রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের কাছ থেকে আমরা নিতেই শিখেছি, দেইনি কিছুই
যদি প্রশ্ন করি সিঙ্গাপুরের বেশ কয়েকটি উঁচুমানের হোটেলে এবং বড় বড় তিন-চারটা প্রমোদতরীতে অতিথি হিসেবে এখন কারা আছেন? জানি এর উত্তর দেয়া অসম্ভব। সেখানে আছেন বাংলাদেশের সেইসব অভিবাসী শ্রমিক ভাইরা, যাদের করোনাভাইরাস ধরা পড়েছিল। সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেইসব হোটেলেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে।
আমার এক বন্ধু সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ইন্টারপ্রেটার বা অনুবাদক হিসাবে কাজ করে। সে জানাল, এইসব দামী হোটেলে থাকতে গিয়ে আমাদের শ্রমিকরা নাকি ক্লান্তবোধ করছেন। তারা বলছেন, 'এত আয়েশে থাকা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে আমাদের ডর্মে দিয়ে দিন।' কিন্তু হাসপাতাল বলেছে, করোনাভাইরাসের দমক না কমা পর্যন্ত এনারা এখানেই থাকবেন। তাদের খুশি করার জন্য যা দরকার, ওরা সেটার ব্যবস্থা করবে। যেমন এইসব হোটেলের খাওয়া তারা খেতে পারছেন না, তাই তাদের জন্য গরুর মাংস, ভাত, ভর্তা আর ডালের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, এরা আর যা কিছু চাইবেন, তাই দেওয়া হবে; কিন্তু এইসব হোটেলেই তাদের থাকতে হবে।
এর আগে মুসলিম শ্রমিকরা যাতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নিশ্চিন্তে নাকের সোয়াপ বা শ্লেষা টেষ্ট করাতে পারেন, এজন্য স্থানীয় মুফতির কাছ থেকে বয়ান যোগাড় করা হয়েছে। শ্রমিক ভাইদের জানানো হয়েছে, এতে তাদের রোজা ভাঙবে না। সিঙ্গাপুরের সরকার, ধনী নাগরিক ও বড় বড় ব্র্যান্ডের দোকানগুলোর পক্ষ থেকে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সহায়তা হিসেবে হাসপাতালগুলোতে এত বেশি পরিমাণে দানবাক্স পাঠানো হচ্ছে যে, হাসপাতালগুলো হাতজোড় করে মাফ চাইছে।
সরকার তার রিজার্ভ থেকে সব নাগরিককে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। সরকার বলেছে, তারা তাদের পূর্বসুরীদের গঠন করা রিজার্ভ ফান্ডে এই প্রথমবারের মতো হাত দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এখানে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকরা সবাই তিন মাসের বেতন পাবেন। কারও কোম্পানি যদি কোনো শ্রমিককে টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, সরকারই তাকে বেতন দেবে। চিন্তার কোনো কারণ নাই।
অথচ একই সময়ে প্রথম আলোতে পড়লাম, কুয়েত সরকার অবৈধ কর্মীদের অস্থায়ী আটক শিবিরে জড়ো করেছে। সেইরকম এক বন্দি শিবির থেকে একজন শ্রমিক ফোন করে সাংবাদিককে বলেছেন, ২২ দিন ধরে একটি স্কুল ঘরে গাদাগাদি করে ৬০০ জনকে রাখা হয়েছে। খাবারের কষ্টের কথা বললে পুলিশ মারছে। বিভিন্ন শিবিরে ৪ জন মারা গেছেন।
তিনি বলেছেন, 'দূতাবাসে দিনে ফোন দিয়েও কাউকে পাই না। আমাদের বাঁচান।' একদম একটা বিপরীত চিত্র পেলাম। বুঝতে পারি না শ্রমিকদের ফেরত পাঠাতে হলে পাঠাক; কিন্তু তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ কেন করতে হবে?
করোনাভাইরাসে অর্থনৈতিক ধাক্কায় আরব দেশগুলো তাদের বৈধ অভিবাসী শ্রমিক ফেরত পাঠাতে চাইছে। এপ্রিলের শুরু থেকেই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ৮টি দেশ বেকার শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিতে সরকারকে চাপ দিচ্ছে। এই সংখ্যাটা ১০ লাখও হতে পারে। সেখানে কাজহীন শ্রমিকদের অবস্থা শোচনীয়।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, জরুরি অবস্থায় নিয়মিত-অনিয়মিত সকল অভিবাসীর সুরক্ষা শ্রমগ্রহণকারী দেশের কর্তব্য। দুর্যোগের মধ্যে কোনো কর্মী ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনকে অমান্য করার শামিল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ছাঁটাই করার আগে কর্মীদের অন্তত ছয়মাস সময় দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু আরব দেশগুলো কোনো সাড়া দিচ্ছে না । এমনকি কর্মীদের ফেরত না পাঠিয়ে ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজে জড়িত করার জন্য যৌথ তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। অথচ কোনো দেশ রাজি হয়নি। সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক ফোরামে এই প্রসঙ্গ তুলে ধরা। যেমন জাতিসংঘ, কলম্বো প্রসেস ও আবুধাবী ডায়ালগে।
এই জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মোট ৫ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক ফিরে এসেছেন। যারা ফিরে এসেছেন, তারা অনেকেই জেলখানায় বন্দি ছিলেন, ডিনেটশনে ছিলেন, চাকরি হারিয়েছেন, ফ্রি ভিসায় গিয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন, ভিসার মেয়াদ বাড়াতে না পেরে অনিয়মিত হয়েছেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিক কাজ করেন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে। এর কাজ বন্ধ বলে এরা ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
ঠিক কী পরিমাণ অভিবাসী শ্রমিক বৈধ কাগজপত্র ছাড়া- এর কোনো সঠিক তথ্য বা হিসাব দূতাবাসের কাছে নেই। কাদের ভিসার জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মেয়াদ শেষ হবে, কারা টাকার অভাবে ভিসা নবায়ন করতে পারেননি, এরও কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। ধারণা করা হচ্ছে, ১০ থেকে ১৫ লাখ হতে পারে।
যারা ফিরে আসছেন, তাদের আর্থিক ক্ষতির কোনো শেষ নাই। এদের অনেকেই পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা লোন নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই টাকা শোধ না করেই দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন ইয়েমেন-কাতার গোলযোগের কারণে। মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় অংশ ফ্রি ভিসায় গেছেন; ফলে তাদেরও কোনো নিয়োগকর্তা নেই। তিনমাস লকডাউন থাকার ফলে অনেকে ভিসা নবায়ন করতে না পেরে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন খালি হাতে।
করোনার সময়ে খালি হাতে দেশে ফিরে আসার ফলে পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিক সমস্যার মুখে পড়ছেন তারা। যারা ঋণ নিয়ে গিয়েছেন, তাদের পড়তে হচ্ছে ভয়াবহ চাপে। পাশাপাশি রয়েছে করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি সামাজিক স্টিগমা।
অভিবাসীদের পাঠানো টাকায় ঘুরে দেশের অর্থনীতির চাকা। অথচ করোনাভাইরাসের কারণে ইতালি, স্পেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী শ্রমিকরা ফিরে এসেছেন। সরকারের জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে অভিবাসী কর্মীদের প্রায় ৮০ ভাগই আছেন মধ্যপ্রাচ্যের আট দেশে। প্রবাসী আয়ের অর্ধেকের বেশি তারাই পাঠান। বেশি কর্মী ফিরতে পারেন সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত ও ওমান থেকে। এই পাঁচ দেশ বাংলাদেশের শীর্ষ ১০টি প্রবাসী আয়ের দেশের মধ্যে পড়ে। বাহারাইন, লেবানন আর জর্ডান থেকেও অনেক কর্মীকে ফিরতে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় একদম কমে যাবে। অর্থনীতির চাকা ঘোরাও বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সরকার বারবার বলছেন যে কোনো দেশ যদি শ্রমিকদের ফেরত পাঠায়, অন্তত ৬ মাসের বেতন যেন দিয়ে দেয়। এই দাবিটাও খুব শক্ত করে জানাতে হবে। আইএলও বলেছে, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে আরব দেশগুলোতে ৫০ লাখ লোক চাকরি হারাবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে খুব ভালো রেমিটেন্স পাওয়ার পর জানুয়ারিতে করোনাভাইরাসের কারণে রেমিট্যান্স কমতে শুরু করে।
তাহলে এখন আমাদের ভাবতে হবে, দেশের অর্থনীতিকে চালিয়ে নিয়ে যেতে এবং এতগুলো বেকার মানুষের বিকল্প কী কর্মসংস্থান হতে পারে? সরকারকে এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হলিস্টিক বা সমন্বিত প্রোগ্রামের মাধ্যমে রি-ইন্টিগ্রেশন প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে।
আমাদের নারী গৃহকর্মীদের অভিবাসন চলতে পারে হংকংকের মতো আরও কয়েকটি দেশে। জাপান আমাদের দেশ থেকে দক্ষ ও শিক্ষিত কেয়ার গিভার এখনো নিতে চাইছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের মাইগ্রেন্ট প্রোগ্রামের সমন্বয়ক সারোওয়াত বিনতে ইসলাম বলেছেন, জুনে জাপানে যাওয়ার কথা একদল কেয়ার গিভারের। গত এক বছর যাবত বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং নিয়েছেন এরা। এছাড়াও বিভিন্ন টিটিসিতে কয়েক শ ছেলেমেয়ে ট্রেনিং নিচ্ছিল জাপানে যাওয়ার জন্য। জাপান এখনো মানা করেনি। আমাদের এই যোগাযোগটা শক্তভাবে চালিয়ে যেতে হবে, যেন এই প্রকল্প চলতেই থাকে। তাহলে অনেক মেয়ে এবং কিছু ছেলে জাপানে যেতে পারবে।
হংকংয়ে নারী শ্রমিকদের বাজার এখনো আছে। চেষ্টা করে দেখতে হবে সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার বাজার নারী গৃহকর্মীদের জন্য খোলা যায় কি না। নারী অভিবাসনকে আরও উন্নত করার জন্য তেমন করে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী হয়রানির শিকার হচ্ছে, কিন্তু সরকারের পদক্ষেপ কোথায়? এই লকডাউনের সময় সৌদিতে আমাদের নারী কর্মীরা কেমন আছেন, সেটা কি খোঁজ নেওয়া হয়েছে? শোনা গেছে, সৌদিতে থাকা নারী শ্রমিকরা এই লকডাউনে দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। তাদের সাহায্য করার একটা উপায় সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে। সরকার উদ্যোগ নিলে অনেক নারী টেকনিক্যাল ও পেশাভিত্তিক কাজে যেতে পারবেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে, যারা করোনাভাইরাসের কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, সেই শ্রমিকদের ওয়েজ আর্নার্সের কোনো কাগজপত্র ছাড়াই ৫ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। তবে এর বেশি কেউ চাইলে তাকে অবশ্যই ওয়েজ আর্নার্সের স্কিমের কাগজপত্র দেখাতে হবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন অভিবাসীদের জন্য এই কল্যাণ তহবিল গঠন করেছে।
উদ্যোগটি ভালো; কিন্তু শুধু অভিবাসীদের নিজেদের টাকায় গঠিত ওয়েজ আর্নার্স তহবিল থেকে নয়, সরকারের উচিত নিজেদের টাকা থেকে আরও একটা তহবিল গঠন করা। যেন এই বিপদে পড়া অগুনতি অভিবাসী ও তাদের পরিবার আশ্রয় পায়। আর খুব সজাগ থাকতে হবে, যেন এই তহবিলের টাকা নয়-ছয় না হয়।
সরকার লোন দিয়ে এদের বিভিন্ন উদ্যোগে যোগ দেওয়াতে পারে। যেসব দেশে শ্রমিকরা কাজ করছেন, তাদের কি কোনো সামাজিক প্রটেকশন কার্যক্রম নেই? সেই প্রটেকশন কার্যক্রমে আমাদের শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকারকে কথা চালিয়ে যেতে হবে। হাল ছেড়ে দিলে হবে না। অভিবাসী শ্রমিক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। এছাড়া এইসব দেশে আমাদের দূতাবাসের ভূমিকা কী? কেন শ্রমিকরা বিপদে পড়লে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না?
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসকে বলে দেওয়া হয়েছে আমাদের নাগরিকদের খোঁজখবর রাখতে, বিশেষ করে তারা যেন ক্ষুধায় কষ্ট না পায় এবং স্বাস্থ্যসেবা যেন পায় এটা দেখতে। কিন্তু কাতারের শ্রমিকের অভিজ্ঞতা দেখলাম উল্টো।
যেহেতু আমাদের শ্রমিকরা ফিরে এসেছেন, কাজেই বাংলাদেশেরও উচিত হবে, আর কোনো বিদেশি শ্রমিক দিয়ে কাজ না করিয়ে, পদ্মা সেতু, উড়াল সেতু নির্মাণসহ বড় বড় প্রকল্পে নিজেদের দক্ষ শ্রমিকদের কাজে লাগানো। পাশাপাশি ছোট ছোট ঋণের ব্যবস্থা করে এদের ব্যবসা করার পথ খুলে দেওয়া। করোনাভাইরাস চলে গেলে আবার কীভাবে বিদেশে দক্ষ লোক পাঠানো যায়, সেই সংলাপ শুরু করা। অনেকেই আছেন, যারা ছুটি কাটাতে দেশে এসেছেন; কিন্তু আটকা পড়ে গেছেন করোনায় এবং ভিসাও শেষ হয়ে গেছে। এদেরও ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সরকারকে সেই দেশের সরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
এই দিন কেটে গিয়ে একদিন ভালো দিন আসবে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই মাঝখানের সময়টুকুতে কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়ে চালতে হবে।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন