ভাষার রাজনীতি
আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন চিনুয়া আচেবে (১৯৩০-২০১৩)। ইংরেজিতে লেখা তার 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' (প্রথম প্রকাশ ১৯৫৮ সাল) উপন্যাসটি এখন পর্যন্ত অন্তত ৬১টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তাঁর মাতৃভাষা ইগবো-তে উপন্যাসটি কখনো অনুদিত হয়েছে কি-না, এমন একটা প্রশ্নের জবাবে আচেবে ইগবো ভাষায় সেটা অনুবাদে অসম্মতি জানিয়েছিলেন, বহু বছর আগেকার কথা সেটি। 'ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর অন্যতম মহান এই উপন্যাসটি যে সংস্কৃতিকে উদযাপন করে, যার বিলয়ে এই উপন্যাসটি শোকাতুর, ঠিক সেই ভাষাটিতেই এটি অস্তিত্ববান হতে অক্ষম, যদিও উপন্যাসটি ৩০টিরও বেশি ভাষায় (তখনও পর্যন্ত) অনুদিত হয়েছে।'
বছর দশেক আগে কোথাও পাঠ করেছিলাম মাতৃভাষায় কেন অনূদিত হয়নি আচেবের এই উপনাসটি, সে সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ। ভিন্ন একটা কাজে অন্তর্জালে উদ্ধৃতিটি আবার খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলাম ইগবো ভাষায় ২০০৭ সালে 'থিংস ফল অ্যাপার্ট'-এর একটি অনুবাদ সম্পন্ন হয়েছে। অবশেষে! আচেবের তখন বয়স ৭৭, আর গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশের পর কেটে গেছে অর্ধেকটা শতাব্দী। অনুবাদক মনে হয় না আচেবের অনুমতি নিয়ে অনুবাদটি প্রকাশ করেছেন, তার সাথে আলাপ থেকে অনুমান করছি যে তিনি আচেবের এই আপত্তি সম্পর্কেও অবগত নন।
কৌতুহলবশতঃ অনুবাদকের কাছেও জানতে চাইলাম, কেন দীর্ঘ ৫০ বছর সময় লেগেছে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই উপন্যাসটি মাতৃভাষায় অনূদিত হতে। উত্তরে যা তিনি বললেন, সেটি মর্মান্তিক। জানা গেলো "ইগবো ভাষায় আজকাল প্রায় কেউ কথা বলে না। সেই ভাষাতে যারা কথা বলে, তাদের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। বাজারের শক্তিও হয়তো এমন অনুবাদকে আটকেছে। অনুবাদ করে লাভটা কি যদি পড়ার মতো কেউ না থাকে?" এবং "আধুনিক নাইজেরীয় উপন্যাসিকদের বড় অংশটি ইংরেজিতেই লেখেন। ইংরেজি নাইজেরিয়ার দাফতরিক ভাষা এবং অধিকাংশ মানুষ ইংরেজি ভালোভাবে বুঝতে এবং বলতে পারেন।"
অনুবাদটা তাই পাঠকের পড়ার জন্য তৈরি হয়নি; হয়েছে একটা প্রকল্পের অংশ হিসেবে, কিছুটা জাদুঘরের প্রদর্শনীর মতো করে।
বোঝা গেল, ইগবো জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগত ক্রমবৃদ্ধি সত্ত্বেও (চার কোটিরও কিছু বেশি, নাইজেরিয়ার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষের জাতিগত পরিচয় এটি) চাকরি কিংবা শিক্ষার বাহন নয়, এমন একটা ভাষাকে চর্চা করবার প্রায়োগিক উপযোগিতার অভাবেই ভাষাটি আজ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে।
আমাদের দেশেও কোনো কোনো আদিবাসী ভাষা যেমন এইভাবে বিলয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিষয় না, মূল বিষয় তাই দেখা যাচ্ছে ভাষাটাকে কাজের ভাষা, বাজারের ভাষা, চাকরির, ব্যবসার ভাষা হিসেবে কার্যকর রাখা যাচ্ছে কি না।
২.
