বিদেশি চ্যানেল বন্ধই বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল সংকটের মূল সমাধান নয়
বিজ্ঞাপনমুক্ত বা ক্লিন ফিড সম্প্রচার বাস্তবায়নে এক উদ্ভট পদক্ষেপের ফলে ক্যাবল অপারেটররা বিবিসি, সিএনএন এবং জনপ্রিয় জি বাংলা-সহ সকল বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুক্রবার থেকে এই পদক্ষেপ কার্যকর হয়।
এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল মালিকদের তদবিরেই বাস্তবায়িত হয়েছে বলে মনে হয়। ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কাছে তারা বিজ্ঞাপনের আয় হারানোর উদ্বেগ থেকেই এমন পদক্ষেপের জন্য তদবির করেছিলেন। কারণ বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনদাতা তাদের অর্থ ভারতীয় চ্যনেলগুলোকেই দিয়ে থাকেন।
যদিও স্থানীয় চ্যানেল মালিকদের উদ্বেগে যৌক্তিকতা থাকতে পারে, তবে সরকারি সিদ্ধান্ত নিতান্তই একতরফা এবং এটি আমাদের বিভ্রান্ত করছে। নিশ্চিতভাবেই এখানে দর্শকদের আগ্রহ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি; দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও শ্রমজীবী মানুষ তাদের অবসর সময়ে প্রচুর এয়ারটাইম দেখেন। তাদের অধিকাংশই ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলো দেখেন। কথাটি আপনার পছন্দ হোক বা না হোক, সত্য হলো, কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে ভারতীয় চ্যানেলের বিপরীতে বেশিরভাগ বাংলাদেশি চ্যানেল প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হচ্ছে।
ক্লিন ফিড খুবই আকর্ষণীয় একটি ধারণা। আমরা সবাই বিজ্ঞাপনবিহীন টিভি প্রোগ্রাম দেখতে চাই। যদি বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন দেখায়, তাহলে সেটি ব্লক করুন। কিন্তু আপনি যদি উত্তর কোরিয়ার মতো তাদের পুরোপুরি বাদ দিয়ে ফেলতে চান, তাহলে স্থানীয় চ্যানেলগুলোর ক্ষেত্রেও কেন সেটি বাস্তবায়ন করবেন না?
স্থানীয় চ্যানেলগুলো এয়ারটাইমে এত বেশি বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে, প্রোগ্রামের তুলনায় অনেক সময় বিজ্ঞাপনই বেশি সময় ধরে প্রচারিত হয়। ২০ মিনিটের একটি নাটকে ৪০ মিনিটের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে তা শেষ হয় ১ ঘণ্টায়।
স্থানীয় চ্যানেলগুলো কেন এত বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করে? এর কারণ হলো, বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে চ্যানেলগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা। এটি বিজ্ঞাপনের দামও উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়। বিটিভিতে পিক আওয়ারে প্রতি মিনিট বিজ্ঞাপনের জন্য খরচ হয় সর্বোচ্চ ৯০ হাজার টাকা এবং অফ-পিক আওয়ারে তা নেমে আসে ৪৫ হাজার টাকায়। অন্যদিকে, কিছু বেসরকারি চ্যানেল বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে প্রতি মিনিট এয়ারটাইম বিক্রি করে মাত্র কয়েক হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকায়।
প্রতি মিনিটে কম আয় হওয়ার মানে হলো, তারা তাদের অনুষ্ঠানের খরচ মেটাতে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই বেশি মিনিট বিজ্ঞাপন বরাদ্দ করবে।
তারপর আবার, বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের চ্যানেলগুলোর প্রতি খুব একটা আগ্রহী নন। হবেনই বা কেনো? এই চ্যানেলগুলো, এমন কন্টেন্ট তৈরিতে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করে না, যা লোকে দেখবেন। অন্যদিকে, ভারতীয় চ্যানেলগুলো যে কন্টেন্টই তৈরি করুক না কেন, সেখানে তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে বিনিয়োগ করে।
বিটিভি এখনো ৫০ মিনিটের একটি টিভি নাটক তৈরি করতে প্রায় চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে, যেখানে নামকরা বেসরকারি চ্যানেল একই নাটকের জন্য দুই লাখ টাকার বেশি খরচ করতে চায় না। ২০ থেকে ২৫ মিনিটের নাটকের জন্য কিছু চ্যানেল, প্রযোজক/পরিচালককে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা দিতে চায়; কিছু দিতে চায় ৪০ হাজার, আবার এমন কিছু চ্যানেলও আছে যারা কন্টেন্টের জন্য টাকা দেওয়ারই প্রয়োজন মনে করে না। এটাই বাস্তবতা। টিভির জন্য ভালো প্রোগ্রাম তৈরি করতে কে ক্ষতি স্বীকার করতে চায়?
এর ফলে ভাল লেখক ও পরিচালকরা সৃজনশীল কন্টেন্ট তৈরি করা থেকে দূরে সরে গেছেন। আর সেখানে ভারতীয় চ্যানেলগুলো ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে পুরস্কার জেতার একটি ভালো সুযোগ পেয়ে গেছে। তারা যা তৈরি করছে, তা হয়তো আপনার পছন্দ নাও হতে পারে; কিন্তু মূল কথা হলো, বয়স্ক মানুষ ও শ্রমজীবীরা এগুলো অনেক বেশি দেখেন। কারণ তাদের অনুষ্ঠানগুলো বিনোদনমূলক; যেখানে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো দর্শকদের এই সন্তুষ্টির জায়গায় ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।
স্থানীয় চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যা আয় করছে, সেটি না পেলে তারা মারা যাবে। কিন্তু বাণিজ্যিক সত্তা হিসেবে তাদের অধিকাংশ কি সত্যিই কার্যকর? তাদের অধিকাংশেরই সৃজনশীলতা বা দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। তারা কোনো কিছুতেই বিনিয়োগ করে না এবং নিজেদের ব্যবসায়িক মডেল হিসেবে একটি 'কপি ও পেস্ট' সূত্র অনুসরণ করে।
বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করলে দেশীয় চ্যানেলগুলোর মূল সমস্যার সমাধান হবে না।
আমরা যারা প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়া নিয়ে কাজ করছি, আমরাও তাহলে স্থানীয় টিভি চ্যানেলের মতো, ফেসবুক ও গুগল বন্ধের দাবি করতে পারি। কারণ ইন্টারনেটের এই একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে আমরাও বিজ্ঞাপন থেকে আয় হারাচ্ছি। ফেসবুক ও গুগল আমাদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিজ্ঞাপন আয় ছিনিয়ে নিচ্ছে। দেশের সমস্ত মিডিয়া হাউসের চেয়ে এই দুই সংস্থার বিজ্ঞাপন আয় অনেক বেশি।
কিন্তু সরকারকের কাছে এই দাবি নিয়ে যাওয়া কি ন্যায়সঙ্গত হবে? আমরা তা মনে করি না।
আপনাদের হয়তো মনে আছে, স্বাধীনতার পর সরকার দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কি আমাদের এই শিল্পে ফেদেরিকো ফেল্লিনি কিংবা রিডলি স্কটের মতো মানুষ এনে দিতে সাহায্য করেছিল? আমি দুঃখিত, তা করেনি। আজ বাংলাদেশি চলচ্চিত্র শিল্প মৃত্যুশয্যায়।
অতএব, সরকারের উচিত বিদেশি চ্যানেল বন্ধের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা। এমন একটি প্রযুক্তি থাকতে হবে যা বিজ্ঞাপনগুলোকে ব্লক করবে, তবে তা অনুষ্ঠান সম্প্রচারকে বাধাগ্রস্ত করে নয়। আমরা বিবিসি চাই। আমরা খবর চাই। আমরা এইচবিও, জি বাংলা এবং কার্টুন নেটওয়ার্ক চাই। আমরা এই উন্মত্ত, জরাক্রান্ত পৃথিবীতে বিনোদন চাই। আমরা বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে চাই; যেমনটি আমরা ইতোমধ্যে ইন্টারনেট ও স্ট্রিমিং পরিষেবা মাধ্যমে রয়েছি। বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়।
- লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: Shutting foreign channels won't solve the real Bangladeshi TV crisis
- অনুবাদ: জান্নাতুল তাজরী তৃষা