সব কিছু চালু হলো, কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেলায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেল না!
স্মরণকালের দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকার পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া নিয়ে সরকারের শিক্ষা সংক্রান্ত দুই মন্ত্রণালয়ের নানা তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর আগে উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের মার্চ মাসে করোনা সংক্রমণ নতুন মাত্রা পেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
২৬ আগস্ট শিক্ষা সংক্রান্ত দুই মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রধানদের নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অক্টোবরের ১৫ তারিখের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামী সাতদিনের টিকা কার্যক্রমের রির্পোট ইউজিসির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী শতভাগ টিকা গ্রহণের পরই হল ও ক্লাসরুম পূর্ণমাত্রায় খুলে দেওয়া হবে। ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের এক ডোজ টিকা নেওয়া সম্পন্ন হলেই প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। যে প্রতিষ্ঠান আগে টিকা গ্রহণ কার্যক্রম শেষ করতে পারবে সেই প্রতিষ্ঠান আগে খুলবে। ১৮ বছরের কম বয়সীদের নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। ফলে এখনই প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের তালা খুলছে না।
সকল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রশ্নে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো করোনা সংক্রমণের হার। আশার কথা, সংক্রমণের হার এখন নিম্নমুখী। তবে, নিরাপদ মাত্রা পাঁচ শতাংশ বা তার কম ধরা হলে, কাঙ্খিত অবস্থা এখনো বেশ দূরে। আমরা এখন ১৪ শতাংশের আশেপাশে রয়েছি।
আমাদের জনঘনত্ব সর্বাধিক। আমাদের শিশুরা অধিকাংশই তাদের বাড়িতেও স্বল্পপরিসরে অনেকের সঙ্গে বসবাস করে। কেউ কোনো ভাবে সংক্রমিত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। যদিও এই ব্যাখ্যা এখন আর কেউ শুনতে চায় না।
আমাদের দেশে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত সবই চালু রয়েছে। অন্য সব কিছু চালু করার মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না কেন? এ প্রশ্ন আজ পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের।
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা।
এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ইতিহাস এ দেশে আর নেই। শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতি হলো। সেশনজট তীব্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। নিয়োগ পরীক্ষাগুলো বন্ধ। বাড়ছে বেকারত্ব। করোনাকালীন দুই বছরের শিক্ষাসূচী সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার রূপরেখা নিয়ে কোথাও আলোচনা হতে দেখা যায় না।
গত দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল কিনা, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সেখানে ক্লাস, পরীক্ষা, সার্টিফিকেট বিতরণ সব কিছু সম্ভব হয়েছে। তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সম্ভব হলো না কেন?
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ভার্চুয়াল মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারলে অন্যরা কেন পারলো না? এতো বড় বৈষম্য কেন ঘটতে দেওয়া হলো? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই বা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনা গেল না কেন? এরকম অনেক প্রশ্ন এখন জনমনে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা এগিয়ে গেলেও দেশের বৃহত্তর অংশটাই পিছিয়ে পড়ল।
দুটি যুক্তি সামনে আনা হয়। প্রথমটা হলো, সব শিক্ষার্থীর স্মার্ট ফোন নেই এবং অন্যটি হলো সব শিক্ষার্থী বাড়ি চলে যাওয়ায় ঢাকার বাইরে কাঙ্খিত গতির ইন্টারনেট পাওয়া যায় না। আজকের যুগে এগুলো কোনো যুক্তি হতে পারে না। এগুলো অজুহাত।
এদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ইউটিলিটি ও যোগাযোগ বাবদ বহু টাকার সাশ্রয় হওয়ার কথা। সরকারও এসময়ে বহু সেক্টরে বহু টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। ফলে যে সকল শিক্ষার্থীর উন্নত ডিভাইজ ও কাঙ্খিত গতির নেট দরকার, তাদের তা দেওয়া কোনো কঠিন কাজ ছিল না। কঠিন হলো, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা করা।
বিশ্বের বহু দেশ করোনার তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলা করছে। পাশের দেশ ভারতে সংক্রমণের হার এখন আবার ঊর্ধ্বমুখী। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটু আশার কথা শুনিয়েছে। বিশ্বে সংক্রমনের হার নিম্নমুখী হওয়ার কথা জানিয়েছে তারা। তবে আমরা বোধহয় দীর্ঘমেয়াদে করোনার সাথে খাপ খাইয়ে চলবার দিকেই এগুচ্ছি। ফলে করোনা পরিস্থিতির ঊর্ধ্ব ও নিম্ন উভয় দিকই মাথায় রাখতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল খুলে দেওয়া ও পরিস্থিতি খারাপ হলে বন্ধ করে দেওয়ার যে একরৈখিক ব্যবস্থাপনা, তা থেকে রেরিয়ে আসতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা সম্পূর্ণ কাজে লাগানোর সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার পেছনে অর্থ ব্যয় প্রকৃত অর্থে বিনিয়োগ। আজকের এই বিনিয়োগ জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে বহুগুণে ফিরে আসবে- এটাই সত্যি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য আমাদের পিছু ছাড়ে না। '৭৩ এর অধ্যাদেশের আলোকে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। সেটাই হবার কথা, কেননা, '৭৩ এর অধ্যাদেশের মাধ্যমে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, বুয়েট ও ময়মনংসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হয়েছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হবে তাদের নিজস্ব আইন ও বিধি দ্বারা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার সিনেট, সিন্ডিকেট ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিচালিত হবে। এই প্রত্যেকটি কাঠামো সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে গঠিত হয়ে থাকে। উদ্দেশ্য হলো, এখানকার গণতন্ত্র চর্চার প্রতিফলন যেন সমাজের সর্বত্র দেখা যায়।
বঙ্গবন্ধু অনেক আশা নিয়ে '৭৩ এর অধ্যাদেশ দিয়ে বলেছিলেন, "আমি তো দিলাম, এটা রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের"। সমাজের বহুত্ববাদিতা, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও গণতন্ত্র অনুশীলনের যে ব্রত নিয়ে '৭৩ এর অধ্যাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল সেটা কী রক্ষা করা গেছে?
উল্লেখিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেট, সিন্ডিকেট ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল গণতান্ত্রিক উপায়ে গঠিত হয় না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই অভিযোগ করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই উপাচার্যের ইচ্ছাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনি কাঠামোগুলো গঠিত হয়, যা খুবই দুঃখজনক।
উপাচার্য নিয়োগের রীতিও এখন আর অনুসরণ করা হয় না। সিনেট কর্তৃক প্রেরিত তিনজনের প্যানেল হতে রাষ্ট্রপতি একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এভাবেই '৭৩ এর অধ্যাদেশের মৃত্যু ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে।
করোনা মোকাবেলা, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া, ছাত্রদের অ্যাকাডেমিক ক্ষতি পুষিয়ে নেবার কোনো উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীনভাবে নিতে পারেনি। তারা কেবল সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করে থেকেছে।