আচেবে অবশ্য ভেবেছিলেন ভাষা একটা 'অস্ত্রমাত্র', এবং ভাষা বিষয়ে যুদ্ধ করার কিছু নাই। তার সাথে দীর্ঘ তর্ক হয়েছিল এ বিষয়ে নগুগি ওয়া থিওঙ্গোর, যিনি ভাষাকে উপনিবেশিকতার বাহন হিসেবে ভাবতেন। আচেবে উল্টোদিকে প্রচার করতেন উনিবেশিকের ভাষাকে দখল করে নেওয়ার এবং নিজস্বতা দিয়ে সেটাকে করায়ত্ত করার তত্ত্ব, এটা ছিল তার কাছে এক রকমের অন্তর্ঘাতী যুদ্ধ। তাই 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' উপন্যাসে অজস্র ইগবো শব্দ ও পরিভাষা চলে এসেছে অনায়াসে।
কিন্তু একটা গুরুতর প্রশ্ন আজ আবারও আসছে: এই কাজটির মধ্য দিয়ে কি উপনিবেশিকের ভাষার সীমা ও প্রতিপত্তিই, এবং তার ধারণ করবার ক্ষমতায় আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না, যে আয়োজনে আবার স্বয়ং উপনিবেশিতই তার নিজের মেধা ও সৃজনশীলতাকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে যোগানদারেরই কাজ করেন, বিনিময়ে উপনিবেশিক প্রভূও তার জন্য একটা জায়গা বরাদ্দ করে দেন? এভাবে কি প্রান্তের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র হজম করে ফেলে না? এটা কি এমন একটা বিপ্লবের চেষ্টা না, যেটা কার্যত উপনিবেশিতের অধীনস্ততাকে এবং প্রান্তিকতাকে আরও ঘনীভূত করে?
সেদিক থেকে যদি ভাবা যায়, তাহলে আচেবে ছিলেন তাদের অন্যতম, যারা মননে উপনিবেশবিরোধী থেকেও ভাষার স্থানটিতে উপনিবেশ কিভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে বেশ খানিকটা ব্যর্থ হয়েছেন। এবং এর পরিণাম সম্ভবত সেই সমাজগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভালো হয়নি। রাষ্ট্রীয় নীতির জায়গা থেকেও নাইজেরিয়াতে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সেখানকার প্রধান তিনটি ভাষাকে ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত করা হয়। চাকরি পাবার ক্ষেত্রে দেশীয় কোন ভাষায় যোগ্যতাকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়। এর পরিণতিতে আজকে নাইজেরীয় 'শিক্ষিত' জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ কেবলমাত্র একটা ভাষাতেই কথা বলতে পারেন, সেটা ইংরেজি। নগরবাসী সাধারণ মানুষও একটা 'নিজস্ব' নাইজেরিয় ইংরেজিতেই কথা বলেন।
৩.
ভাষা কেবল যে একটা নিরেট অস্ত্র নয়, বরং জীবন্ত সত্তা, এবং ভাষাভাষীদের বিশেষ করণীয় আছে তার সাথে একটা মিথষ্ক্রিয়ায় যাবার, সেটা আচেবের নিজস্ব অভিজ্ঞতাতেই মিলবে। ১৯৮১ সালে আচেবে জাপানে যান 'বিশ্বসভতার বিচিত্র বিকাশ' বিষয়ক একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে, 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' প্রকাশিত হবার ২৩ বছর পর। সেখানে ওয়াজেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কিনিচিরো তোবা এ পশ্চিমের জ্ঞান ও ভাষার সাথে জাপানের অভিজ্ঞতাটা তুলে ধরেন, যেটা আচেবের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। কিন্তু এই গল্পের শিক্ষাটি আচেবের নেয়া ভাষা বিষয়ক সিদ্ধান্তটির ঠিক বিপরীত ছিল।
গল্পটা এই:
'আমার দাদা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৮০ দশকের শুরুর দিককার স্নাতক। তার খেরোখাতা ভর্তি ছিল ইংরেজিতে। আমার পিতা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২০-এর দশকের স্নাতক, আর তার খেরোখাতার আধাআধি ছিল ইংরেজিতে, বাকি আধখানা জাপানি ভাষায়। এক প্রজন্ম পর আমি যখন স্নাতক হই, আমার সবটা টোকাটুকি হয়েছিল জাপানি ভাষায়। এভাবে আমাদের নিজেদের ভাষার মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতাকে পুরোটা আত্মস্থ করতে লেগেছিল তিনটি প্রজন্ম।'
৪.
নাইজেরিয়া অনেকগুলো ভাষার আশ্রয়স্থল, ভাষা-উপভাষা-আঞ্চলিক ভাষা ইত্যাদি বিতর্কের শেষ নেই, বৈচিত্র্যে তা অনেকটা ভারতের সাথে তুলনীয়। ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষানীতির বহু নিন্দা আছে; ভারতের বাকি জনগোষ্ঠীর ওপর একদিকে হিন্দিকে চাপিয়ে দেয়ার একটা জনতোষণবাদী উগ্র হিন্দুত্ববাদী চেষ্টা যেমন আছে, তেমনি আছে ইংরেজিকে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম করবার উগ্র আধুনিকতাবাদী চেষ্টাও। তবু এটা স্বীকার করতেই হবে যে ভারতের অধিকাংশ ভাষা ইগবোর মত অস্তিত্বের সংকটে পড়েনি ইংরেজির মুখোমুখি হয়ে, অন্তত বৃহৎ ভাষাগুলো।
ইগবোর সাথে তুলনীয় ভারতের কন্নড় জনগোষ্ঠী, প্রায় ৪ কোটি মানুষ। সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের শক্তিশালী প্রকাশ ঘটেছে কানাড়ী ভাষায়। ভারতের আরও বহু ভাষার জন্যও এই সত্যটি কার্যকর, যদিও প্রবল ভাষাগুলোর চাপে প্রান্তিক অনেকগুলো ভাষা লোপ পাবারও বাস্তবতা আছে।
ভারতের, এবং একই কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তানের ভাষানীতির সমস্যা নিয়ে বিস্তর আলাপ হওয়া দরকার। এটা শুধু এই অঞ্চলের ভাষার সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকেই আটকে রাখেনি, জাতীয় বিকাশকেও রুদ্ধ করেছে। তবু এটা বলতেই হয় যে, জনগোষ্ঠীর দাফতরিক ভাষা, অর্থাৎ কেজো ভাষা কোনটি হওয়া উচিত, সে বিষয়ে নাইজেরিয়ার প্রধানতম সাহিত্য-ব্যক্তিত্বদের যেভাবে শুরু থেকেই পরবাসী মনোভাবের অধিকারী আমরা দেখছি, সেটা এই উপমহাদেশে কম ছিল; বরং শক্তিশালীতম চিন্তাবিদরা স্বদেশি ভাষার বিকাশের ওপরই জোরারোপ করেছেন।
সম্ভবত অন্য একটি কারণ হলো এই যে, ইগবোর শক্তিশালী মৌখিক ভাষার ঐতিহ্য থাকবার পরও লিখিত সাহিত্যের ঘাটতি ছিল, যেটা উপমহাদেশের অনেকগুলো ভাষার বেলাতেই ঘটেনি।
৫.
