ভাইরাস মোকাবেলায় সৈন্য প্রেরণের খবর: ভারতীয় মিডিয়ার ব্যর্থতা
ভারতীয় গণমাধ্যম প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার (রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম) উদ্ধৃতি দিয়ে গত ২১ এপ্রিল ঘোষণা করল যে, সার্কভুক্ত দেশগুলোতে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সহায়তা দিতে ভারত তার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করছে।
সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং ভুটানের নাম উল্লেখ করা হয়। নেপাল কিংবা পাকিস্তানের নাম সেখানে ছিল না।
ঘোষণায় প্রতিবেশি দেশ হিসেবে এই দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নেপাল ভারতের অন্যতম প্রতিবেশি। রাজতন্ত্রের আমলে দেশটি পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র ছিল। ভারতের একচ্ছত্র বাজার ছিল এই হিন্দু রাষ্ট্রটি, যেখানে ভারতীয় মুদ্রা স্বাভাবিক লেনদেনে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
নেপালের সঙ্গে ভারতের সেই গভীর সম্পর্ক নষ্ট হয়, নেপাল যখন রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে নতুন শাসনতন্ত্র রচনার দিকে এগোয়। নেপালের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালিদের এক ধরনের দ্বন্দ্ব বিরাজমান।
নেপালের যে অঞ্চলে ভারতীয় বংশদ্ভূত মানুষদের বসবাস ছিল, সেই এলাকা নেপালীরা দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। ফলে সরবরাহ বন্ধ থাকায় নেপালের অন্য অংশের জনজীবনে এক দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি হয়।
ওই সময়ে চীন তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। হিমালয়ের বুক চিড়ে পথ বানিয়ে চীনের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেয় যা কিনা নেপালের প্রথম সরাসরি সমূদ্র বন্দর ব্যবহারের সুযোগ। ভারত নেপালের সম্পর্ক সার্ক কাঠামোতে সীমিত হয়ে পড়ে। হয়ত সেই কারনে অথবা করোনা ভাইরাসের তেমন কোন উপস্হিতি না থাকাতে হয়ত নেপালের নাম উচ্চারিত হয় নাই ভারতীয় সহযোগিতার ঘোষনায়।
এদিকে, পাকিস্তান আর ভারতের বৈরীতা কাশ্মীর ইস্যুতে অনেক গভীর। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য অস্ত্র ব্যবসা এই দুই দেশের কাছে।
ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব গত তিন দশকে গভীরতা হারিয়েছে অস্ত্রকে কেন্দ্র করে। নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর রাশিয়া কিংবা প্রাক্তন সোভিয়েতভূক্ত দেশগুলোর কেউ আর তেমন ফেরত আসতে পারেনি অস্ত্র বাজারে।
নিজেদের ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অস্ত্র ব্যবসায় নতুন প্রযুক্তির তেমন বিকাশ ঘটাতে পারেনি তারা। সেই সুযোগে ইসরাইল ও আমেরিকার ভারতীয় বাজারে অস্ত্র বিক্রির পথ উন্মুক্ত হয়েছে।
ট্রাম্প ও তার দেশ কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান ও ভারতের সংকট নিরসনে ইচ্ছা প্রকাশ করে। আসলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আরও নতুন টেকনোলজির অস্ত্র হস্তান্তর করার ইচ্ছা তার।
এ ক্ষেত্রে শুধু পাকিস্তান নয়, চীনও একটা ইস্যু। চীন দীর্ঘকাল ধরে বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্যে ব্রিকস ব্যাংক চালুর চেষ্টা করছে।
শ্রীলংকায় ভারতীয় কুটনীতি গত শতাব্দীতে পরাজিত হয় যখন রাজীব গান্ধী সেখানে সৈন্য পাঠান তামিল সংকটের সময়ে। দেশটি দীর্ঘকাল ভারতীয় বংশোদ্ভূত তামিলদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ভারতীয় তামিলরা শ্রীলংকাকে বিভক্ত করে ফেলেছিল। পরিশেষে এক ব্যাপক যুদ্ধে তামিলরা সম্পূর্ণ পরাজিত হয় শ্রীলংকার সরকারি বাহিনীর হাতে।
অন্যদিকে, এই শতাব্দীর প্রথম দশকেই চীন কূটনৈতিক সম্পর্কে ভারতকে ছাড়িয়ে যায়। গভীর সমুদ্র বন্দরসহ চীনাদের ব্যাপক বিনিয়োগ ঘটে শ্রীলংকায়।
প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার উদ্ধৃতিতে সেনা পাঠানোর এই সংবাদ বাংলাদেশের কয়েকটি মধ্যমমানের পত্রিকা প্রকাশ করে। একটি ইংরেজি দৈনিক প্রথমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্ধৃতিতে খবরটি ভিত্তিহীন এবং এই ধরনের সেনা সহযোগিতার প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করা হয়।
এরপর শ্রীলংকা এবং আফগানিস্তানও এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা নাকচ করে প্রায় অভিন্ন ভাষায়।
সংবাদটি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী চারদিন এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। চারদিন পরে ভারতীয় সরকার উল্লিখিত সংবাদটি ভুয়া হিসাবে আখ্যায়িত করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া সংবাদটি প্রকাশের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কিংবা সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে খবরটি ভিত্তিহীন হিসেবে উল্লেখ করা হলো না। চারদিন সংবাদটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সত্য হিসেবে টিকে থাকল, যার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল দেশ আঞ্চলিক নতুন শক্তির আবির্ভাব লক্ষ্য করল।
অন্য দেশগুলোর মতামত ছাড়া যে এই ধরনের সৈন্য পাঠানো যায় না, তা কি প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া কিংবা ভারতীয় গণমাধ্যম জানে না? তাহলে খবরটি সত্যতা যাচাই না করে কিংবা পিটিআই কেন খবরটি প্রকাশ করল? এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের স্থূলতাই প্রমাণিত হলো।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।