যে দেশে স্বাস্থ্যবিধি এক রূপকথা
দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের রূপকথা বিরাজ করছে। আমরা যেন রূপকথার কোনো রাজ্যে আছি। ফলে এ রাজ্যে 'রূপকথার স্বাস্থ্যবিধি'ও আছে।
জনগণের একটি সামান্য অংশ ছাড়া এই দেশের মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। মাস্ক শুধু অন্যকে দেখানোর একটা অর্নামেন্টে পরিণত হয়েছে। কেউ দেখতে চাইলে পকেট থেকে বের করে দেখিয়ে দেওয়া যায়, এমন একটা অর্নামেন্ট। পথে-ঘাটে-মার্কেটে মাস্ক পরা মানুষরাই সংখ্যালঘু।
সম্প্রতি ৭১ টিভিতে করোনা বিষয়ে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান সরাসরি জানিয়েই দিয়েছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যা সিদ্ধান্ত দেয়, সেসবের কিছুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শে দেওয়া হয় না। বরং এসব সিদ্ধান্তে আরও বিব্রত হতে হয় তাদের।
অবশ্য, করোনা পরিস্থিতি কবে এবং কীভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় না হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিষয় হয়ে গেল, তা আমারও বোধগম্য না।
এরমধ্যেই টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে বিনোদন কেন্দ্র ও পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হলো। অর্থনীতি বাঁচাতে এগুলো প্রয়োজন, মানলাম। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন না? আপনি পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র ঘুরে এসে করোনায় আক্রান্ত হবেন, আর আপনাকে সার্ভিস দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর এইসব অগুরুত্বপূর্ণ (!) প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকা চিকিৎসক ও সেবিকারা আপনাদের সেবা দিতে দিতে মরে যাবে! ব্যাপারটা কেমন না? মানে মহামারির মাঝে আপনার বিনোদন এবং বিনোদন পরবর্তী রোগ-শোকের দায় দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের!
'প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম' [Prevention is better than Cure]- এ কথাই যদি সত্যি হয়, তাহলে তো দেশে এই মুহূর্তে চিকিৎসক নিয়োগের পাশাপাশি ১০,০০০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং ৩০,০০০ পুলিশ সদস্য অতি দ্রুত নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন ছিল। একদম ৭ দিনের মধ্যে।
কারণ, টিভি খুললেই রিপোর্টাররা বলছেন, এবার স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর অবস্থানে থাকবে প্রশাসন। আমার প্রশ্ন হলো, 'কীভাবে?'
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে কতজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা) আছেন? কতজন পুলিশ সদস্য আছেন? গোটা কক্সবাজার জেলায় কতজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছেন? কক্সবাজারের শুধু কলাতলী বিচে কতজন পর্যটক শুধু দুপুরবেলাতে গোসলের সময় অবস্থান করেন, জানেন? এ রকম কতগুলো বিচ বা পর্যটন পয়েন্ট আছে কক্সবাজারে? এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বা তদারকি করতে কত হাজার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লাগবে, ধারণা করতে পারেন? নীলগিরি নীলাচলে কত হাজার লোক একসঙ্গে আরোহন করে, সেই সমীক্ষা নিয়ে কেউ নাড়াচাড়া করেছেন?
রিপোর্টাররা যখন জিজ্ঞেস করেন, তখন শেখানো দাপ্তরিক বুলি কেন বলে উঠি আমরা? জেলা প্রশাসক কেন বলেন না, 'আমার অধীনে এই কয়জন ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। গোটা জেলায় এদেরকে দিয়ে যতটুকু স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব, ততটুকুই আমরা করতে পারব, এর বাইরে পারব না। আপনারা খুশির ঠ্যালায় সাগর পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবেন, আর আমরা ২৪ ঘণ্টাই ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে আপনাদের দাবড়িয়ে বেড়াব, এত সক্ষমতা আমাদের নাই।'
জেলার এসপি কেন বলে দেন না, 'রোস্টার করে এত হাজার পুলিশ সদস্য এই মুহূর্তে ফিল্ডে আছেন। গত দেড়টা বছর রুটিন কাজের বাইরে লকডাউনের কঠিন দায়িত্ব পালন করতে করতে এরা ক্লান্ত। সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কোনো পুলিশ এক্সট্রা কোনো কাজ করার অবস্থায় নাই।'
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এই করোনার মধ্যে এই দেশে চিকিৎসককে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি একজন ইউএনও আক্রান্ত হয়েছেন। আগেও হয়েছেন। মানে, মাঠে যারা কাজ করবেন, তারাই মার খাবেন। সুতরাং এই দেশের কতিপয় অসহিষ্ণু মহল কত সেবা ডিজার্ভ করে, সেটাও বিবেচ্য। মাস্ক পরতে বললে আপনারা যে ম্যাজিস্ট্রেটকে মারবেন না, এমন কোনো গ্যারান্টি নাই।
মাস্ক না পরা কিংবা থুতনিতে পরা মানুষদের একটা দেশে আপনি থাকেন। প্রতিদিন ২০০ মানুষ করোনায় মারা যায়, এমন একটা দেশে আপনি থাকেন। আপনি কক্সবাজার রাঙ্গামাটি না ঘুরলে কি এমন ক্ষতি! ঘুরতে গিয়ে তো স্বাস্থ্যবিধি মানবেন না? রূপকথার গল্পের নায়ক-নায়িকা তো আমরা সবাই!
এই দেশে 'করোনা' একটি ব্যবসা এবং 'স্বাস্থ্যবিধি' এক জনপ্রশাসনিক রূপকথা ছাড়া আর কিছুই না!
-
লেখক: চিকিৎসক, করোনা ইউনিট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল