সেপ্টেম্বর শেষের মন কেমন
"It was September. In the last days when things are getting sad for no reason.."
- Ray Bradbury, "The Lake", The October Country
ছোটবেলায়, মানে যখন প্রাইমারি লেভেলে পড়ি, স্কুলে যেতাম ভ্যানে করে। তেমনই একদিন স্কুল ভ্যান এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি স্কুলের নির্ধারিত শার্ট, প্যান্ট, টাই, জুতো, ব্যাজ সবকিছু পরে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে, বাবু সেজে উদ্যত হয়েছি স্কুল ভ্যানে চেপে বসতে। কিন্তু তার ঠিক আগ মুহূর্তে, আমার কপাল স্পর্শ করে ঈষৎ উষ্ণতার আঁচ পেয়ে মা রায় দিয়ে দিল, জ্বর হয়েছে আমার, স্কুলে যাওয়া যাবে না।
আমি তো মহাখুশি। দ্রুতই স্কুলের পোশাক-আশাক ছেড়ে ঘরের কাপড় পরে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। যৌথ পরিবার আমাদের। দাদি, চাচা, ফুপু সবাইকে নিয়ে এক বাড়িতে বাস। যার সঙ্গেই দেখা হতে লাগল, একই প্রশ্ন শুধোল, 'কী ব্যাপার, স্কুলে গেলি না কেন আজ?' আমি ঠোঁট ফুলিয়ে, কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে তাদেরকে খবরটা জানাতে লাগলাম, 'মা বলসে, আমার জ্বর হইসে।'
আমার চরিত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে এই গল্পটা খুবই প্রাসঙ্গিক। অন্তত আমার মায়ের কাছে। সুযোগ পেলেই এই গল্পটা বলে সে। পরিচিত, অপরিচিত সবাইকে।
আসলেই, আমার যাবতীয় আবেগ-অনুভূতির পেছনে একটা বড় ভূমিকা রয়েছে আমার মায়ের। সেপ্টেম্বরের মন কেমনের ব্যাপারটাও আমি মায়ের কাছ থেকেই আয়ত্ত করেছি।
সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যায়ে এসে মা প্রায়ই বিকেলবেলার দিকে বলে, খুব মন খারাপ হচ্ছে৷ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের এই সময়টায় খুব তাড়াতাড়ি বেলা শেষ হয়ে যায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে কি হয়নি, কিছুক্ষণের ভেতরই চারদিকে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে সন্ধে। আমি জিজ্ঞেস করি, 'এতে সমস্যা কী?' মা বলে, 'আর কয়দিন পরই তো ফাইনাল পরীক্ষা। তখন অনেক পড়াশোনার চাপ, অনেক কষ্ট।'
কী কাণ্ড দেখুন, আমার মা পড়াশোনার পাট চুকিয়েছে আরো অন্তত ত্রিশ বছর আগে। শীতকালে এখন আর তাকে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে হয় না। মানে জীবনের কঠিন পরীক্ষায় তো প্রত্যহই অবতীর্ণ হতে হয়, কিন্তু স্পেসিফিকালি শীতকালে কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না। তবু শীতকাল যখন এগিয়ে আসতে থাকে, তখন তার এই যে মন কেমন ভাবটা, তা আজো রয়ে গেছে অমলিন। আর তার দেখাদেখি, আমিও আক্রান্ত হয়েছি একই রোগে।
আমার যদিও এখনো পড়াশোনার পাট চোকেনি, এবং ডিসেম্বর নাগাদ সত্যি সত্যিই একটা সিমেস্টার ফাইনাল হয়, তবু ভার্সিটির সেই পরীক্ষা নিয়ে এত আগে থেকে উদ্বিগ্ন হওয়ার স্বভাবতই কোনো কারণ নেই।
তাহলে কেন সেপ্টেম্বর শেষের এই সময়টায় এমন মন কেমন ভাব? কেন হঠাৎ করেই চারধারের প্রকৃতির মতো এই অকিঞ্চিৎকর মানবমনেও নেমে আসতে থাকে ঘোর অমানিশার ছায়া? গ্রাস করতে চায় চায় যাবতীয় ইতিবাচকতাকে, ঠিক যেভাবে হ্যারি পটারের জাদুর জগতে আজকাবানের কারারক্ষীরা শুষে নেয় মানুষের সর্বাঙ্গীন আনন্দকে?
এই সব দায়ভার আমার মায়ের উপর চাপিয়ে দেয়াটা খুবই অন্যায় হবে। আমার মায়ের কাছ থেকে এই শীতভীতিটা আমি পেয়েছি বটে, তবে এই শীতভীতির উদ্ভাবক আমার মা নয় অবশ্যই। 'সেপ্টেম্বর ব্লুজ' নামে আসলেই একটা ব্যাপার রয়েছে, যে-কারণে আমি নিশ্চিত, ইতোমধ্যেই অনেক পাঠক সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মন কেমন ভাবের ক্ষেত্রে আমার ও আমার মায়ের সঙ্গে একাত্মবোধ করতে শুরু করে দিয়েছেন।
সেপ্টেম্বর মাস, কিংবা এই শরৎকালটা, পশ্চিমা বিশ্বে বেশ ঘটনাবহুল। একে তো গ্রীষ্মের রৌদ্রকরোজ্জ্বল আবহাওয়ার শেষে এ সময়ে দিন ছোট হয়ে আসতে শুরু করে, তেমনই আবার এ সময়েই ছেলেবুড়ো সবাইকে ফিরে যেতে হয় ব্যস্ততার ঘেরাটোপে বন্দি জীবনে। কমবয়সী যারা, তাদের গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষে স্কুলে ফেরার মাস এটি। আর বড়দের কর্মস্থলে ফেরার। ফলে এই মাসটায় এসে দীর্ঘ উইকেন্ড শেষের সোমবারের মতো অনুভূতি হওয়াই তো স্বাভাবিক!
মনোবিদদের মতে, যারা অ্যাংজাইটি বা ডিপ্রেশনের মতো আপাত সর্বগ্রাসী মানসিক সমস্যায় ভোগে, তাদের জন্য একটা ট্রিগার বয়ে আনে শরৎকাল তথা সেপ্টেম্বর। মুহুর্মুহু কাজের চাপ এবং শীতকালীন দিন ছোট হয়ে আসাই এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে দায়ী, যা স্পর্শকাতর মানুষদেরকে এক অসহ্যকর একাকিত্বের আগাম ইঙ্গিত দিয়ে যায়। হুট করেই তখন ওলটপালট হতে শুরু করে ওইসব মানুষদের দুনিয়াটা।
কী ধরনের উপসর্গ দেখা যায় তাদের মধ্যে? যেকোনো কাজে মনোনিবেশ করতে বেগ পেতে হয় তাদের। অপরাধবোধ চাগিয়ে ওঠে মনে। ঘুম হয় না ঠিকমতো, ফলে দিনের বেলা অনেককেই দেখা যায় ঝিমোতে, হাই তুলতে। খাবারের প্রতিও চলে আসে অরুচি, কিংবা অতিরুচি। ফলস্বরূপ দুম করে কমে বা বেড়ে যায় ওজন। সিদ্ধান্তহীনতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সব কাজেই কেমন একটা দোনোমনা ভাব পরিলক্ষিত হয়। সচরাচর যেসব কাজে তারা আনন্দ ও সুখানুভূতির ছোঁয়া পেত, সেগুলোকেও বড্ড একঘেয়ে, অপ্রীতিকর বোধ হতে থাকে। যারপরনাই বিরক্ত, খিটখিটে হয়ে যায় মেজাজ। দরজা বন্ধ করে কাঁদতে মন চায় খুব। আর এই সবকিছুর চূড়ান্ত ফলাফল? সামাজিকভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। একাকিত্ব এসে টুঁটি চেপে ধরবার আগেই, নিজেই তাকে দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করা।
যদি নিজের কথা বলি, এই সেপ্টেম্বর ব্লুজ আমাকে খুব, খুব ভুগিয়েছে গত বছর। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে শুরু হওয়া মন কেমন ভাবটা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আমার অন্তঃকরণে শীতের প্রতি ঠিক এতটাই শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব সৃষ্টি করেছে যে, ফেব্রুয়ারি মাসের কটকটে রোদের মাঝেও আমি ভারি জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়িয়েছি ঢাকা শহরের রাস্তায়। লোকজন দেখে আলগোছে মুচকি হেসেছে, পরিচিতরা চোখ কপালে তুলেছে। তারা ভেবেছে, নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছি আমি। আসলে গরমের শুরুতেও যে আমার ওই জ্যাকেট পরে ঘোরা, তা যে শরীরের নয়, মনের শীতানুভূতি তাড়াতে, তা তো হায় বোঝেনি কেউই!
ঠিক কী কারণে গত বছর সেপ্টেম্বর ব্লুজ আমাকে এতটা যাতনা দিল, তা বোঝা আসলে খুব কঠিন কিছু না। করোনার কারণে সেই ২০২০ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকেই যে গৃহবন্দি ছিলাম। মুখোমুখি যোগাযোগ বা শারীরিক মিথস্ক্রিয়া যে একপ্রকার বন্ধই হয়ে গিয়েছিল পরিবারের সদস্য বাদে বাকি সকলের সঙ্গে। মুষ্টিমেয় যে কয়বার মোলাকাত হয়েছে প্রিয়জনদের সঙ্গে, তাদের মুখটা তো প্রাণভরে দেখতে পারিনি, কেননা তা ছিল মুখোশের আড়ালে। আর নৈকট্য ও স্পর্শ, যা খুব জরুরি যেকোনো ধরনের সম্পর্কে, তা তো পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেছিল সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের কবলে পড়ে!
তাই আমি নিশ্চিত, গেল বছরের সেপ্টেম্বর ব্লুজ অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে অনেক বেশি মানুষকে পাকড়াও করেছে, ছারখার করে দিয়েছে তাদের জীবন। আর সেটির স্থায়িত্বও বোধকরি তুলনামূলক অনেক বেশিই ছিল, যেমন আমার ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত পুরো পাঁচ মাস লাস্টিং করেছিল।
তবে যাক সেসব কথা। আমি এই লেখা লিখছি আর আপনারা এই লেখা পড়ছেন, তার মানে আমরা দুই পক্ষই তো গেল বছরের সেপ্টেম্বর ব্লুজকে জয় করতে সক্ষম হয়েছি। হয়তো সেপ্টেম্বর ব্লুজ আমাদেরকে অনেকটাই দুর্বল করে ছেড়েছে, এর বিভীষিকা আমাদের তাড়া করে বেড়িয়েছে বহুদিন, তবু আমরাই তো শেষ পর্যন্ত বিজয়ী!
এখন প্রশ্ন হলো, আরো একটি সেপ্টেম্বর ব্লুজকে আমরা সহি-সালামতে পার করতে পারব তো?
ভুলে যাবেন না, করোনাকালীন দুর্দশা কিন্তু এখনো আমাদের মাফ করে পাকাপাকিভাবে বিদায় নেয়নি। এখনো করোনার ভয় ঠিক একইভাবে জেঁকে বসে আছে আমাদের মনস্তত্ত্বে। প্রতি মুহূর্তে আমরা আতঙ্কিত হয়ে আছি, এই বুঝি আবির্ভূত হলো করোনার তৃতীয় ঢেউ, ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমাদের সবাইকে!
আর সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে আরো কিছু ব্যাপারও। বেশ অনেকদিন হোম অফিসের পর সম্প্রতি সশরীরে কর্মস্থলে যোগ দিয়েছে অনেকেই। আবার স্কুল-কলেজও তো খুলে গেল সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একযোগে হল খুলে দিয়ে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর দ্বারপ্রান্তে। অর্থাৎ এখানেও পশ্চিমাদের সঙ্গে এক আজব কাকতাল, ঠিক যেভাবে সচরাচর তাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো চালু হয় আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে!
ফলত আরো একবার সেপ্টেম্বর ব্লুজে নিজেকে হারাতে শুরু করে দিয়েছে অনেকেই। সামনের দিনগুলোতে আরো অনেকেই হয়তো হারিয়ে খুঁজবে নিজেকে।
জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে টানা আঠারো মাসের মতো বাড়িতে, পরিবারের সান্নিধ্যে থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয় খোলা উপলক্ষ্যে আমিও খুব শীঘ্রই ফিরতে যাচ্ছি যান্ত্রিক, কোলাহলময়, এবং জন-অরণ্যের মাঝেও এক ভীষণ একাকিত্বের, ঢাকা শহরে। তাই আমারও যে শেষ পর্যন্ত অবস্থা কেমন হবে, সত্যিই জানি না আমি!
তাই সেপ্টেম্বর ব্লুজের মন কেমনকে সিরিয়াসলি না নিয়ে উপায় নেই। এই ব্লুজের করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে কয়েকটি টোটকা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি আমি।
- খুব বেশি কাজে জড়িয়ে ফেলবেন না নিজেকে। ঠিক যতটুকু আপনার সামর্থ্যে কুলোয়, ততটুকুই কাজ করুন। নিজের উপর অতিরিক্ত চাপ দেয়া থেকে বিরত থাকুন।
- 'না' বলুন, 'না' বলার প্র্যাকটিস করুন। এই সময়টায় আবহাওয়া, মেজাজের সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন রুটিনেও ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে, যা এমনিতেই বড় বেশি কঠিন করে তুলবে আপনার জীবনকে। এর মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো প্রস্তাব বা অনুরোধ যদি আপনাকে দেয়া হয়, তবে নির্দ্বিধায় সেটিকে 'না' করুন। মনে রাখবেন, কাউকে কোনো কমিটমেন্ট দিলে সেটি পূরণ করতে হয়। তাই সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজেকে নাজেহাল করার আগে, নিজের প্রতি কমিটমেন্টগুলোকে আগে রক্ষা করুন।
- ঘুমের সঙ্গে কোনো কমপ্রোমাইজ করা যাবে না। আপনার যাবতীয় অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন এবং মনোযোগহীনতার পেছনে একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে আপনার পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবের। তাই প্রতিরাতে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমোন, নিজের মনকে চাঙ্গা রাখুন।
- পরিবার, প্রিয়জন ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন, তাদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করুন। একাকিত্বকে যদি ভয়ই পান, তাহলে নিজে থেকে একাকিত্বকে ডেকে আনার তো কোনো মানেই হয় না, তাই না?
এই লেখা শেষ করার আগে যে কথাটা বলব, সেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। দয়া করে আপনার মন কেমন ভাবটাকে অবহেলা করবেন না। যদি উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো মেনে চলার পরও মানসিকভাবে নিম্নচাপে, অবসাদে, শূন্যতায়, হাহাকারে বা উদ্বেগে ভোগেন, আত্মহানির কুডাক ডাকে মনে, তবে অতিসত্ত্বর কোনো পেশাদার মনোচিকিৎসক বা থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হোন। আপনার কাছের কোনো মানুষের মাঝেও যদি এ ধরনের উপসর্গ বা প্রবণতা লক্ষ করে থাকেন, তবে তাকেও বাধ্য করুন পেশাদারের দ্বারস্থ হতে।
গ্রিন ডে হয়তো গানে গানে বলেছিল, "Wake me up when September ends..." কিন্তু আমাদের তো জীবন সংগ্রামের তাগিদে ঘুমিয়ে কাটালে চলবে না। তাই চলুন জেগে থাকি একসাথে, বরণ করে নেই সেপ্টেম্বর শেষের অক্টোবরকে। উপভোগ করি তৎপরবর্তী শীতকালকেও।
শীতের শিশিরভেজা শিউলি সকাল কিংবা কনে-দেখা-আলো-ছোঁয়ানো সুগন্ধি বিকেলগুলোকে প্রাণভরে অনুভব করে জীবনের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদ করতে হবে যে!
-
লেখক: সাংবাদিক, অনুবাদক