ভারতের গণতন্ত্রে যত আঘাত
২৬ জুন ১৯৭৫, তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশটির গণতন্ত্রের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হানেন। সেদিন মধ্যরাতে তিনি রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমদকে ঘুম থেকে ঢেকে তুলে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করান।
তখন ইন্দিরার সঙ্গে ছিলেন তার পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, সংবিধানের ৩৫২ ধারা প্রয়োগ করতে হলে প্রথমে মন্ত্রীসভার অনুমোদন নেওয়ার কথা; কিন্তু মিসেস গান্ধী তা নেননি। নিজ মন্ত্রীসভার প্রতি আস্থা ছিল না মিসেস গান্ধীর। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন থেকে ১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত এই জরুরি আইন বহাল ছিল।
সেই সময়ে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর বলে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ৪র্থ সংশোধনী পাস হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থার পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল।
জরুরি অবস্থা জারি করে ইন্দিরা যখন ক্ষমতায়, সে সময়ে দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। মিসেস গান্ধীর জরুরি সরকার বাংলাদেশের এ ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। ৩রা নভেম্বর আবার ষড়যন্ত্র হয়। দেশের কারাগারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও মুক্তিযুদ্ধের চার নেতাকে। এই সময়কালে মিসেস গান্ধী আন্তর্জাতিক পরিসরে কখনোই প্রতিবাদ করেননি; বরং এসব ঘটনাকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে তকমা লাগিয়েছেন।
এর আগের ঘটনা ছিল, ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনে সরকারি কর্মকর্তাকে নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগ করায় তার নির্বাচন এলাহাবাদ হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে। ইন্দীরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে সুপ্রীম কোর্ট সেই আপিলের রায়ে ইন্দিরা গান্ধীকে পরবর্তী ২০ দিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের নির্দেশ প্রদান করেন; তবে মিসেস গান্ধীকে পার্লামেন্টে কোনো ভোটে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয় এবং এই সময়ের মধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ কারণে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থার রাস্তা গ্রহণ করেন। সঞ্জয় গান্ধীর নির্দেশে পরের দিন ভারতের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাসহ কোথাও কোনো পত্রিকা ছাপা হয়নি। কারণ, পত্রিকার ছাপাখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ সাময়িক বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। একদিন পর সর্বভারতে স্বাভাবিক নিয়মে পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল; কিন্তু পর্দার অভ্যন্তরে সেই নির্দেশের কথা কোনো পত্রিকা তুলে ধরেনি।
১৯৭৫-এর জুনের সেই জরুরি অবস্থা এক সাধারণ নির্বাচনের মধ্যেমে শেষ হয় ১৯৭৭ সালের মার্চে। সেই নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ও তার ছেলে সঞ্জয় গান্ধী- উভয়েই পরজিত হয়েছিলেন; আর ৫৪৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেস মোট ১৫৩ আসন পেয়েছিল। কংগ্রেসের এই ১৫৩ আসনের মধ্যে ৯২টি ছিল দক্ষিণ ভারতে।
দীর্ঘ ৪৫ বছর পরও বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত সেই ক্ষত ভুলতে পারেনি। মিসেস গান্ধীর দৌহিত্র রাহুল কংগ্রেসের সভাপতি; দাদীর জারি করানো সেই জরুরি অবস্থা নিয়ে তিনি কখনো মুখ খুলেছেন বলে জানা নেই। তবে গুজরাট দাঙ্গার ইন্ধনদাতা হিসেবে অভিযুক্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোদী-অমিত জুটি ঢেকুর তুলে ভারতীয় জনগণকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ১৯৭৫ সালের ২৫ জুনের জরুরি অবস্থার কথা।
ভারত নামক দেশটির সীমানার প্রায় অধিকাংশ দেশের সঙ্গে যুদ্ধখেলায় লিপ্ত মোদী-অমিত জুটি এই মুহূর্তে যতই কাশ্মীরের আর্টিকেল ৩৭০ কিংবা এনআরসি অথবা সিএএ নিতে মাতামাতি করুক, কোনো কিছু স্থায়ীভাবে জনগণের দৃষ্টির পেছনে নিতে পারবে না।
১৯৭৫ সালের ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার চেয়েও দেশটির সামগ্রিক অবস্থা এখন বেহাল। দেশটি এখন অনেক বেশি প্রতিবেশী বন্ধু হারা, সেই ১৯৭৫-এর তুলনায়।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক