ম্যারাডোনার মতো দেখায়
১.
১০ নম্বর জার্সি দিয়ে অতীত-বর্তমান দুজনকেই বাঁধা যায়, মাঝখানে '১০' রেখে তা-ই বেঁধেছেন। অনেক দূর থেকে যখন প্রথম দেখেছি, তখন অবশ্য নিচের 'মেসি' লেখাটা চোখে পড়েনি। শুধু 'ম্যারাডোনা' দেখেছি এবং একটু চমকেই গেছি। পেছন থেকে শারীরিক আকৃতি ও চুলে ম্যারাডোনা বলে মনে হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। প্রথমেই জার্সির পেছনে নামটা আগেই পড়ে নিলে তো আরও।
দূর থেকে সেই দেখা রিওর মেট্রো স্টেশনে। পরে কাছ থেকেও দেখা হলো ট্রেনে। দশ-বারোজনের এক কাফেলা নিয়ে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার ম্যাচ দেখতে যাচ্ছেন ম্যারাডোনা ও মেসির এই যৌথ সংস্করণ। এই দলের সবাই আর্জেন্টিনা থেকে বিশ্বকাপ দেখতে এসেছেন। ম্যারাডোনা সদৃশ শারীরিক আকৃতির কারণে তাঁর দিকেই সবার দৃষ্টি পড়ছে, অলিখিত দলনেতাও মনে হচ্ছে তাঁকেই। তাঁকে ঘিরেই সবাই গান গাইছে, গানের ফাঁকে ফাঁকে তুমুল হইচইয়েরও তিনিই মধ্যমণি। ছবি তুলতে চাইতেই সবাইকে শান্ত করে পোজ দেওয়ানোর কঠিন কাজটাও তাঁর কল্যাণেই সম্ভব হলো। ছবিতে তাঁকে আলাদা করে দিয়েছে সেদিনের ও'গ্লোবো পত্রিকা। যেটির প্রচ্ছদে মেসির একটা ছবি। স্প্যানিশ শিরোনাম: DIA DE MESSI. বাংলাটা খুব সহজ--মেসির দিন।
মারাকানায় মিডিয়া সেন্টারে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে স্টেডিয়ামের বাইরের অবস্থাটা দেখতে চক্কর দিতে বেরিয়ে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের জটলা থেকে একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো সবাইকে বিভ্রান্ত করতেই। আগেই না দেখলে ক্ষণিকের জন্য হলেও আমিও হয়তো তা-ই হতাম।
ট্রেনেই খেয়াল করেছি, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, হাত-পা নাড়াতে ম্যারাডোনার পরিষ্কার অনুকরণ। মারাকানার বাইরে দাঁড়িয়েও তাঁকে বেশ কিছুক্ষণ দেখলাম। ম্যারাডোনার মতো মনে হওয়ার জন্য সচেতন চেষ্টাটা সহজেই চোখে পড়ল। দেখতে দেখতে আমার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার প্রিয় দুটি লাইন মনে পড়ে গেল।
বাংলা বুঝলে তো কথাই নেই, ইংরেজি বুঝলেও ওই তরুণকে গিয়ে বলতাম--
আসলে কেউ ম্যারাডোনা হয় না
ম্যারাডোনার মতো দেখায়।
২.
দুই বছর পর অলিম্পিক, কাভার করতে আবারও রিও আসার কথা। কিন্তু অনিশ্চয়তায় এই জীবনে দুই দিন পরের কথা বলা যায় না, আর এ তো দুই বছর! ২০১৪ বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর তাই মনে হলো, পৃথিবীর অন্য প্রান্তের এই দেশে আর কোনোদিন আসা হয় কি না কে জানে, রিওর দর্শনীয় স্থানগুলো অব্শ্যই দেখে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার আর সুগারলোফ। বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার একদিন পর তাই একটা সিটি ট্যুর নিয়ে ফেললাম।
বাসে ওঠার পর গাইড যখন ট্যুরের প্রথম স্টপেজের নাম বললেন, একটু বিরক্তই হলাম। মারাকানা স্টেডিয়াম আর নতুন করে দেখার কী আছে! বেশ কয়েকবারই যাওয়া হয়েছে বলে এটি তো একরকম মুখস্থই হয়ে গেছে। কী আর করা যাবে, গাইডেড ট্যুরে তো আর কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম নেই। সঙ্গী অনেকের জন্যই এটা প্রথম মারাকানা-দর্শন বলে তাঁরা যথেষ্টই রোমাঞ্চিত। মারাকানায় গিয়ে আমি তাই নিতান্ত অনিচ্ছায় বাস থেকে নামলাম। নেমেই চমকে গেলাম। মারাকানার সামনে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের অধিনায়ক বেলিনির যে মূর্তিটা আছে, সেটির সামনে দাঁড়িয়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনা! একেবারে সুসজ্জিত। গায়ে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ডোরাকাটা আকাশি-নীল জার্সি, বাঁহাতে ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড, পায়ে বুট। যৌবনের ম্যারাডোনার মতোই মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল। শারীরিক গড়নেও মিল আছে। তবে সেই মিলটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে আসল আর নকলের পার্থক্য। ম্যারাডোনা তো অনেকদিনই ফুলে-ফেঁপে নিজেই 'ফুটবল' হয়ে গেছেন। মারাকানার সামনে যে 'ম্যারাডোনা', আসল ম্যারাডোনা এমন ছিলেন কমপক্ষে তিন দশক আগে।
নকল ম্যারাডোনার হাতে একটা নকল বিশ্বকাপও আছে। খোলা চত্ত্বরটাতে ম্যারাডোনার মতো ওয়ার্ম আপ করছেন, দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে হেড করছেন অদৃশ্য বলে। একটু পরপরই কাপটা তুলে ধরছেন মাথার ওপর। ক্লান্ত হয়ে গেলে তা বেলিনির মূর্তির বেদিটাতে নামিয়ে রেখে পা দুটি একটু ফাঁক করে কোমরে দুই হাত দিয়ে দাঁড়াচ্ছেন ঠিক ম্যারাডোনার ভঙিতে।
তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ছবি তোলার পর যার যা ইচ্ছা দিচ্ছেন, ম্যারাডোনা সেজে ড্যানিয়েল গঞ্জালেসের মারাকানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তো এ কারণেই।
ম্যারাডোনার রেপ্লিকার সঙ্গে ছবি তোলার পর ট্যুরিস্টদের বেশির ভাগই মারাকানা প্রদক্ষিণে এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেন। মারাকানা আমার আগেই দেখা বলে আমি সময়টা নকল ম্যারাডোনার সঙ্গেই কাটালাম। সময় কাটানো মানে ছবি তোলা আর কি! ভাষা বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় কথা বলার তো আর উপায় নেই। এর মধ্যেই মানুষের আদিমতম সর্বজনীন ভাষা ইশারা-ইঙ্গিতে কিছু 'কথাবার্তা' হলো। আর্জেন্টিনা ফাইনালে হেরে যাওয়ায় তাঁর যে খুব মন খারাপ হয়েছে, এটা তো জিজ্ঞেস করে জানার কিছু ছিল না। তারপরও দুহাতে চোখ মোছার ভঙ্গি করে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেন।
চুলটা আসল কি না হাত দিয়ে দেখতে চাইলাম। বাধা পেয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, ওটা পরচুলাই হবে। ম্যারাডোনার বাহুতে চে গুয়েভারার উল্কি। গঞ্জালেসের বাহুতে ডিয়েগো ম্যারাডোনার। একটু পরপরই সগর্বে তা দেখাচ্ছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিনে পয়সায় একজন দোভাষী পাওয়া যাওয়ায় গঞ্জালেসের বৃত্তান্ত মোটামুটি জানা হয়ে গেল। বয়স ৩৫। স্থায়ী ঠিকানা বুয়েনস এইরেসের দক্ষিণের বিচ রিসোর্ট লাস তনিনাস। সেখান থেকে বাসে করে রিওতে এসেছেন। নিজেও ফুটবল খেলতেন, ইনজুরির কারণেই নাকি বেশি দূর যেতে পারেনি। এখন কাজ করেন একটা লেদার ফ্যাক্টরিতে। ম্যারাডোনা সেজে দিনে এক শ রেইসের (চার হাজার টাকা) মতো উপার্জন হয়। এ দিয়েই থাকা-খাওয়া চালিয়ে নিতে হয়। আর্জেন্টিনার ম্যাচ দেখার খুব ইচ্ছা। যা পূরণ হবে কি না, এ নিয়ে নিজেই অনেক সন্দিহান। এর চেয়েও বেশি ইচ্ছা, ইচ্ছা না বলে স্বপ্ন বলাই ভালো, আসল ম্যারাডোনার সঙ্গে যদি একবার দেখা হতো!
মাঝের ছয় বছরে গঞ্জালেসের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে কি না, জানি না। গত ২৫ নভেম্বর তো সেই স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়েছে।
ম্যারাডোনার মৃত্যু সংবাদটা পাওয়ার ড্যানিয়েল গঞ্জালেস কী করেছেন, খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
- লেখক: সাংবাদিক