বাংলা ভাষার সেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আমল থেকে চাকরি এবং ইহজাগতিক বিষয়াদির মাধ্যম হিসেবে ভাষাকে স্থাপন করার গুরুত্ব বিষয়ে আলাপ হয়েছে। এর একটা বাস্তব কারণ হলো, কেবল দরদ দিয়ে, মায়া দিয়ে, আর্তি দিয়ে ভাষাকে রক্ষা করা যায় না। আজকে বাংলাদেশে সত্যি সত্যিই একটা উচ্চবিত্ত (মধ্যবিত্তও) শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা একদমই বাংলা জানে না। সত্যই আমরা শিগগিরই একটা সমাজাকি পরিবেশ পাবো যেখানে বাংলাদেশে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত কোনো ভাষা আদৌ না জেনে চাকরি/ব্যবসা/সামাজিকতা/আত্মীয়তা/লৌকিতার সকল একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।
একটা খুব মৌলিক তাত্ত্বিক প্রশ্ন এখানে আসে: তাতে ক্ষতি কী? কারও কি অধিকার নেই কেবল ইংরেজিতে মনের ভাব প্রকাশ করবার? কিন্তু বিপরীতে এই প্রশ্নটাও করা যায়: উপকার কী? ভাষা বিষয়ক এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো পৃথিবীতে নতুন নয়। এর স্বাভাবিক ফলাফলগুলোও আমরা বারবার পুনরাৎপাদিত হতে দেখেছি। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো তার নাগরিকদের ভাষাশিক্ষার বিষয়ে যে কঠোর নীতি অবলম্বন করে; প্রায় একই কাজ করে জাপান, চীন, কোরিয়ার মতো নতুন শিল্পায়িত দেশগুলো, তা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়।
তবে এই বিষয়ে বলপ্রয়োগের চাইতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই অবলম্বন করা উচিত। বিদেশি ভাষার জ্ঞান জরুরি, যেটা আমরা অধ্যাপক কিনিচিরো তোবার গল্পটিতে পেলাম। কিন্তু এই জ্ঞান অর্জনে রাষ্ট্র বিনিয়োগ করে তো স্বদেশি ভাষাকেই সমৃদ্ধ করবার জন্য। চাকরি এবং শিক্ষার বেলাতে স্বদেশি কোনো না কোনো ভাষাকেই একমাত্র এবং প্রধানতম যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করবার বন্দোবস্ত করা হলে বাস্তব প্রণোদনাই ভাষার রক্তক্ষয় করা এই প্রবণতাটা বন্ধ হবার বাস্তবতা তৈরি করবে।
৬.
একটা মজার উদাহরণ দিয়েই শেষ করা যাক। নাইজেরিয়ার জন্য তাদের স্বাধীনতার সময়ে, সেই ১৯৬০ সালে পথ ছিল দুটো, জাপানের মতোই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে নিজের ঐতিহ্যের মাঝে সম্ভাবনার অনুসন্ধান এবং সেটাকে আশ্রয় করে দাঁড়ানো। দ্বিতীয় পথটি ছিল ইংরেজিকে একচ্ছত্র গ্রহণ করা। নাইজেরিয়া দ্বিতীয় পথটি গ্রহণ করেছে। এটা যেমন সত্যি যে, নাইজেরীয় উচ্চবিত্ত (নগুগির ভাষায়) 'এমনকি নাক দিয়েও ইংরেজি বলতে পারেন'; তেমনি এরই পাশাপাশি সেখানে কিন্তু একইসাথে যেমন স্থানীয় ভাষাগুলোর অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে কোনো মানসম্মত ইংরেজির ভিত্তিও এত বছরে তৈরি হয়নি। এটাই বাস্তবতা।
১৯৯৩ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত পরিচালিত একটা গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ ভাগেরও বেশি নাইজেরীয় Senior Certificate Examination in English পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়েছেন! গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনো দেশীয় নানান ভাষাতেই কথা বলেন। অর্থাৎ কি না, ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা সেখানে একটি ক্ষুদ্র অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতেই রাষ্ট্র/প্রশাসন/বাণিজ্যের সক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করেছে।
