সাবধান, ‘ফিজিটাল’ হতে গিয়ে যেন ‘মস্তিষ্কে পচন’ ধরে না যায়
প্রায় ১৪/১৫ বছর আগের কথা। স্কুলে পরীক্ষার পরে মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পরীক্ষা কেমন হলো? স্মার্টলি বললো 'কুল' হয়েছে। তথমত খেয়ে জানতে চাইলাম, পরীক্ষা আবার কুল হয় কেমন করে? কুল মানেতো ঠান্ডা। তাহলে কি তেমন ভালো হয়নি? বললো, 'মা আমাদের কাছে কুল মানে ভালো।' সেই জানলাম, ওরা 'কুল' বলতে 'ভালো' বোঝায়।
একদিন ভাগ্নি খুশি হয়ে বললো, 'খালামণি, তুমি খুব রকি।' আবার ধাক্কা খেলাম 'রকি' শব্দটি শুনে। আমি রকি? মানে কী পাথুরে বা খটখটে? জানতে চাইলাম, এই রকি মানে কী? বললো 'জোশ'।
আমার মেয়ে ও ভাগ্নি দুজনেই ছিল 'জেনারেশন ওয়াই', যাদেরকে বলা হয় 'মিলেনিয়ালস'। এদের জন্ম ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে। তখনই জেনেছিলাম, এই প্রজন্মের কথা, শব্দ প্রয়োগ, শব্দার্থ, ইশারা ভাষা, এমনকি লেখার সাইনও অন্যরকম। ওরা বন্ধুরা যখন কথা বলতো, টেক্সট চালাচালি করতো— তা সবই বেশ দুর্বোধ্য ছিল আমাদের, অর্থাৎ অভিভাবকদের কাছে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম এসেছে, ওদের পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করেছি। কোনো কোনো পরিবর্তন পজিটিভ মনে হয়েছে, আবার কোনো কোনোটা অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তবে প্রজন্মের নাম, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও তাদের কালচার নিয়ে খুব একটা ভাবিনি। ধরেই নিয়েছি, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে কিছু পরিবর্তন থাকবেই। তবে ২০২৪ সালে দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন জেন-জিদের পরিচয় নতুন করে তুলে ধরেছে। আমরা যারা পুরোনো মানুষ, তারা নতুন করে বুঝতে চেষ্টা করেছি ওদের মনোভাব, চাওয়া-পাওয়া।
জেন-জিদের আন্দোলন সফল হয়েছে, তাদের হাত ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে। এই আন্দোলন চলাকালে প্রজন্ম মিলেনিয়ালস, জেন-জি, আলফাদের নিয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি এদের জীবনধারার সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন ফ্যাক্টর।
ইন্টারনেট সংস্কৃতি জোরালোভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের উত্তরসূরীদের জীবনযাত্রার সাথে। এছাড়াও সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী 'বেবি বুমার্স', এবং ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সালে জন্মগ্রহণকারী 'জেনারেশন এক্স'এর সাথেও। তবে জেন-জি ও আলফারা ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির মধ্যে বেড়ে ওঠার কারণে ডিজিটাল নাগরিক হিসেবে পরিচিত।
বেবি-বুমার্স ও জেনারেশন এক্স এর চিন্তা-ভাবনা ও সময় কাটানোর মাধ্যম যেখানে বইয়ের মধ্যে আটকে ছিল, অন্যদিকে জেন-জি'রা বই পড়াকে সময়ের অপচয় হিসেবে দেখছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। যদিও গবেষণাটি করা হয়েছে উন্নত বিশ্বের শিক্ষার্থীদের ওপর, কিন্তু এই ফলাফল আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ অধ্যাপক জানিয়েছেন, তারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যের প্রতি মনোযোগী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রজন্মগত পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। এর বড় কারণ স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব। আজকের প্রজন্মের পাঠে আগ্রহ নেই। অবশ্য তরুণরা বলছেন, এসব বই গুরুত্বপূর্ণ নয়। অধ্যাপকরা মনে করেন, তাদের শিক্ষার্থীরা অলস নন। তবে তারা হতবাক হয়েছেন এটা দেখে যে, এখনকার কলেজ শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকে ও সবসময় উদ্বিগ্ন থাকে। আর তারা তাদের সময়সূচির বেশিরভাগ ব্যক্তিগত উন্নয়নের চেয়ে ভবিষ্যৎ চাকরির জন্য প্রাসঙ্গিক কাজে ব্যয় করে।
এর বাইরেও দেখা যাচ্ছে ইন্টারনেট সংস্কৃতি শুধু বিভিন্ন বয়সের মানুষের ওপরেই নয়, শব্দসম্ভারেও জায়গা করে নিয়েছে। যেমন— 'ডিমিউর' এবং 'রোমান্টিসি'কে হারিয়ে 'ব্রেন রট' শব্দটি ২০২৪ সালে অক্সফোর্ড 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার' হয়েছে।
ব্রেন রট সোজাভাবে বললে বোঝায়, 'মস্তিষ্কে পচন'। শব্দটির আধুনিক ব্যবহারকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে, 'একজন ব্যক্তির মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থার অবনতি। বিশেষ করে, অনলাইনে প্রদর্শিত বিষয়বস্তুগুলো অতিরিক্তহারে দেখা ও এগুলোকে মামুলি বিষয় মনে করা বা বাছ-বিচার না করেই গ্রহণ করা।'
মানুষের মনে, চিন্তায় ও যুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সেই কনটেন্টের প্রভাব বেশ নেতিবাচক। শব্দটি ডিজিটাল মিডিয়ার অত্যধিক ব্যবহারকেও বোঝায়, বিশেষ করে সংক্ষিপ্ত আকারের এমন বিনোদন— যা মানসিক স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। লক্ষ্য করে দেখবেন, শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ পর্যন্ত সবার ওপরেই রিল, টিকটকের প্রভাব অনেক বেশি। মানুষ আশেপাশের বিষয় বা অবস্থাকে খেয়াল না করেই ইন্সটাগ্রামের রিলস কিংবা টিকটক ভিডিও দেখতে দেখতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করছেন, দীর্ঘসময় ফোন স্ক্রল করতে করতে ক্লান্ত ও দ্বিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে যাচ্ছেন। তারা ভুলে যাচ্ছেন কেন ফোনটা হাতে নিয়েছিলেন বা কী কথা বলতে চেয়েছিলেন? অবস্থা এমন হলে বুঝতে হবে মানুষটি 'ব্রেন রট' প্রবণতায় ভুগছেন। শব্দটি জেনারেশন আলফা এবং জেনারেশন জেডের অনলাইন সংস্কৃতির মধ্যে চালু হয়েছিল। কিন্তু তারপর এটি মূলধারায় চলে এসেছে।
'ব্রেন রট' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন হেনরি ডেভিড থোরো ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত তাঁর 'ওয়াল্ডেন' বইতে। সেখানে থোরো সমালোচনা করছিলেন, তিনি বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক মানের পতন লক্ষ্য করছেন। সেখানে জটিল ধারণাগুলোকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে এটি ২০০৪ সালের প্রথম দিকে ব্যবহার করা হয়েছিল। এর ব্যবহার ২০১০ এর দশকে অনলাইনে অনেক বেড়ে যায় এবং ২০২৩ সালে এসে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এরপর এটি 'ইন্টারনেট মিম' হয়ে ইন্টারনেট জগতে ছড়িয়ে পড়ে ২০২৪ সালে। জেনারেশন আলফার ডিজিটাল অভ্যাসের প্রেক্ষাপটে 'ব্রেন রট' শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হয়। অবশ্য সমালোচকরা মনে করেন, এই প্রজন্ম অতিরিক্ত পরিমাণে অনলাইন সংস্কৃতিতে ডুবে গেছে। এই শব্দটি জেনারেশন আলফারা স্ল্যাং ও প্রবণতা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ব্রেন রট টার্মটি ২৩০ শতাংশ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।
মানুষ যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত সময় কাটায়, তখন তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক ওপর পড়তে বাধ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং অন্তসারশূন্য আধেয় (কনটেন্ট) সব বয়সের মানুষের মনোযোগ নষ্ট করে, পড়াশোনায় মনসংযোগ কমে যায়, ও দৈনন্দিন কাজকে বিঘ্নিত করে।
যখন কোনো মানুষ একটানা তুচ্ছ বা বুদ্ধিহীন কাজ করতে থাকে, গুরুত্বহীন জিনিস দেখতেই থাকে, তখন ধরে নিতে হবে সেখানে তার ব্রেনের ব্যবহার নেই।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস বলেছে— অনলাইনে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিম্নমানের আধেয়র পেছনে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয়ের ফলে যে প্রভাব পড়ে, সে উদ্বেগ তুলে ধরতে ২০২৪ সালে এই পরিভাষা নতুন করে ব্যাপকতা পায়।
অক্সফোর্ড ল্যাঙ্গুয়েজের প্রেসিডেন্ট ক্যাসপার গ্রাথাল মন্তব্য করেছেন, 'ভার্চুয়াল জীবনের অনুমিত ঝুঁকি এবং কীভাবে আমরা আমাদের অবসর সময় কাটাচ্ছি, সেটি তুলে ধরছে ব্রেন রট।
ক্যাসপার বলেন, 'জেন-জি ও জেন-আলফা যে ব্রেন রটের মতো শব্দকে গ্রহণ করেছে, সেটাকে আমার কাছে চমকপ্রদই মনে হচ্ছে। এই পরিভাষা যেসব ডিজিটাল আধেয়র প্রতি ইঙ্গিত করে, সেগুলো ব্যবহার ও নির্মাণের দায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই দুই প্রজন্মের সদস্যদের ওপরই বর্তায়।'
তিনি আরও বলেছেন, 'গত দুই দশকের অক্সফোর্ড "ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার" এর দিকে ফিরে তাকালে আপনি দেখতে পাবেন, কীভাবে আমাদের ভার্চুয়াল জীবন বিকশিত হচ্ছে। একইসাথে ইন্টারনেট সংস্কৃতি ঠিক করে দিচ্ছে আমরা কে এবং আমরা কী নিয়ে কথা বলি সেটিও।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ভার্চুয়াল জীবন, নেটফ্লিক্স, প্রাইম আমাজন, অসংখ্য টিভি চ্যানেল, ফেসবুক ও ইউটিউবের যুগের এই প্রভাব মানুষকে একদিকে যেমন চব্বিশ ঘণ্টা তথ্য দিচ্ছে, বিনোদিত করছে— তেমনি কেড়ে নিচ্ছে ব্যক্তিগত জীবন, ব্যক্তির নিজস্ব সময়, চিন্তা ও পড়াশোনার অভ্যাস। স্ন্যাপচ্যাট এবং টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো খুব দ্রুতগতিতে আকর্ষণীয় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ কন্টেন্ট দিচ্ছে যে মানুষ ভাবতেও ভুলে যাচ্ছে। দ্রুতগতির জীবনধারায় পাল্টে যাচ্ছে বিনোদন, সামাজিকীকরণ, ব্যবসায়িক কার্যক্রম, এমনকি পারিবারিক সম্পর্কও। বলা যায়, আমরা 'ফিজিটাল' জীবনে প্রবেশ করেছি। ভৌত বা 'ফিজিক্যাল' এবং 'ডিজিটাল'— এ দুটির সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে 'ফিজিটাল' শব্দটি— যা এখন বাস্তব।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সবার হাতে হাতে এসেছে স্মার্টফোন, ট্যাব ইত্যাদি। এখন অবসর কাটছে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। ফলে বই, আড্ডা, মুখোমুখি কথোপকথন, পারিবারিক আসর তেমনভাবে আমাদের টানছে না। আমাদের পরিবারগুলোতেও নেই নিয়মিত পড়ার চর্চা। বই পড়লে স্মৃতিশক্তি বাড়ে। বই পড়ার সময় মস্তিকের যে অংশটি স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, সেই অংশটি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়। অথচ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিম্নমানের আধেয়র পেছনে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করে ব্রেনকে নষ্ট করে ফেলছি।
সময় যত সামনে যাবে মানুষের জীবনযাপণ, চিন্তাভাবনাও ততোটা বাস্তববাদী এবং যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমরা মনে করি। যদিও নতুন প্রজন্ম মনে করে, এমন ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে রাখা উচিত নয়— যা সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে পিছিয়ে দেয়। কিন্তু সেইসঙ্গে একথাও মানতে হবে ইতিহাস চর্চা ছাড়া জাতি শিকড়বিহীন। ইতিহাস, অভিজ্ঞতা কখনো মানুষকে পেছনে টানে না, বরং ঋদ্ধ করে। প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে 'ফিজিটাল' হওয়া মানে অতীতকে, পূর্ব প্রজন্মকে অবজ্ঞা করা নয়।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।