রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ধর্মতত্ত্বজীবীদের নতুন আখ্যান
রবীন্দ্রনাথের ১৬০তম জন্মদিন উদযাপিত হলো আজ ২৫ বৈশাখ। আজ থেকে ঠিক ১০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথের দেড়শ বছর উদযাপনের জন্য সেই সময় বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে প্রফেসর কবীর চৌধুরী, প্রফেসর আনিসুজ্জামানদের মতো বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয় রবীন্দ্র সার্ধশত বছর উদযাপনের জন্য। যাদের নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে দেড়শ জন লেখকের দেড়শ বিষয়ে লেখা প্রকাশ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে আমরা এভাবেই স্মরণ করেছি আজ থেকে ১০ বছর আগে। গত ১০ বছরে কি পরিস্থিতি পাল্টে গেল? গতকালকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে তা সেই পাকিস্তান সময়কালের ঘটনা কি মনে করিয়ে দেয়! এদের মধ্যে কোন কোন বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথকে ''ব্রাহ্মণ প্রতিনিধি" হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও রবীন্দ্রনাথের দুই পুরুষ ব্রাহ্মধর্ম ধর্ম অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম মূলত একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। যদিও অন্যান্য পূজা-পার্বণ তাঁদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হতো তারপরও রবীন্দ্র পরিবারকে কোনভাবেই ব্রাহ্মণ হিসেবে উল্লেখ করার কোনো সুযোগ নেই। জমিদারিত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী অবস্থানকে অনেকে জমিদারি তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কী আসলেই তাই? রবীন্দ্রনাথ কি কেবলমাত্র জমিদারের স্বার্থে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন? নাকি, ধর্মীয় বিভাজনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন? ব্রিটিশরা বাংলায় গড়ে ওঠা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্যই বাংলা ভাগ করেছিলেন সেই ১৯০৫ সালে। পূর্ববঙ্গের সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি ব্যবস্থার প্রতিনিধিরা ধর্মতত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গভঙ্গের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। তাদের মধ্যে নবাব সলিমুল্লাহ অন্যতম। সলিমুল্লাহরা বিষয়টিকে ধর্মতত্ত্ব দ্বারা দেখেছিলেন এবং যে কারণে তারা পূর্ববঙ্গের আলাদা সত্ত্বা দাবি করেছিলেন। সেই বঙ্গভঙ্গের ভেতর থেকেই ভারতীয় সমাজ প্রথম ধর্ম দ্বারা বিভক্ত হয়।
ভারতে মুসলিম লীগের জন্ম হয় অনুষ্ঠানে, এই ঢাকা শহরে বঙ্গভঙ্গের পরিণতিতে। খাজা সলিমুল্লাহ'র আহ্বানে ভারতের সকল সামন্ততান্ত্রিক মুসলিম জমিদাররা একত্রিত হয়ে মুসলিম লীগ নামক দলটির জন্ম দিয়েছিলেন। সেই ভারতীয় দ্বিধাবিভক্ত সমাজ আজকের ভারতবর্ষের সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে। রবীন্দ্রনাথকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর বিপক্ষের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেন এখনও এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২১ সালে জন্ম নেওয়ার পরবর্তী অন্তত ৪৭-৪৮টি শিক্ষকদের প্রধান অংশ ছিলেন অমুসলিম। মুসলিম শিক্ষকের সংকট ছিল ব্যাপক। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা বিরোধিতা করেছেন, তার পেছনে অন্যতম কারণ তখনকার ঢাকার শহরের বাস্তব অবস্থার। ঢাকা শহরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার মতো বাস্তব অবস্থা তখন তারা দেখেননি। তোদের বিরোধিতা ভুল ছিল বললেও তাতে কোনো ধর্মতত্ত্বের বিষয় ছিল না।
রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন এই মনগড়া কথা প্রচার করেন। কিন্তু তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ হাজির করেন না।
আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্মের দিকে তাকাই, তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় সার্বিকভাবে জনসংখ্যা এবং সমাজের মধ্যশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতো হিন্দু ধর্মাবলম্বী সমাজ। সেকারণে রবীন্দ্র সাহিত্যে তার প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। এই প্রভাবের অর্থ এই নয় যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মের সব কিছুই অনুসরণ করতেন।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি এবং তারপরে শান্তিনিকেতন গড়ে তোলা, এর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি জীবনের প্রধান অংশ ব্যয় হয়েছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের ধর্মীয় প্রতিনিধিত্বশীল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একথা কেউ বলতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছেন। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ভারতের অতি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। তিনি মনে করতে এই অতি জাতীয়তাবাদী চেতনা ভারতকে দ্বিধাবিভক্তি করবে। এবং তার এই ভবিষ্যৎবাণী তার মৃত্যুর পরে বাস্তব হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথকে যারা ধর্মীয় আলোকে ব্যাখ্যা করতে চান তাদের রবীন্দ্রনাথকে আরও গভীরভাবে পাঠ করা প্রয়োজন। মার্কসীয় দর্শনের বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরাও কখনও কখনও রবীন্দ্রবিরোধী হন। এরাই আবার তাদের ভাষায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে হেফাজত ইসলামকেও সমর্থন দেন। এই দ্বিচারিতা আমাদের সমাজকে ক্রমশ এক রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটা আজকের বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক