স্মৃতি থেকে গল্প: মুরগি মিলন থেকে ছাত্রনেতা বাবলুর মৃত্যু এবং আরো কেউ কেউ
সত্তরের দশকের শুরুর কথা। ভূতের গলিতে থাকতাম আমরা। সেই উঠানওয়ালা বাড়িটিতে আম্মা হাঁস, মুরগি, কবুতর পালতো। তখনকার দিনে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা খুব কম ছিল বলে বাসাটা একটা মানুষ সমান দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। অন্যকিছু চুরি না গেলেও ছ্যাঁচড়া চোর এসে প্রায়ই মুরগি, হাঁস নিয়ে যেতো। সকালে আম্মার আক্ষেপের শেষ থাকতো না। এসব পাহারা দেয়ার জন্য একটা দেশি কুকুর পালারও কথা হয়েছিল। পাড়ার লোকেরা আম্মাকে জানিয়েছিল এখানে মুরগি চুরি হবেই। কারণ বাসার পেছনে বস্তিতে মিলন নামে একটি ছেলে থাকে, সেই পাড়া-মহল্লা থেকে মুরগি চুরি করে। এইভাবেই তার নাম হয়ে গিয়েছিল মুরগি মিলন।
এরপরে আমরা যখন ভূতের গলি ছেড়ে নর্থ সার্কুলার রোডে এসে বাসা নিলাম, তখন আম্মার পশুপাখি পালনের পাট চুকাতে হলো, জায়গার অভাবে। তবে এই পাড়ার পাশে পেলাম তৎকালীন সময়ের আরেক গুন্ডা, যাকে সবাই সিদ্দিক গুন্ডা নামে ডাকতো। সিদ্দিক গুন্ডার বৈশিষ্ট্য ছিল সে পাড়ায় কোন গুন্ডামি করতো না। এরপরও রাতে মায়েরা সিদ্দিক গুন্ডার কথা বলে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতো।
হঠাৎ একদিন শুনলাম সিদ্দিক গুন্ডা নিহত। আরো অবাক হলাম ক্ষমতার ভাগাভাগিতে মুরগি মিলনের বাহিনীর হতে সিদ্দিক গুন্ডা মারা গেছে। এর মানে মুরগি মিলন আর সেই ছোটখাট মুরগি চোর নেই, সে বড় গুন্ডায় পরিণত হয়েছে। সেদিন আমরা পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে সিদ্দিক গুন্ডার বাসায় গিয়েছিলাম, তাকে দেখতে। হয়তো মনে মনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে মায়েরা আর ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে পারবেনা।
১৯৯৭ সাল। ভোরের কাগজে কাজ করি। রাতের শিফটে ডিউটি। হঠাৎ শুনলাম অফিসময় একটা হৈ চৈ। শুনলাম মুরগি মিলন দলবল নিয়ে অফিসে এসে হাজির। তার নামে সেদিনের ভোরের কাগজে একটা খবর ছাপা হয়েছে। আর তাই সে এসেছে রিপোর্টারকে ধোলাই দিতে। কারণ এই রিপোর্টারই তাকে এই রিপোর্টে প্রথমবারের মতো "মুরগি মিলন" নামে আখ্যায়িত করেছে। আমাদের সেই রিপোর্টারের নাম ছিল জায়েদুল আহসান।
মুরগি মিলন খুব ক্ষুব্ধ হয়ে চিফ রিপোর্টারের সামনের চেয়ারে বসে জায়েদুল আহসানকে বকাঝকা করছিল। আমরা মোটামুটি সবাই রিপোর্টিং রুমে জড়ো হলাম মুরগি মিলন ও তার দলবলকে দেখার জন্য। দেখি মুরগি মিলনের পকেট থেকে রিভলবারের বাট বের হয়ে আছে। তাই দেখেতো আমাদের চোখ ছানাবড়া।
তবে মজাটা হচ্ছে মুরগি মিলন জায়েদুল আহসান ভেবে যে রিপোর্টারকে উদ্দেশ্য করে বকাবকি করছিল, সে ছিল মাঈনুল আলম, যাকে অল্পবয়সে তার গার্ম্ভীযের জন্য আমরা সচিব বলে ডাকতাম। মাঈনুল এসব নিউজের ধারেকাছেও ছিলনা। ও সচিবালয় বিটের কাজ কাজ করতো। মাঈনুলের চশমা ছিল ভারী লেন্সের। তাই ওর দিকে তাকিয়ে মুরগি মিলন বলতে থাকলো, এইসব আজেবাজে রিপোর্ট করলেতো চোখ খারাপ হইবোই। তখন কিন্তু মাঈনুলের চেহারাটা দেখার মতো হয়েছিল।
এদিকে জায়েদুল আহসান একপাশে চুপচাপ বসে আছে। অপরাধ জগতের লোকজন ওকে সবাই সাংবাদিক পিন্টু নামেই চেনে, জায়েদুল আহসান নামে চেনেনা। কাজেই এযাত্রায় ওকে সরাসরি ঝাড়ি খেতে হলোনা। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মুরগি মিলনের পুরো রিপোর্টের বিষয় নিয়ে কোন আপত্তি নেই। আপত্তি হচ্ছে একটাই, তা হলো ওকে মুরগি মিলন লেখাটা ঠিক হয়নি। তার ইজ্জত কী বাৎ।
এতদিন পর প্রথম আলোতে মুরগি মিলনের খবর পড়ে আমার অনেক কথা মনেপড়ে গেল। রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ঢাকা শহরে অর্ধশত কোটি টাকার ওপরে সম্পদ নিয়ে দুই পক্ষ মুখোমুখি। যে ব্যক্তি এই সম্পদের মালিক, তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা দুই পক্ষের কেউই প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না। সম্পদশালী এই ব্যক্তি আর কেউ না, সেই হচ্ছে মুরগি মিলন। একসময় ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াতো, দলেবলে গাড়ি হাঁকিয়ে, আগে-পিছে অস্ত্রসমেত পাহারা নিয়ে। বছরে দু-তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে সংবাদপত্রের শিরোনামও হতো। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় ছিল, শুধু ছিল না সামাজিক স্বীকৃতি।
অবশ্য রিপোর্টে উল্লেখ করা হযেছে যে তার বাবা মুরগির ব্যবসা করতো বলে ছেলের নাম মুরগি মিলন হয়েছে। মা-বাবার দেওয়া হুমায়ূন কবির নামটি হারিয়ে যায় 'মুরগি মিলন' নামের আড়ালে। আর নিজের অর্জিত সন্ত্রাসী উপাধি যোগ হয়ে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে পরিচিতি পায় 'সন্ত্রাসী মুরগি মিলন' নামে। আমার জানামতে মুরগি চুরির দায়ে তার এই নাম হয়েছিল।
এই মুরগি মিলনকে ২০০০ সালে পুরান ঢাকার জজ কোর্ট এলাকায় ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয়। সেভেন স্টার গ্রুপের পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর এবং ডাকাত শহিদ এই হত্যা মিশনে সরাসরি অংশ নেয়। পুলিশের একাধিক সূত্রের মতে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে যে সোনা চোরকারবারি হতো, তার নেতৃত্ব দিত মুরগি মিলন।
এরপর আসি যুবলীগ নেতা আওরঙ্গ এর কথায়। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে বিবেচনা করা হতো সাবেক যুবলীগ নেতা আওরঙ্গকে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও অনেকে তার নাম জানতো। রাজনীতির সাথে যোগাযোগ ছিল, এমন একজন ব্যক্তি ৮০ এর দিকে রংপুর থেকে ঢাকায় আমাদের বাসায় এসেছিল, শুধু আওরঙ্গর বাসাটা সে বাইরে থেকে দেখবে, আর ফিরে গিয়ে সবাইকে বলবে। একসময়ের জনপ্রিয় এই রাজনৈতিক নেতা কীভাবে নাম লেখালেন আন্ডারওয়ার্ল্ডে তা নিয়ে অনেক তক-বিতর্র্ক রয়েছে। তবে তার সাহসিকতা ও প্রতাপ নিয়ে অনেক কথা চালু ছিল। শোনা যায় আওরঙ্গের নাম শুনলে বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খেতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়তো, এমন একজন সাংবাদিকের কাছে আওরঙ্গকে নিয়ে মজার একটি গল্প শুনেছিলাম। একদিন তারা কয়েকজন ছাত্র মিলে বাংলা বিভাগের সামনে করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ সেখানে কয়েকটি অপরিচিত ছেলেপেলে এসে বিভাগের বোর্ডে পোষ্টার লাগানো শুরু করলো। বিভাগের ছেলেরা স্বভাবতই তেড়ে গেলো। বলল তোমরা কে হে? কোন অনুমতি ছাড়াই ডিপার্টমেন্টের বোর্ডে পোষ্টার লাগাচ্ছো? পারবা না লাগাতে।
কথায় কথায় দু'পক্ষের ঝগড়া বেধে গেল। ডিপার্টমেন্টের আরো ছেলেমেয়ে এসে জড় হলো। যারা পোষ্টার লাগাতে এসেছিল, তাদের একজন বলল, এটা আওরঙ্গ ভাইয়ের কাজ। বাংলা বিভাগের ছেলেদের গ্রুপটাও জোরেসোরে বলে উঠল, আরে রাখো। আওরঙ্গর নামে আর কত ভয় দেখাবা তোমরা? কিছু লাগাতে দিবোনা। ঠিক এইসময় ঐ দলেরই একজন এগিয়ে এল, যে এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। সে এগিয়ে এসে বলল ভাই আমিই আওরঙ্গ। আমিই বলেছি এসব লাগাতে সব ডিপার্টমেন্টে। এই কথা শোনার পর নাকি, তাদের সবার পেট কেমন জানি মোচড় দিয়ে ব্যথা করে উঠল এবং সবাই রণে ভঙ্গ দিয়ে সটকে পড়লো।
শোনা যায় ১৯৮১ সালে রাজধানীর সাকুরা বার-এর সামনে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় প্রতাপশালী যুবলীগ নেতা আওরঙ্গের বিরুদ্ধে। এরপরই তিনি ভারতে চলে যান। জিয়া ও এরশাদ সরকারের সময় তাকে দেশে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে অবশ্য আওরঙ্গ দেশে ফিরতে পেরেছিলেন।
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রদলের নেতৃত্ব নীরু-বাবলুর হাতে। বেদম ক্ষমতাশালী ছিল অভি, নীরু, বাবলু এই তিনজন। প্রায়ই মিছিল, মিটিঙে এদের দেখেছি। সেইসময়টা ছিল ছাত্র রাজনীতির চরম উত্তাল সময়। একদিকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এবং অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাথে সম্মিলিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিরোধ। এরমধ্যে এল এরশাদের তৈরি করা নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ।
১৯৮৩ সালে নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৯৪ সালে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জাতীয় ছাত্র সমাজ। তৎকালীন শাকসগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় জাতীয় ছাত্র সমাজ সারাদেশে শক্তিশালী সংগঠনে রূপ নেয়। সে সময় ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের কিছু কেন্দ্রীয় নেতা ছাত্র সমাজে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক সাইটের নেতা গোলাম ফারুক অভি, সানাউল্লাহ নিরু, ইকবাল হোসেন রাজু (জাসদ ছাত্রলীগ) নজরুল ইসলাম বাবু, গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ অনেকে ছাত্র সমাজে যোগ দেয়াতে, পুরো ক্যাম্পাসে এই ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্র হিসেবে খুবই মেধাবী অভির রাজনৈতিক ক্ষমতা, অসাধারণ সুন্দর চেহারা এবং ব্যাপক বুদ্ধিমত্তা ও রণকৌশলকে কাজে লাগাতে থাকলো এরশাদ সরকার।
আমরা যারা সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তারা দেখেছি কীভাবে ছাত্র রাজনীতি সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ চলতে চলতেই দেখেছি রিভলবার হাতে বা দা-কুড়াল নিয়ে একপক্ষ অন্যপক্ষের দিকে ছুটে যাচ্ছে। মিছিল আর মিটিঙের শব্দে সারাটা সময় ক্যাম্পাস থাকতো উত্তাল। সবাই কেমন জানি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম এইসব মারামারি, হানাহানিতে। পরীক্ষাগুলো কমপক্ষে ৬/৭ বার করে পিছিয়েছে এরশাদ ভ্যাকেশনের কারণে।
বিভিন্ন কারণে এইসময়টা আমাদের কাছে উল্লেখযোগ্য ছিল। তবে একটি ঘটনার কথা না বললে লেখাটা অসমাপ্ত রয়ে যাবে। ১৯৮৭ সালে মুহসীন হলের ৪২৬ নম্বর কক্ষে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন ছাত্রদলের নেতা মাহবুবুল হক বাবলু এবং তাঁর দুই সহযোগী মইনুদ্দীন ও নূর মোহাম্মদ। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে পুরো এলাকায় পুলিশ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। সবাইকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল।
এই বোমা বিস্ফোরণের খবরে আমার বন্ধু সুমি ও আমার মধ্যে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হলো ৪২৬ নাম্বার কামরাটি দেখার জন্য। ঘটনার পরদিনই বাসা থেকে জোরজবরদস্তি করে অনুমতি নিয়ে আমরা দু'জনে ছুটে গেলাম। পুলিশী বাধা সরিয়ে আমাদের দুই সাংবাদিক বন্ধু সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ও মঞ্জুরুল ইসলাম আমাকে আর সুমিকে সাংবাদিকতা বিভাগের কোটায় মহসীন হলে নিয়ে গেল।
আমরা ঐ ঘরে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম কামরাটির মেঝে মাঝখানে পুরো উড়ে গেছে। আর সেখান দিয়ে উঁকি দিয়ে নীচতলার কক্ষের তোষক, বালিশ দেখা যাচ্ছে। কী সাংঘাতিক একটা ব্যাপার ভাবতেই অবাক লাগছিল। এই রুমেই গতকালকে তিনজন ছাত্র নিহত হয়েছে, যারা একসময় রাজপথ কাঁপাতো। এই ছাত্রনেতারা হলের ভিতরে বোমা বানাতে গিয়ে নিহত হয়েছিল বলে শোনা গিয়েছিল।
রাতারাতি ছাত্র সমাজের উত্থানে নড়েচড়ে বসেছিল তৎকালীন সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো। ক্যাম্পাসে শুরু হয়েছিল সন্ত্রাস। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও হল দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে ছাত্র সংগঠনগুলো। শিক্ষাঙ্গনে ঝরে পড়লো অনেক শিক্ষার্থীর লাশ। গোলযোগ কমানোর জন্য এরশাদ সরকার ক্ষমতাসীন দলের এই ছাত্র সংগঠনকে বিলুপ্ত করে দিল। যে কারণে ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পক্ষে শ্লোগান দেয়ার জন্য রাজপথে বা শিক্ষাঙ্গনে কেউ ছিলো না।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন