পুনর্ব্যবহৃত ই-বর্জ্যের চমকপ্রদ ব্যবসা
নাইজেরিয়ার লাগোসের তিজ্জানি আবুবকর বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করে ধনী দেশগুলোতে বিক্রি করেন। তার কর্মশালা একটি মলিন কংক্রিট ভবনের মধ্যে অবস্থিত, যেটি একটি বিশাল ইলেকট্রনিক্স বাজারের কাছাকাছি। এখানকার কর্মীরা দক্ষ হাতে স্ক্রু ড্রাইভার ও হাতুড়ি দিয়ে নষ্ট মোবাইল ফোন খুলে সেগুলোর ভেতরকার সবুজ সার্কিট বোর্ডগুলো বের করে জমা করে।
এভাবে সংগ্রহ করা এই ইলেকট্রনিক বর্জ্যগুলো পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং সেগুলো বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন আবুবকর।
আবুবকরের প্রতিষ্ঠান মূল্যবান ধাতু যেমন তামা, নিকেল এবং সোনার মতো উপাদানসমৃদ্ধ সার্কিট বোর্ডগুলো সংগ্রহ করে। তবে এই ধাতুগুলো সংগ্রহ করা শুধু ফোন ভাঙার মতো সহজ কাজ নয়। সার্কিট বোর্ডগুলো প্রথমে গুঁড়িয়ে তারপর সেগুলো থেকে ধাতু আলাদা করতে হয়, যা অত্যাধুনিক ও খরুচে যন্ত্রপাতি ছাড়া সম্ভব নয়। আফ্রিকার কোনো স্থানে এই কাজ করার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। তাই আবুবকর তার সার্কিট বোর্ডগুলো ইউরোপ বা চীনের মতো উন্নত দেশগুলোর রিসাইকেল [পুনর্ব্যবহার] প্রতিষ্ঠানে পাঠান।
দরিদ্র দেশগুলোতে ধনী দেশগুলোর ইলেকট্রনিক বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ফেলার বিষয়টি অনেক আগে থেকেই আলোচিত। তবে এখন নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে বিপরীত দিক থেকে ই-বর্জ্যের গমন। গ্লোবাল সাউথের উদ্যোক্তারা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। ই-বর্জ্য বলতে যে কোনো প্লাগ বা ব্যাটারি যুক্ত পরিত্যক্ত যন্ত্রকে বোঝানো হয়, যেমন কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, গেম কন্ট্রোলার ইত্যাদি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৬৮ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা পৃথিবী ঘিরে থাকা ট্রাকের সারি দিয়ে পূর্ণ করা সম্ভব।
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই কঠিন কারণ এগুলো যদি মাটিতে ফেলা হয়, তবে বিষাক্ত রাসায়নিক মাটিতে এবং পানিতে মিশে যেতে পারে। ব্যাটারিগুলো আগুন ধরিয়ে দিতে পারে, যার ফলে ডাম্পিং সাইটে আগুন লেগে যেতে পারে। এর পরও জাতিসংঘের অনুমান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মাত্র ২২ শতাংশ ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইকেল করা হয়। বাকি বর্জ্যগুলো পরিত্যক্ত, পুড়িয়ে ফেলা হয় অথবা বাসা কিংবা কর্মস্থলে অযত্নে পড়ে থাকে, যা ক্রমশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ই-বর্জ্য শুধু পরিবেশের ক্ষতি করে না, এটি মূল্যবান সম্পদের অপচয়ও করে। ফোন এবং ল্যাপটপের মতো ডিজিটাল যন্ত্রগুলোতে থাকে দামি ধাতু, যেমন সার্কিট বোর্ড ও ক্যাবলে তামা এবং ব্যাটারিতে লিথিয়াম, কোবাল্ট ও নিকেল। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ৬০ বিলিয়ন ডলারেরও ধাতু ই-বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়।
ধনী দেশগুলোতে পুরোনো ফোন বা গ্যাজেট রিসাইকেল করার সহজ উপায় নেই। তাই সেগুলো ফেলে দেওয়া হয় বা অব্যবহৃত থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে প্রতি ৬টি মোবাইল ফোনের মধ্যে মাত্র ১টি রিসাইকেল করা হয়।
তবে দরিদ্র দেশগুলোতে চিত্রটা আলাদা। মাত্র ২ ডলার আয় করা মানুষরা ফেলে দেওয়া ইলেকট্রনিক পণ্য সংগ্রহ করে ১০ সেন্ট উপার্জন করতে পারলেও তাদের জন্য সেটি লাভজনক। আফ্রিকায় প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্যের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ বর্জ্য লাইসেন্সধারী ব্যবসাগুলো রিসাইকেল করে। কিন্তু বাস্তবে অনেক বেশি ই-বর্জ্য রিসাইকেল করা হয়। নাইজেরিয়ায় ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ই-বর্জ্য রিসাইকেল করা হয়। আর ভারতে এটি ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আবুবকর এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অন্যতম ব্যক্তি। তিনি পুরোনো মোবাইল ফোন কেনা-বেচা করেন। উন্নয়নশীল বিশ্বে ফোন অনেকটাই টি-শার্টের মতো সাধারণ বস্তু, তাই এর জোগান প্রচুর। নাইজেরিয়ায় প্রায় প্রতিটি মানুষের জন্য একটি করে মোবাইল অ্যাকাউন্ট রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের মতো, এই ফোনগুলোও একসময় পুরোনো হয়ে যায় বা নতুন মডেল বাজারে আসলে ফেলে দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৫ বিলিয়নেরও বেশি মোবাইল ফোন ফেলে দেওয়া হয়।
দরিদ্র দেশগুলো থেকে ধনী দেশে ঠিক কতটা ই-বর্জ্য যাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়; তবে এই বাণিজ্য বাড়ছে। চীনা এবং ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার স্ক্র্যাপ মার্কেট [বর্জ্যের বাজার] থেকে রিসাইকেলযোগ্য উপকরণ কিনে নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে। আবুবকরের ব্যবসা এতটাই বেড়েছে যে, তিনি এখন শত শত লোকের সঙ্গে কাজ করেন এবং দরিদ্র অঞ্চলের মানুষদের জন্য স্কুলের বই ও গরু দান করার মতো সচ্ছলতা অর্জন করেছেন।
ই-বর্জ্য শিল্পে আরও কিছু সুবিধা রয়েছে। আবুবকর-এর প্রতিষ্ঠানের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ময়লা জমিতে না ফেলে, নতুন ধাতু আহরণের প্রয়োজন কমিয়ে এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হাজার হাজার কর্মসংস্থান তৈরি করে সাহায্য করছে। তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। সার্কিট বোর্ডগুলো রিসাইকেল করা হলেও, অন্যান্য ডিজিটাল যন্ত্রের অংশগুলো ক্ষতিকর উপায়ে নষ্ট করা হয়।
বৈদ্যুতিক তার এবং কেবলগুলো খোলা আগুনে পোড়ানো হয়, যা বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়ায়। লিথিয়াম ব্যাটারিগুলো ডাম্পিং সাইটে [বর্জ্য ফেলবার স্থান] ফেলে দেওয়া হয়, যা আগুনের সূত্রপাত ঘটায় এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ ছড়াতে পারে। যেসব শ্রমিক এসব বর্জ্য পোড়ানো বা ফেলে দেওয়ার দায়িত্বে থাকেন, তারা খুব সামান্য আয় করেন এবং কোনো সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া কাজ করেন। ফলে তারা ক্ষতিকর রাসায়নিক এবং ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসেন।
এ ধরনের ক্ষতি সম্পর্কে ইতোমধ্যেই জানা গেছে। নাইজেরিয়ায় ই-বর্জ্য ভাঙার জায়গাগুলোতে মাটিতে বিপজ্জনক মাত্রায় ভারী ধাতু এবং অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান পাওয়া গেছে। চীনের বৃহত্তম ই-বর্জ্য রিসাইকেল কেন্দ্র গুইয়ু-তে বসবাসরত শিশুদের রক্তে প্রচুর সীসা পাওয়া গেছে।
২০১৯ সালে ভারতের এক পরিবেশ সংস্থার একটি গবেষণায় দেখা যায়, দিল্লির আশপাশে ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য ১২টিরও বেশি অননুমোদিত ই-বর্জ্য রিসাইকেল করার স্থান আছে। এসব এলাকায় সুরক্ষাহীন শ্রমিকরা রাসায়নিক ধোঁয়া, ধাতব ধুলা এবং অ্যাসিডিক বর্জ্যের সংস্পর্শে কাজ করছেন।
এই ধরনের ই-বর্জ্য শিল্পের সুবিধাগুলো আরও বাড়িয়ে বিদ্যমান ক্ষতিগুলো কমানোর উপায়ও রয়েছে। বর্তমানে বেশিরভাগ সংগ্রাহক অনিয়ন্ত্রিত "অপ্রাতিষ্ঠানিক" অর্থনীতিতে কাজ করেন, যা নিয়ন্ত্রণে আনলে তারা আরও লাভবান হতে পারেন। তাদের দক্ষতা, সক্ষমতা ও আয় বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের কাজের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা হলে সবার জন্যই এটি উপকারী হবে। কিছু উন্নয়নশীল দেশে এই সংগ্রাহক এবং বর্জ্য সংগ্রাহকরা ইউনিয়নের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে সরকারি সহায়তা পেয়েছেন।
মূলত, এই শ্রমিকদের উদ্যোক্তা হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে কারণ তারা গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদান করছেন। উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়ার বিভিন্ন শহরে সরকার বর্জ্য সংগ্রাহকদের নগর বর্জ্য ফি-এর একটি অংশ দেয়, যা তারা রিসাইকেলের উপকরণ বিক্রি করার পাশাপাশি আয় করেন।
ভারতের পুনেতে হাজার হাজার ঘরে ঘরে গিয়ে বর্জ্য সংগ্রাহকরা, যারা একটি কর্মী মালিকানাধীন সমবায় সমিতির সদস্য, তারা প্রতিদিন ১ হাজার টনেরও বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করেন। ই-বর্জ্যের ভবিষ্যৎ সম্ভবত লুকিয়ে থাকা সম্পদের মূল্যায়নের মধ্যেই নিহিত।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়