বাংলাদেশে কোভিড-১৯ প্যানডেমিক না সিনডেমিক?
বিশ্বখ্যাত মেডিকেল সাময়িকী 'ল্যানসেট'-এর এডিটর ইন চিফ অধ্যাপক রিচার্ড হর্টন সেপ্টেম্বর ২০২০-এ ল্যানসেটে প্রকাশিত 'কোভিড-১৯ ইজ নট অ্যা প্যানডেমিক' শীর্ষক মতামতে বলেছেন, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারি বা প্যানডেমিক নয়, বরং এটি সিনডেমিক।
সিনেডমিক এর বাংলা প্রতিশব্দ আপাতত খুজেঁ পাচ্ছি না। 'একসঙ্গে কমপক্ষে দুই ধরনের রোগ যদি এপিডেমিক (মহামারি) হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কোনো জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে তাকে সিনডেমিক বলা যায়।'
রিচার্ড হর্টন বলেন, দুই ধরনের রোগ যদি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠির ওপর প্রভাব ফেলে, তখন প্রতিটি রোগের আলাদা আলাদা প্রভাব একত্রিত করলে যা হতো, তার চেয়ে বেশি ক্ষতির আশংকা থাকে। বিষয়টা অনেকটা এক আর এক যোগ করে তিন হয়ে যাওয়ার মতো। দুই ধরনের রোগ একত্রিত হবার কারণে সামাজিক আর অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে; কোভিডের ক্ষেত্রে অনেকটা তাই হয়েছে বলে মন্তব্য করেন রিচার্ড হর্টন।
ডা. হর্টন বলেন, সিনডেমিক অর্থ কেবল কোমর্বিডিটি নয়, বরং কোনো রোগের মহামারির কারণে আর্থ-সামাজিক বড় ধরনের পরিবর্তনও সিনডেমিক হতে পারে। বিশেষ করে এই সুযোগে অসংক্রামক রোগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়া এবং অর্থনৈতিক বড় ধসও কোভিডের অন্যতম পরিণতি।
নব্বইয়ের দশকে মেডিকেল অ্যানথ্রোপলিজস্ট মেরিল সিংগার সর্বপ্রথম সিনডেমিকের ধারণা দেন। এটি আসলে সিনারজেস্টিক এপিডেমিক (মহামারির অতিক্রিয়া)। সিনডেমিকের ক্ষেত্রে জৈবিক আর সামাজিক মিথস্ক্রিয়া রোগের গতি প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে, চিকিৎসা প্রভাবিত হয় সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাতেও মৌল পরিবর্তন আনতে পারে।
তাই কেবল অতিমারি নয়, কোভিড-১৯ মোকাবেলার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ এবং হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণের দিকেও নজর দিতে হবে। সেইসঙ্গে কোভিডের কারণে সৃষ্ট মনোসামাজিক চাপও মোকাবেলা করা অবশ্য জরুরি। ধনী-দরিদ্র সব রাষ্ট্রের জন্যই এই ইস্যুগুলো প্রায় একই রকম। এত ধরনের রোগের সঙ্গে লড়াই, সঙ্গে সঙ্গে লকডাউনের প্রভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দেওয়া প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে ব্যর্থ হলেই প্যানডেমিক আর স্রেফ প্যানডেমিক থাকবে না, পরিণত হবে সিনডেমিকে! আর ক্ষয়ক্ষতি দ্বিগুণ নয়, বহুগুণ হতে পারে।
কোভিড-১৯-এর প্যানডেমিক থেকে সিনডেমিক হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে এর সামাজিক অনুসঙ্গ। প্রবীণ জনগোষ্ঠী ঝুকিপূর্ণ হয়ে ওঠা, স্বল্প আয়ের মানুষের দরিদ্রতর অবস্থান, চিকিৎসা স্বল্পতা, সবোর্পরি ভ্যাকসিন ইস্যু বিষয়টিকে আরও মানবেতর করে তুলছে। শিক্ষা, বাণিজ্য, অর্থনীতি, আবাসন কর্মপরিস্থিতি- সবকিছু মিলিয়ে কোভিড-১৯ প্যানডেমিককে ছাড়িয়ে সিনডেমিকে পরিণত হয়েছে।
অবশ্য নভেম্বরেই ল্যানসেট সাময়িকীতে ডা. হর্টনের লেখার পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি মতামতে মার্কিন গবেষক অধ্যাপক এমিলি মেন্ডেলহল বলেছেন 'দ্য কোভিড-১৯ সিনডেমিক ইজ নট গ্লোবাল: কনটেক্সট ম্যাটারস'। অর্থাৎ, পৃথিবীর সর্বত্র এটি সিনডেমিক হয়ে ওঠতে পারেনি।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দক্ষতার কারণে নিউজিল্যান্ডে কোভিড-১৯ সিনডেমিক হয়ে ওঠেনি। কোভিডের কারণে একটি দেশ রাজনৈতিক আর সামাজিক সূচকগুলো কতটুকু নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, সেটির ওপর নির্ভর করে এটি সিনডেমিক হবে কি না।
অধ্যাপক মেন্ডেলহল মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ অবশ্যই সিনডেমিক- 'অ্যাজ আই বিলিভ কোভিড-১৯ ইজ সিনডেমিক ইন মাই কান্ট্রি (দ্য ইউএসএস)'। তিনি মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোভিড মোকাবেলার সঙ্গে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে, সেইসঙ্গে বর্ণ-বৈষম্য, বিজ্ঞানকে অবহেলা করার প্রবণতা আর দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই রোগটিকে সিনডেমিকের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
গত ১২ ডিসেম্বর সাইকিয়াট্রির লিভিং লিজেন্ড অধ্যাপক নরমান সারটোরিয়াস তার এক লেকচারেও কোভিড-১৯কে 'সিনডেমিক' বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক সারটোরিয়াস বলেন, কোভিডের মনোসামাজিক প্রভাবও অতিমারি হয়ে উঠেছে, তাই এটিকে 'সিনডেমিক' বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশে ২০১৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক জাতীয় জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৬.৭ শতাংশ বিষণ্নতা আর ৪.৭ শতাংশ ছিল উদ্বিগ্নতাজনিত রোগ। কোভিডকালে জাতীয় পর্যায়ে না হলেও ছোট ছোট কিছু গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের উদ্বিগ্নতার লক্ষণ আর প্রায় ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ পাওয়া যায়! এর অর্থ এই নয় যে, সবাই উদ্বিগ্নতা আর বিষণ্নতায় ভুগছেন। কিন্তু এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়, কোভিডের প্রভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সাম্প্রতিককালে অনেকখানিই বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, সাধারণ সময়ের চেয়ে কোভিডকালে মানসিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় কোভিড-১৯ আর মানসিক সমস্যা একসঙ্গে অনেক বেশি সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ কি সিনডেমিক?
এটি নির্ভর করবে মানসিক সমস্যাসহ অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, কোভিড সংক্রান্ত সামাজিক বৈষম্য, অপবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস আর স্বাস্থ্যখাতে নেতৃত্বের ওপর। কোভিড মোকাবেলায় দৃশ্যত বাংলাদেশ তেমন একটা খারাপ অবস্থানে নেই, যদিও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। সামনে রয়েছে কঠিন সময়- একদিকে বাড়ছে করোনার প্রকোপ, সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা এবং আর্থ-সামাজিক টানাপড়েন সবকিছু নির্ভর করছে স্বাস্থ্যখাতসহ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর।
মোট কথা, চ্যালেঞ্জটা কেবল প্যানডেমিক বা মহামারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই নেই এখন আর, সামগ্রিক বিবেচনায় এই আপৎকালীন ব্যবস্থাপনা যত সুন্দর ও দক্ষভাবে করা যায় তার ওপরই নির্ভর করছে এর সাফল্য।
- লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা