ভারতের লোকসভা নির্বাচন: মোদী বিরোধী হিসেবে এগিয়ে থাকবেন কারা?
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের আসন্ন ১৮ তম লোকসভা নির্বাচনের এখনো ঢের সময় বাকি। সংখ্যার বিবেচনায় সেই অপেক্ষার প্রহর বছর তিনেক হলেও রাজনীতির আঙিনা জানান দিচ্ছে ভিন্ন কিছু। ফুটবলে মৌসুম শুরুর আগে যেমন ক্লাবগুলোর মধ্যে একধরনের তোড়জোড় লক্ষ্য করা যায় ঘর গুছানো নিয়ে, ঠিক সেইরকম তাড়নায় ইতোমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশের বহু রাজনৈতিক দল।
চতুর্দিকে যখন বিজেপির জয়জয়কার চলছিলো, ঠিক সেই মুহুর্তে পশ্চিমবঙ্গে মোদি-শাহদের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে টানা তৃতীয় বারের মত ক্ষমতায় আসা মমতারও চোখ এখন দিল্লির মসনদের দিকে। বলা বাহুল্য, সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রীর এই মেয়াদে প্রথম দিল্লি সফর।
ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে কাগজে কলমে জাতীয় পর্যায়ের দলের অভাব না থাকলেও বাস্তবে এমন প্রভাবসম্পন্ন দল বলতে গেলে শুধু কংগ্রেস আর বিজেপি-ই, যাদের মধ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট আবার ক্ষমতায় আসীন। সেই হিসাবে দেশজুড়ে বিরোধী দলের ভূমিকা রাখার যোগ্যতা আছে শুধু কংগ্রেসের, কিন্তু মানতেই হবে তাদের আগের সেই জৌলুশ আর নেই। তবে কার্যকরি বিরোধী দলের ভূমিকায় ইদানিং সিএএ বিরোধী আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন সহ হালের পেগাসাস কেলেংকারিতে সরব দেখা যাচ্ছে আঞ্চলিক দলগুলোকেই বেশি। ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই ১৯ সালের মত আবার বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দূর করে জোট গঠনের প্রয়াসে দিল্লিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের নাম বদল, কোভিড পরিস্থিতি আর পেগাসাস ইস্যু নিয়ে যদিও নরেন্দ্র মোদির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তবে মূলত যে জন্য আসা সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রাহুলের উপস্থিতিতে দেখা করেছেন সোনিয়া গান্ধীর সাথে এছাড়াও অন্যান্য দলগুলোর প্রতিনিধিদের সাথেও জোটের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সাক্ষাৎ হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সাথেও যা কংগ্রেস আম আদমি পার্টির মধ্যেও মধ্যস্ততায় ভূমিকা রাখবে।
সোনিয়া গান্ধীর সাথে বৈঠকের পর যদিও মমতা বলেছেন "আমি লিডার নই, ক্যাডার। আমি স্ট্রিট ফাইটার। সকলকে একজোট হতে হবে, একা কিছু করা সম্ভব না"। সরাসরি প্রধানমন্ত্রী হবার বাসনা প্রকাশ না করলেও আসলে সেই উদ্দেশ্যেই তার এতসব আয়োজন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেও আন্না হাজারে কে নিয়ে এমন পরিকল্পনা করেছিলেন তবে তা সফল তো হয় নি সাথে সেবারের ভোটেও খারাপ করেছিলো তার দল তৃণমূল কংগ্রেস। তবে এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন, এপ্রিল-মে'র বিধানসভায় ভূমিধস বিজয়ের পর থেকেই সর্ব ভারতময় তার বন্দনা চলছে। পাশাপাশি ঠিক যে কারণে বিজেপি এত সাফল্য পাচ্ছে সেই মোদির মত জাতীয় পর্যায়ে "ওয়ান ম্যান আর্মির" সংকটে থাকা দলগুলোর তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন মমতা মূলত বিজেপিকে প্রতিপক্ষ বানিয়েই। সে কারণেই মমতার ডাকে জোটের ব্যাপারে আগ্রহ আছে এনসিপি, ডিএমকে, আরজেডি, সমাজবাদী পার্টি, সিপিএম, সিপিআই সহ অন্যান্য বিজেপি বিরোধী দলের।
তবে এই জোট প্রক্রিয়ায় সবচে জটিল এবং এর সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করছে জোটের নেতৃত্ব প্রশ্নে তথা ক্ষমতায় আসলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা নির্ধারণের উপর। এই প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বিভিন্ন রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ আঞ্চলিক দলগুলো তাদের রাজ্যে নেতৃত্ব দিবে আর কংগ্রেস পাঞ্জাব, হরিয়ানা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ সহ তাদের প্রভাব বলয়ে থাকা রাজ্য সমূহের নেতৃত্বে থাকবে। আর প্রধানমন্ত্রীর বিষয়টি নিয়ে যদিও কোন সিদ্ধান্ত হয় নি তবে জোটের সবচে শক্তিশালী দল হিসেবে কংগ্রেসের সোনিয়া গান্ধী বা এনসিপির শারদ পাওয়ারের গ্রহনযোগ্যতাই বেশি। তবে নানা কারণে এই দু'জনের সম্ভাবনা খুব একটা নেই প্রথমত, এমনিতেই তিনি নানা কারণে এখন আর দলীয় কার্যক্রমে ততটা সক্রিয় না তার উপর জন্মসূত্রে বিদেশী হওয়ায় সংবিধান ও রাজনৈতিক বিতর্কের কারণে তিনি ২০০৪ সালেও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নি তাই তার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। অন্যদিকে শারদ পাওয়ারও বয়স তথা স্বাস্থ্যগত কারণে এই দৌড় থেকে দূরে রয়েছেন। এছাড়া ডিএমকের এম কে স্টালিন সাংস্কৃতিক কারণে কেন্দ্রের রাজনীতিতে তেমনভাবে জড়িত না, আর উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী দলের অখিলেশ যাদব রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন নিয়েই ব্যস্ত। জোটের বাইরে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আর বহুজন সমাজবাদী দলের মায়াবতীও আছেন তবে রাজনৈতিক পরিসরে তাদের অবস্থান ঠিক বিজেপি বিরোধী কিনা তা পরিষ্কার নয়। এরপর আছেন কেবল কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী আর তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মূলত এই দুজনের মধ্যেই চলবে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব।
মমতার ইমেজ যতই তুঙ্গে থাকুক দিনশেষে সত্য হল তার দলের অবস্থান শুধু বাংলাতেই সীমাবদ্ধ, তিনি নিজেও জানেন রাজ্যের আর কেন্দ্রের রাজনীতি এক জিনিস না, ঠিক এইখানেই মোদীর সাথে তার পার্থক্য মোদীও একসময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তবে রাজ্য ছেড়ে জাতীয় পর্যায়ে আসতে পেরেছেন পেছনে থাকা শক্তির সংগঠনকে পুঁজি করে। তাই তৃণমূলকে বাংলার বাইরে নিতে না পারলে তার পক্ষে ভাল করা কষ্টসাধ্য হবে। অপরদিকে রাহুল গান্ধী নেতা হিসেবে কংগ্রেসকে একটি নির্বাচনেও জেতাতে পারেন নি বটে তবে গান্ধী পরিবারের উত্তরসূরী হিসেবে ভারতজুড়েই তার সংগঠনের যে বিস্তৃতি তা তাকে চালকের আসনে রাখছে। রাহুল যে নেতৃত্বে থাকতে চান তা ব্যক্ত করেছেন ইতোমধ্যেই, মমতা যখন দিল্লিতে তার দলীয় সাংসদদের নিয়ে সভায় বসেছেন রাহুল তখন তৃণমূল বাদে অন্য ১২ বিরোধী দলের প্রতিনিধি নিয়েই জোট প্রসঙ্গে বৈঠক ডাকেন। কোন রকম পরিবারতন্ত্রের আশীর্বাদ ছাড়াই এই পর্যায়ে উঠে আসা মমতাও ছাড় দিতে যে নারাজ তা টের পাওয়া যায় তার ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে একাধিক জাতীয় নেতার সাক্ষাতে, তার প্রতিষ্ঠান আই-প্যাক আবার তৃণমূলকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ছড়িয়ে দিতে ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনের ইঞ্জিনিয়ারিং এ ব্যস্ত।
আসন্ন এই নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে না পারলে জোটের অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হবে ২০২৯ পর্যন্ত নিঃসন্দেহে। কারণ ইন্দিরা গান্ধীর পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর মত জনপ্রিয়তা ভারতে আর কেউই পাননি, সেই ঢেউয়ে নেতৃত্বশূন্য বিরোধী জোটের তলিয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু না।
সবশেষে, নেতৃত্বের বিষয়টির যদিও বা সুরাহা হয় তারপরও এই জোট কতটা ভাল করবে আর কতদূর গড়াবে তার পরীক্ষা হয়ে যাবে উত্তরপ্রদেশসহ আসন্ন কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনে। কেননা বলা হয়ে থাকে ভারতে ক্ষমতায় তারাই যায় যারা উত্তরপ্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে যেহেতু লোকসভার সর্বাধিক ৮০ আসন উত্তরপ্রদেশের দখলে।
- লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।