নগুগির কথিত সেই অন্তর্ঘাতী নতুন ইংরেজি তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় কায়েমী স্বার্থের মানদণ্ডে তো বিশুদ্ধ ইংরেজিই বিবেচ্য। ফলে নিজের ভাষা তারা হারিয়েছেন, অন্যদিকে ভাষার প্রশ্নে জাপান/কোরিয়া/চীনের মতো সমসুযোগের কোনো ক্ষেত্র তৈরি হয়নি, কোনো গণতান্ত্রিকতা ঘটেনি।
এই ঘটনাটা নাইজেরিয়ার চাইতে কম মাত্রায় হলেও উপমহাদেশেও ঘটেছে। ফলে এই দেশগুলোর সকল পরিকল্পনা নির্ধারণ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থেকে দূরবর্তী, কেননা ভাষার এই দূরত্ব জ্ঞান সম্প্রসারণে বিশাল একটি বাধা। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, দর্শন কিংবা ইতিহাসের প্রধান গ্রন্থগুলো যে দেশে মাতৃভাষায় নেই, সেখানে তার নির্যাসও কখনো বিস্তৃত হতে পারে না।
হয়তো একটা সময়ে নাইজেরীয়রা সকলেই ইংরেজি রপ্ত করে ফেলবেন, একটা পরিপূর্ণ নাইজেরিয় রীতির ইংরেজি গড়ে উঠবে। কিন্তু এই ইংরেজি জ্ঞান নাইজেরিয়াকে জাপানের মতো আধুনিক/যান্ত্রিকীকৃত/অগ্রসর বানিয়ে ফেলেনি, ভাষাকে এইভাবে চাপিয়ে দেওয়ার যেটি ছিল লক্ষ্য। বরং নাইজেরীয় ক্ষমতাবানদের মাঝে যে দুর্নীতির প্রাবল্য, জবাবদিহিতাহীনতা এবং প্রায় প্রায় স্বৈরশাসকদের আবির্ভাব দেখা গিয়েছে; একইসাথে বিপুল সম্পদশালী, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেও ধনবান এই দেশটিতে ক্রমাগত দারিদ্রের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে, এই সব কিছুর সাথেই হয়তো মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করবার ব্যর্থতার একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। এমনকি হয়তো আধুনিকতার এই রক্তপাত ও ক্লেশই এবং বঞ্চনার বোধই প্রতিক্রিয়ায় জন্ম দিয়েছে নাইজেরিয়া নয় শুধু, পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন 'বোকো হারাম'-এর।
ভাষা তাই হয়তো আচেবে যেমন ভাবতেন, কেবল একটা হাতিয়ার নয়, এবং ইগবো ভাষায় আচেবের অনুবাদক যেমনটা ভাবছেন যে ভাষা বিষয়ক এই বিতর্কগুলো পুরাতন হয়ে গিয়েছে, সেটাও হয়তো সত্য নয়। তবে এটা নিশ্চয়ই সত্যি যে, সংস্কৃতি কোনো অনড় অচল বস্তু না। তা রুপান্তরশীল, ইংরেজি বাংলা হিন্দি সকল ভাষাই তাই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতি পারে চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সংস্কৃতির বেশ খানিকটা মূলোৎপাটন করতে, যেখানে রূপান্তরের ধারাবাহিকতার বদলে বিপর্যয়কর একটা বিচ্ছেদ বেশি প্রবল হয়ে ওঠে। তবু মানুষ সর্বাবস্থাতেই প্রাণবন্ত এবং সৃজনশীল।
নাইজেরিয়াতেই আফ্রিকার চলচ্চিত্র এবং যাকে বলে হালের জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম স্টান্ডআপ কমেডির বিপুল বিকাশ ঘটেছে। এমনও হতে পারে, নাইজেরিয় কথ্যরূপের ইংরেজি বলা জনগোষ্ঠী আবার দূর-ভবিষ্যতে খাঁটি ইংরেজি বলা অভিজাত গোষ্ঠীর সাথে নতুন সংঘাতে যেতে বাধ্য হবে ইংরেজির সেই নতুন রূপটিরই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে; কিন্তু চিন্তাশীলদের অবিবেচনায়, ক্ষমতাবানদের স্বার্থরক্ষায় নেওয়া রাষ্ট্রীয় ভাষানীতির কারণে প্রাণপ্রাচুর্যপূর্ণ এবং বৈচিত্রময় একটা সংস্কৃতি যেভাবে ধারাবাহিকতাহীনতার এই মর্মান্তিক ছেদের শিকার হয়েছে, তা যে নাইজেরিয়ার বহু জাতিগত দুর্বিপাকের পেছনের আসল কারিগর ছিল, তাতে সংশয় নেই।
- লেখক: প্রাবন্ধিক, রাজনীতিক