পেগাসাস কেলেঙ্কারি ও ভারতের রাজনীতির নতুন বাঁক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ৯ আগস্ট ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৭২ সালের ১৭ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযান চলাকালীন ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দল ও প্রশাসনের ৫ ব্যক্তি ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটার গেইট ভবনস্থ বিরোধী ডেমোক্র্যাট দলের সদর দপ্তরে আড়িপাতার যন্ত্র বসায় এবং নিক্সনের প্রশাসন কেলেঙ্কারিটি ধামা-চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।
বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। অন্যের টেলিফোনে আড়িপাতা গর্হিত অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। এরপর দীর্ঘ তদন্ত, শুনানী অবশেষে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদত্যাগ ও ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায়। ইতিহাসে নাম লেখালেন মার্কিন দুই সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন ও বব উডওয়ার্ডকে। যাদের অনুসন্ধানী রির্পোটিংয়ে প্রকাশ পেয়েছিল ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি খ্যাত ঘটনাটি।
সভ্যতার প্রয়োজনেই মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দেশে দেশে শক্ত আইনও আছে। মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মৌলিক মানবাধিকারের অংশ। আমাদের দেশের সংবিধানেও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা দেওয়া আছে। কিন্তু ইতিহাসের চাকা থেমে থাকেনি। নানা নামে ও বিবিধ প্রয়োজনে 'সভ্যতার প্রয়োজনেই' মানুষের গোপনীয়তায় আড়িপাতার বৈধতা দেয়া হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা, বৈদেশিক সম্পর্ক, মামলার তদন্ত ইত্যাদির প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশ তার মত করে আইন তৈরি করে নিয়েছে। আমাদের দেশে ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ আইন পাস হয় এবং ২০১০ সালে তা সংশোধিত হয়। এ আইনে ফোনে আড়িপাতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে, গোয়েন্দা সংস্থা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্ত সংস্থার মতো সরকারি সংস্থাগুলো এই আইনের আওতার মধ্যে পড়বে না। এর বাইরে যে কোন ব্যক্তির কথোপকথন আড়ি পেতে রেকর্ড করলে বা প্রচার করলে দুই বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এরই মধ্যে প্যারিসভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দুনিয়া জুড়ে ৫০হাজারের বেশি ফোনে আড়িপাতার ঘটনা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। তালিকায় অন্তত ১৪ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান রয়েছেন। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এই তালিকায় রয়েছেন। এই ঘটনায় গোটা বিশ্ব আবার একটু নড়েচড়ে বসেছে।
আমাদের পাশের দেশ ভারতের রাজনীতি এখন উত্তাল ফোনে আড়িপাতা প্রশ্নে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী দল, সাংবাদিক, ব্যবসায়িক নেতা, বর্তমান ও সাবেক আমলা প্রায় ৩০০ জনের অধিক ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে। এই আড়িপাতার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি করা পেগাসাস স্পাইওয়্যার। এটা এমনই উন্নত প্রযুক্তি যা খুব সহজে টার্গেটেড ব্যক্তির মোবাইল, ল্যাবটপ বা ট্যাবে প্রবেশ করে সকল ডাটার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। ফলে কথোপকথন থেকে শুরু করে সংরক্ষিত সকল ছবি ও তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। ইসরায়েল জানিয়েছে, তাদের এই সফটওয়্যার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হলেও এর ক্রেতা কেবলমাত্র কোন দেশের 'বৈধ' সরকার। ইসরায়েল যদিও এই 'বৈধ' সরকার বলতে কী বোঝায় তা স্পষ্ট করেনি। ইসরায়েল তাদের উৎপাদিত পণ্যটি ইতোমধ্যে কতগুলো 'বৈধ' সরকারের কাছে পৌঁছে দিয়েছে তার তালিকা প্রকাশ না করলেও ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি তাদের প্রতিবেদনে ৫০টির বেশি রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করেছে যারা, ইসরায়েলের এনএসও উৎপাদিত স্পাইওয়্যার পেগাসাস কিনেছে। উল্লেখিত ৫০টি দেশের মধ্যে এই উপমহাদেশের একমাত্র ভারতের নাম রয়েছে।
ভারতের চলতি বাদল অধিবেশন ইতোমধ্যে উত্তাল হয়ে উঠেছে। পেগাসাস কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর ভারতে রাজনীতি নানা বাঁক নিতে শুরু করেছে। কংগ্রেস, শিবসেনার মত বিরোধী দল যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) তদন্ত দাবি করেছে। কংগ্রেস একধাপ এগিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে। তৃণমুল কংগ্রেস আরো এগিয়ে। পার্লামেন্টে পেগাসাস প্রশ্নে বিবৃতি দেয়ার সময় কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের হাত থেকে বিবৃতিটি কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে পেলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদীয় নেতা শান্তনু সেন।
ফলে পুরো বাদল অধিবেশনের জন্য বহিষ্কৃত হয়েছেন। সকল বিরোধী দল একাট্টা হয়ে বলেছেন, পেগাসাস প্রশ্নে সব উত্তর না পেলে সংসদ চলতে দেওয়া হবে না। সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করছে না। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বক্তব্য জানতে চাইলে তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রক পেগাসাস কাজে লাগানোর অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেনি। তারা বলছে, ব্যক্তি পরিসরের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে সরকার দায়বদ্ধ। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির উপর নজরদারি অভিযোগ ভিত্তিহীন। যে কোনো ফোনে আড়িপাতা, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে নজরদারিতে সরকারি অনুমতি নিতে হয়। আইনের বাইরে কিছুই করা হয়না। নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও টেলিগ্রাফ আইনে পুলিশ, গোয়েন্দা বা তদন্তকারী সংস্থাকে ফোনে বা কম্পিউটারে আড়িপাতার ক্ষমতা দেওয়া আছে। কেন্দ্রের ১০টি সংস্থার হাতে এই ক্ষমতা থাকলেও প্রয়োগের আগে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য স্বরাষ্ট্র সচিবের অনুমতি নিতে হয়।
পেগাসাসের লোগোতে ব্যবহৃত ছবি গ্রিক ও হিন্দু পুরাণ থেকে নেওয়া। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী পক্ষীরাজ ঘোড়া যার জন্ম দানবী মেডুসার রক্ত থেকে। গ্রিক পুরাণে যার নাম পেগাসাস। হিন্দু পুরাণ মতে এই পক্ষীরাজ ঘোড়ার নাম উচ্চৈঃশ্রবা। সমুদ্র মন্থন থেকে উঠে আসা ইন্দ্রের বাহন। এই পেগাসাস এখন মানুষের মৌলিক মানবাধিকার, গোপনীয়তার অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার সর্বোপরি সভ্যতার মূল সুরের বিপরীতে অবস্থান করছে। তদন্তে বেরিয়ে আসছে, ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের সময় রাহুল গান্ধি ও গত বিধান সভা নির্বাচনের সময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট প্রশান্ত কিশোরের ফোনে আড়িপাতা হয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গের মেদেনীপুরের এক দলীয় সভায় বিজেপি'র নব্য নেতা শুভেন্দু অধিকারী পুলিশের এসপি'র উদ্দেশ্যে বলেছেন, "অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিস থেকে কারা আপনাকে নিয়মিত ফোন করে তার তালিকা ও রেকর্ড আমাদের কাছে আছে"। শুভেন্দুর এই বক্তৃতা চলমান জাতীয় বিতর্ককে আরো একটু উস্কে দিল। যদিও জাতীয় পর্যায়ের সবাই এখন আদালতমুখী। নালিশ জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে।
আগামী ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট দিন ঠিক করেছেন, পেগাসাস প্রশ্নে উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে শুনানীর জন্য। বিরোধীদের অভিযোগ ক্ষমতাসীনরা ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও বিরোধীরা বাদল অধিবেশন কার্যত অচল করে রেখেছে। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়ে একাধিক আবেদন ও জনস্বার্থে মামলা জমা পড়েছে। এসব আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত বৃহস্পতিবার দিন নিদির্ষ্ট করে দিয়েছেন। সকল দেশের মানুষ সত্যি বিশ্বাস করে, আদালত হলো শেষ আশ্রয়স্থল। মানুষের এই আশ্রয়স্থলটি ধ্বংস করার চেষ্টাও অবিরত। বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করার মাধ্যমে ন্যায় বিচার বিঘ্নিত করা হয়। সাম্প্রতিক ভারতে কাশ্মীর প্রশ্নে বা তারও আগে রাফায়েল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ে রিল্যায়েন্স প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত ভারতীয় জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে তেমনটি বলা যাবে না।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক