পাস অব দ্য সেঞ্চুরি!
গোল তো কতই করেছেন। তবে একই ম্যাচে ওই দুটি গোল সমার্থক হয়ে গেছে ডিয়েগো ম্যারাডোনার নামের সঙ্গে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত গোলের কথা উঠলে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ম্যাচে ম্যারাডোনার দ্বিতীয় গোলটির প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে শুধু চার মিনিট আগে তাঁরই প্রথম গোলটি।
এ সবই তো পুরনো কথা। সবারই জানা। তাহলে বলছি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো! 'গোল অব দ্য সেঞ্চুরি' তকমা লেগে যাওয়া দ্বিতীয় গোলটির জন্য কার কাছে ঋণী ম্যারাডোনা?
প্রশ্নটা অবান্তর মনে হচ্ছে? হতেই পারে। বিশ্বকাপে একক কৃতিত্বে সবচেয়ে বিখ্যাত গোলে আবার কার কাছে ঋণ থাকবে! এই গোল তো শুধুই ম্যারাডোনার। বাকি সবাই তা মনে করলে কি হবে, হেক্টর এনরিকের এতে তুমুল আপত্তি আছে। এই হেক্টর হেনরিকেটা আবার কে, ভেবে ভুরু কুঁচকে গেছে নাকি আপনার? আগে থেকেই যদি জানা থাকে, তাহলে মাফ করে দেবেন। তবে আপনার দলে খুব বেশি মানুষ আছেন বলে মনে হয় না।
হেক্টর হেনরিকে বিশ্বকাপজয়ী এক আর্জেন্টিনিয়ান মিডফিল্ডার। হ্যাঁ, ১৯৮৬ বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনা দলে খেলেছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে উৎসব চলছে। এরই মধ্যে ম্যারাডোনা হোর্হে ভালদানোকে জানাচ্ছেন, ড্রিবল করতে করতেই চোখের কোনে তিনি গোলের সামনে ফাঁকায় দাঁড়ানো ভালদানোকে দেখেছেন। একবার তাঁকে পাস দেবেন ভেবেও আর দেননি। যা শুনে ভালদানো কপট রাগ করে বলছেন, 'কী বলছ? আমাকে দেখার পরও তুমি নিজেই ওই গোলটা করেছ? এটা রীতিমতো আপত্তিকর, খুবই অপমানজনক। এটা হতেই পারে না।'
হেক্টর হেনরিকে তখন শাওয়ারে। বেরিয়ে এসে তিনি বললেন, "গোলটার জন্য আমি ওর (ম্যারাডোনার) অনেক প্রশংসা শুনছি। অনেক প্রশংসা। কিন্তু কেউ এটা বলছে না, আমি ওকে যে পাসটা দিয়েছি, তা পেয়ে ওর গোল না করে কোনো উপায় ছিল?"
পাস যে দিয়েছিলেন, এটা সত্যি। তবে ম্যারাডোনা হেক্টর হেনরিকের ওই পাসটা পেয়েছিলেন নিজেদের অর্ধে। যে পাস থেকে 'গোল অব দ্য সেঞ্চুরি' সেই পাসেরও তো স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। হেনরিকের ওই পাসকে তাই অনেকে বলতে শুরু করেন 'পাস অব দ্য সেঞ্চুরি।' আর্জেন্টিনিয়ানরা রসিক বটে!
১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাময় আর্জেন্টিনা দলের আরও বেশ কজন খেলোয়াড়ের নাম বলতে পারি। তবে এই অমর বাণী না দিলে হেক্টর এনরিকের নাম মনেই থাকত না। গায়ের রং ফর্সা হওয়ার পরও যাঁকে সবাই ডাকত 'এল নিগ্রো' বলে।
ওয়ালশ যখন 'এল নিগ্রো'
ম্যারাডোনার গোলে তাঁর পাসের ভূমিকা নিয়ে হেক্টর এনরিকের দাবি সংক্রান্ত গল্পটা যতবার পড়ি বা বলি, অবধারিতভাবে আমার কোর্টনি ওয়ালশকে মনে পড়ে যায়।
১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্রিজটাউনে ব্রায়ান লারার অপরাজিত ১৫৩ রানের ওই ক্ল্যাসিক ইনিংসটির কথা কি মনে আছে? ম্যারাডোনার ওই গোল যেমন একক কীর্তিধন্য, ব্রিজটাউনের ওই টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ও বলতে গেলে লারার একক অবদান।
এখানেও অবশ্য একজন 'হেক্টর এনরিকে' আছেন। নামটা আগেই বলে দেওয়ার তিনি কে, তা তো অনুমান করতেই পারছেন। ৩০৮ রানের জয়ের লক্ষ্য থেকে ৬ রান দূরে থাকতে পড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের নবম উইকেট। শেষ ব্যাটসম্যান কোর্টনি ওয়ালশ। যাঁর ব্যাটিংয়ে নিখাদ বিনোদন ছিল, কিন্তু এক বলের জন্যও নির্ভর করার মতো কোনো উপাদান ছিল না। ওয়ালশ অবশ্য সেদিন ৫ বল টিকে যান। রান-টান করতে পারেননি, তার দরকারও ছিল না। সে জন্য লারা ছিলেন। অবিশ্বাস্য ওই জয়ের (২৪৮ রানে পড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের অষ্টম উইকেট) পর ওয়ালশ বলেন, "আই ওঅন দ্য ম্যাচ উইথ আ বিট অব হেল্প ফ্রম ব্রায়ান লারা।"
ওয়ালশকে অনেক উদারই বলতে হয়। লারার সামান্য সহায়তার কথা স্বীকার না করলেও তো পারতেন!
- লেখক: সাংবাদিক