়িত্ব পালনরত সকলকে নির্দেশনা দেওয়া থেকে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা কমিশনের হাতে ন্যস্ত থাকে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন উপযোগী পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে, ইসি সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে সহায়তা কামনা করতে পারে। এমনকি নির্বাচন স্থগিত করার ক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে।
তবে বন্দরনগরীতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তারা কেবল নির্বাচন পরিচালনার 'সাংবিধানিক' দায়িত্ব পালন করে গেছে। তবে সেই নির্বাচন নিরপেক্ষ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে কমিশনের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ে উচ্চ আদালতের বক্তব্য আজও প্রাসঙ্গিক। আদালত বলেছিলেন, 'সরকারি কার্যরীতিতে নিয়ন্ত্রণ, বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন কিংবা অনৈতিক প্রভাব খাটানো ইত্যাদি অসদুপায় অবলম্বন করে নির্দিষ্ট প্রার্থী কিংবা দলের কেউ নির্বাচনে জয় লাভ করলে, তা প্রকৃত পক্ষে গণতন্ত্রের পরাজয়।'
- লেখক: উপ নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
মূল লেখা: When 'little man' matters little
অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা