বিশ্বব্যবস্থায় নতুন মেরুকরণ, কী কৌশল অবলম্বন করবে বাংলাদেশ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে পশ্চিমা বিশ্বের যে মেরুকরণ ছিল, সম্প্রতি তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্ব এখন নতুন মেরুকরণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। নতুন এই মেরুকরণের পেছনে প্রধান শক্তি হচ্ছে আজকের চীন।
১৯৪৯ সালে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার আলোকে পরিচালিত চীন এই ৭০ বছরে এগিয়েছে অনেক। প্রথম ৪০ বছর তেমন কোনো সফলতা দেখাতে না পারলেও নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে চীন ক্রমান্বয়ে বিশ্ববাণিজ্যে প্রবেশ করতে থাকে। সর্বশেষ চীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মার্কিন অর্থনীতির সমকক্ষ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে।
বিশ্বের সকল পণ্য উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে চীন। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের এই অবস্থান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মেনে নিতে পারেনি। নিজ দেশে জাতীয়তাবাদী ধারণা উসকে দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বাণিজ্য অবরোধ আরোপ শুরু করেন তিনি।
৯০ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পশ্চিমাদের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রধান রাজনৈতিক শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯২ সালে ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার অবস্থানের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।
রাশিয়া নিজের দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বলয়ের পরিধি সীমিত করে ফেলে। বলা চলে, এই সময় হতেই চীন বিশ্ব বাজারে প্রবেশ করতে থাকে। অল্পদিনেই চীন বিশ্ব অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য অংশের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রচুর বিনিয়োগ করে চীন।
আক্রমণাত্মক অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া চীনের অর্থনীতি এশিয়াতেও ব্যাপকতা পেতে থাকে। চীনের বন্ধু রাষ্ট্র পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা দেশটিকে আজ দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। একই অবস্থা শ্রীলংকাতেও। শ্রীলংকার বর্তমান কৃষি সংকট এক বিশাল খাদ্য সংকটে পরিণত হতে যাচ্ছে।
এতসব খারাপ অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গভীর। পদ্মাসেতুর অর্থায়ন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করে চীন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। বেশ কিছু বড় প্রকল্প চীনের অর্থায়নে পচিালিত হচ্ছে। চীন আজ আমাদের বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী দেশ।
যদিও এখন বিশ্বব্যাপী চীন বিরোধী আবহাওয়া সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্ব আবার এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে। এখানে বেশ কিছু তৎপরতা লক্ষণীয়। এর মধ্যে, ২০১৭ সালের চতুর্দেশীয় জোট কোয়াড অন্যতম।
ভৌগলিকভাবে চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখতে সক্ষম এমন দেশগুলোকে নিয়ে জোট গঠনের প্রথম ভাবনা ছিল জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে'র। চীন বিরোধী জোট গঠনের পেছনে প্রধান কারণ, চীনের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির ধারা। এটাকে রোধ করতে না পারলে বিশ্ব রাজনীতির পশ্চিমা কর্তৃত্বের বদল ঘটতে পারে। এর সাথে যুক্ত হয় জাপানের সঙ্গে চীনের ভু-রাজনৈতিক বিরোধ। ২০১২ সালে শিনজো আবে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর জাপান দক্ষিণ চীন সাগরে জনবসতিহীন কয়েকটি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে চীনের সাথে তুমুল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।
প্রশান্ত মহাসাগরের অংশ এই দক্ষিণ চীন সাগর দিয়ে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। সাগরের চারপাশে চীন, তাইওয়ান, ফিলিপিনস, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। সে কারণে এই সাগর ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া, এই জায়গাটি প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে পরিপূর্ণ। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যকার সংযোগ, বাণিজ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে সাগরের জলসীমা নির্ধারণ ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় চীনের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিরোধ তুঙ্গে।
পরাশক্তিধর দেশগুলো যেকোনো মূল্যে দক্ষিণ চীন সাগরে ঘাঁটি স্থাপন করে এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে চীনের পারস্পারিক সম্পর্কের বদল ঘটছে প্রতিনিয়ত।
মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানকারী দেশ চীনের সঙ্গেও ভিয়েতনামের সম্পর্কের বদল ঘটেছে। কিছুদিন আগে মার্কিন নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিয়েতনাম সফর করেছেন। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ভিয়েতনাম- মার্কিন সম্পর্ক এখন অনেক গভীর।
তৈরি পোশাক খাতে মার্কিন বাজরে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগকারী দেশ এখন ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামে বস্ত্রখাতে চীনা বিনিয়োগ সর্বাধিক। চীনা বেসরকারি খাত ব্যাপক বিনিয়োগ করে ভিয়েতনামে। ভিয়েতনাম বিদুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন, বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ ও তুলনামূলক সস্তা শ্রমশক্তির কারণে চীনসহ বিদেশি বিনোয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিল। তবে, চীন সরকার এখন ভিয়েতনামে চীনাদের বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া ত্রিদেশীয় 'বিশেষ নিরাপত্তা' চুক্তি করেছে। এই চুক্তির আওতায় উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করবে। নতুন এই চুক্তি অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবারের মত পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরিতে সাহায্য করবে।
যদিও এই চুক্তির কারণে পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোর বিরোধিতার মুখে রয়েছে স্বাক্ষরকারী তিনটি দেশ। ত্রিদেশীয় চুক্তি 'অকাস'-এর কারণে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের ৪০ বিলিয়ন ডলারের ১২ টি পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।
ক্ষুদ্ধ ফ্রান্স পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য তিন দেশ থেকে তাদের কূটনীতিকদের ডেকে পাঠিয়েছে। এর আগে পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষেত্রে কখনো এমনটি ঘটেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফ্রান্সের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে।
কিন্তু বাইরে যাই থাকুক না কেন, এই চুক্তির অন্তরালে রয়েছে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তিবৃদ্ধি ও এই অঞ্চলের কর্তৃত্বের রাশ টেনে ধরা। স্বাভাবিক কারণেই চীন এই উদ্যোগের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একে হুমকি বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। চীন এখন নানামুখি বৈশ্বিক বৈরিতার সম্মুখীন।
এমন একটি বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমরা চীনের সঙ্গে কতটা গভীর ভাবে জড়িত থাকব, তা এখন ভেবে দেখতে হবে। আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান খাত এখনো তৈরি পোশাক। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ আসে এই খাত হতে। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এর আগেও বহুবার দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও চিন্তার সঙ্গে কোনো দেশ তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে রপ্তানিকারক দেশকে বড় ধরনের বাণিজ্যিক অসহযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। তেমন কিছু ঘটলে আমাদের বর্ধনশীল রপ্তানি বাণিজ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সমস্ত লেনদেন মার্কিন ডলারে। যার ফলে মার্কিন অর্থব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের যাতায়াত করতে হয়। আগামী দিনগুলোতে ক্রমবর্ধমান চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব বিশ্বের নব মেরুকরণ কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে, তা আমরা জানি না। পক্ষ নেবার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক ও আরো কৌশলী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
পাশের দেশ ভারতের সঙ্গে চীনের বৈরিতা দুই দেশকে যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড় করিয়েছে। এ রকম অবস্থায় চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভারতের সাথে বৈরিতার মধ্যে ফেলবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ব্রিকস দাঁড়াতে পারেনি। ভারতের কংগ্রেস আমলে যতটা এগিয়েছিল, বর্তমান হিন্দু উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ পিছিয়ে দিয়েছে তার চেয়েও বেশি।
ব্রিকস বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাধা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ব্রিটেন ইতোমধ্যে ইইউ থেকে বের হয়ে গেছে। এমন একটি বিশ্ব পরিস্থিতিতে কূটনীতিকদের নতুন রসায়নের দিকে সর্বদা নজর রাখতে হবে।
পদক্ষেপ নিতে ভুল হলে আমাদের অন্যতম প্রধান রপ্তানি বাণিজ্য তৈরি পোশাক বাজার হারাবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাণিজ্য হতে ছিঁটকে গেলে ফিরে আসা কঠিন। আমাদের প্রবাসী আয়ের বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার নেতিবাচক ধারা শুরু হতে পারে বলে অনেকে আগাম ধারণা করছেন।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঢেউ এখন বিশ্বময়। মানুষ কাজ হারাবে। আমাদের প্রবাসী আয় এখন বড় হুমকি। আমাদের রিজার্ভ এবং বৈদেশিক ঋণ অনুপাত প্রায় সমান। আগামী বছরগুলোয় এসব ঋণের পেমেন্ট শুরু হলে অবস্থা কী দাঁড়াবে তা এখন থেকে ভাবতে হবে।
আমাদের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু, আত্মতৃপ্তি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি আয়, এই দুই ধারা যেকোনো মূল্যে অব্যাহত রাখা না গেলে আমরা মহাসংকটে পতিত হব।