মোদির ‘মন কি বাত’ যেভাবে বিজেপির প্রভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে
'মন কি বাত' হিন্দি ভাষার এই বাক্যটির অর্থ হচ্ছে 'মনের কথা'। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘদিন যাবত তার এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন। মূলত ভারতীয় বেতারের মাধ্যমে দেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা ও চিন্তা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এই অনুষ্ঠান।
এই অনুষ্ঠানের মধ্যে গত একশটি পর্বে প্রধানমন্ত্রী তার উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। তবে গত ২৮শে এপ্রিল প্রচারিত 'মন কি বাত' অনুষ্ঠানটির প্রধান সাফল্য হচ্ছে সেদিন পৃথিবীর নানা ভাষায় এমনকি জাতিসংঘের সদর দপ্তরেও তার এই অনুষ্ঠানটি প্রচার করা হয়। জাতিসংঘের সদর দপ্তরেই নয় শুধু, তার এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন ইউনেস্কো প্রধান।
প্রচার মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানটিকে সর্বভারতীয় আঙ্গিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবেই তুলে ধরা হয়। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ভাষণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ছড়িয়ে দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হলো ভারতীয় জনগণের কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার লক্ষ্যসমূহের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করা, কিন্তু এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কি সম্পর্ক? আপাতদৃষ্টিতে এটা বোঝা না গেলেও গভীরভাবে উপলব্ধি করলে বোঝা যায় য্ ভারত আগামী দিনের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। সেই কারণেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের পরিচিতিটাকে বাড়িয়ে তোলা। ভারতের অভ্যন্তরীণ সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করা এবং তার নেতৃত্বের গুণাবলী তুলে ধরা।
'মন কি বাত' অনুষ্ঠানের এই ১০০তম পর্বের প্রচার-প্রচারণায় যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল সেই আঙ্গিকে বিচার করলে এই অনুষ্ঠানটির বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে ততটা গভীর কিছু নয়। হরিয়ানা রাজ্যের বেটি বাঁচাও আন্দোলনের সম্পৃক্ত হওয়া কিংবা হিমালয় পাহাড়কে পলিথিন মুক্ত রাখার মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে তার এই 'মন কি বাত' বেতার কথোপকথনে।
এ অনুষ্ঠানে ভারতের বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নানাজনকে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে। এখন এসব বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কতটা প্রয়োজনীয় গুরুত্ব বহন করে তা বোঝার উপায় নেই।
ইউনেস্কো প্রধানের এই কথোপকথনে অংশ নেওয়াও এক ধরনের প্রচারণারই অংশ। ভারতের শিক্ষার হার এবং মোদি সরকার শিক্ষা নিয়ে কী করছেন সেই ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া ছিল ইউনেস্কো প্রধানের বক্তব্যে। এছাড়া উঠে আসে সবজি বিক্রেতার হাসপাতাল নির্মাণের গল্প, সুভাষিনীর ভারতের পদ্মশ্রী খেতাব জয়। সবজি বিক্রেতা স্বামীর মৃত্যুর পর এই নারী কিভাবে অর্থ সংগ্রহ করে গরিবদের জন্য হাসপাতাল তৈরি করেছেন সেই কাহিনী নতুন করে জেনেছে মানুষ এই মন কি বাত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
বিশ্বের চরম বিভাজন পরিস্থিতিতে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে। চীন ভারতের সংকটের সঙ্গে পশ্চিমারা জড়িত। মার্কিনি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চীনের প্রচেষ্টাকে বাধা দেওয়ার কৌশলে ভারতকে তুলে ধরছে পশ্চিমারা। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দেওয়ার কি যুক্তি তা বোধগম্য নয় এ কথা বলা যেতে পারে।
ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় কংগ্রেসে পার্টির সাধারণ সম্পাদক প্রেসিডেন্ট 'সী' কী বক্তব্য রাখছেন তা জানা দরকার বিশ্বের জনগোষ্ঠীর। জাতিসংঘ কিন্তু প্রেসিডেন্ট সী'র সেই ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা করে না। চীনের দলীয় প্রধানের সেই বক্তব্য বিশ্বের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যে ঢংয়ে মন কি বাতকে প্রচার করা হয়েছে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সেভাবে চীনের প্রেসিডেন্টকে স্থান দেওয়া হয় না। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর অন্য কোন নেতাকেও এই ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে কিনা জানা নেই।
ভারতীয় অর্থনীতি এগিয়ে চলছে দুরন্ত গতিতে। নানা রকমের সংকট, দুর্নীতির বহু কাহিনি ভারতজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার পরেও ভারত অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চলছে। কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত হয়েছে নানান মাত্রায়। বহু কৃষি পণ্য আন্তর্জাতিক বাজার দখল করেছে। আমাদের দেশও অনেক কৃষিপণ্যের জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল। আমরা নির্ভরশীল তুলার উপর, আমরা নির্ভরশীল খাদ্যপণ্যের উপর।
উল্লেখযোগ্যভাবে ভারতের সাফল্য এসেছে স্মার্টফোন রপ্তানি বাজারে। বিগত বছরের স্মার্টফোন রপ্তানি করে ভারত আয় করেছে ১১ বিলিয়ন ডলার, যা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একক পণ্য হিসেবে এগারো বিলিয়ন ডলারের আয় ভারতকে প্রযুক্তির বিকাশের নতুন রাস্তা দেখাচ্ছে।
পরিশেষে এ কথা বলা যায়, নরেন্দ্র মোদির এই মন কি বাত অনুষ্ঠানটি ভারতের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দলের সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে অনুষ্ঠানটিকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অব্যাহত প্রচেষ্টা সার্থক হচ্ছে বলা যায়। মোদী এবং তার রাজনৈতিক দলটি জনগণের কাছে পৌঁছাতে সহায়ক হচ্ছে। ভারতীয় রাজনীতির একটি আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিজেপির ক্ষমতায়নের মাধ্যমে ভারত দীর্ঘকালের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বলয় থেকে বেরোচ্ছে। জওহরলাল নেহেরু দিয়ে শুরু হয়ে রাহুল গান্ধী পরিবারতন্ত্রের একটি ধারাবাহিকতা। যদিও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করছে কংগ্রেস কিন্তু অন্যদিকে রাজ্যগুলোতে পরিবারতন্ত্র তীব্রতা পেয়েছে।
পশ্চিমবাংলায় মমতা ব্যানার্জি সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী আর তার ভাইপো সাধারণ সম্পাদক। এমন অবস্থা মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুতেও। তবে কেন্দ্র পরিবারতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীও সম্পৃক্ত হয়েছেন, যিনি জন্মগতভাবে একজন বিদেশি নাগরিক। ভারতীয় সংবিধানে জন্মগতভাবে বিদেশি নাগরিকদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই। ভারতের সংবিধান রচনাকারীদের মাথায় তখন বিষয়টি আসেনি। তাহলে হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো জন্মগতভাবে মার্কিনী না হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট না হতে পারার বিধান সংযুক্ত করা হতো সংবিধান প্রণয়নের গোড়াতেই।
কংগ্রেস যখন বিগত সময়ে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে জয়লাভ করেছিল তখন বিজেপিসহ অন্যান্য অনেক দল বিদেশিনীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তার পরিণতিতে সোনিয়া গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হননি। সাংবিধানিক প্রশ্নে কাজটি সঠিক ছিল না বেঠিক ছিল সে আলোচনা না করলেও এটি বলা যায় যে ভারতের জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল কেবলমাত্র বৈবাহিক সূত্রে। কাজেই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হননি। তার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। যদিও সেই সময় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ছিলেন বাঙালি প্রণব মুখার্জি। কিন্তু পশ্চিম ভারতের প্রভাব প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে দূরে রেখেছিল।
বর্তমানের বিজেপি ভারতকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের রাস্তা দেখাচ্ছে, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিবর্তনমূলক আইন তৈরি করেছে। এরমধ্যে অন্যতম সিএএ যা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেনি। এছাড়াও মোদি সরকারের বিরুদ্ধে এনকাউন্টারে হত্যার যে অভিযোগ আছে তা নিয়ে কখনো মুখ খুলেননি। এবং আগামী নির্বাচনে মোদির নেতৃত্বেই বিজেপি অংশ নেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।