‘আমি একজন বাংলাদেশি হিন্দু, আজ আমারও কিছু বলার আছে...’
ধর্মান্ধদের হাতে দুর্গাপ্রতিমার বিকৃতি বা মন্দিরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় আমি আঘাত পাইনি। জীবনে বহুবারই তো দেখেছি দেবীমূর্তি খণ্ডবিখণ্ড করার ঘটনা। এনিয়ে আমার অনুভূতিও তাই শূন্য, নিরাসক্ত প্রায়। বরং তারা কাউকে শারিরিক আঘাত করেনি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। কিন্তু, যখন মৃত্যুর কথাও জানলাম, আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করলো। নিজ সম্প্রদায়কে নিয়ে উৎকণ্ঠা শুরু হলো। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে নিজেকে মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর, আমি একজন হিন্দু।
বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠা আর দশটা শিশুর মতোই ছিল আমার ধর্মের সাথে পরিচিতির পাঠ। বাড়িতে ছিল একটি ছোট্ট প্রার্থণালয় আর উঠোনে একটি মন্দির। বছরজুরে বিভিন্ন পূজাপার্বণ উপলক্ষে অসংখ্য দেবদেবীর পরিচিতি জেনেছি।
জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারেই পূজা হয়ে ওঠে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। আমরা গীতা পড়তাম। সবাই একসাথে সুর করে আড়তি দিয়ে বা গান গেয়ে প্রার্থণা করতাম। বিশাল এক যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠায় আমার ধর্ম শিক্ষা ছিল সম্পূর্ণ সামাজিক। প্রতিদিনই আমরা ছোটরা কারো না কারো কাছ থেকে নতুন কিছু শিখতাম। যেমন বড়দের কেউ হয়তো বলতেন ভগবান শিবের কাহিনী, কেউবা মনসা দেবীর সম্পর্কে সতর্ক করতেন। আর কেউ হয়তো দুর্গাপূজার পেছনের পৌরাণিক কাহিনী শোনাতেন।
কিন্তু, ছোটবেলা থেকেই আর একটি ব্যাপারে শিক্ষা হয় আমার, ধর্মবিশ্বাস নিয়ে নীরব থাকার শিক্ষা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে ভয়াল অভিজ্ঞতার শিকার হন, সেই স্মৃতির উত্তরাধিকার আমরা বয়ে বেড়াতাম। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আমাদের পূর্বপুরুষরা নিজ পায়ে দাঁড়াতে অনেক কষ্ট করেছেন। স্বাধীন এই দেশে হিন্দু হয়ে বাঁচা সময়ে সময়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়তো। তাই আমরাও আপোষ করা শিখেছি। কেউ আমাদের ধর্ম বা পূজা উদযাপনের আচার-রীতি নিয়ে ব্যঙ্গ বা কটূক্তি করলে বিনা-প্রতিবাদে চুপ থাকা শিখেছি।
আমাদের বড়রা শিখিয়েছিলেন, আমাদের কোন কাজ বা মন্তব্য ((সেটা ভুল হোক বা ঠিক) পুরো সম্প্রদায়কে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই আমরা নীরব থাকা শিখেছি। অনেক সময় মানুষ আমাদের মুখের ওপর মালাউন, পৌত্তলিক, কাফের বলে গালি দিয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করিনি, চুপ ছিলাম। আমরা নিজেদের মূক, বধির ও অন্ধ করে রাখার চেষ্টা করেছি, যেন কিছুই হয়নি।
নিজের বাবাকেও দেখেছি, সারাজীবন অনিশ্চয়তায় ভুগতে। হিন্দু হওয়ায় সরকারি চাকরি নিয়ে ছিল তার অনিশ্চিত দশা। সরকার ও দেশের প্রতি আনুগত্য নিয়ে সতর্ক থাকতেন প্রতিনিয়ত। কারণ, প্রচলিত বিশ্বাস হিন্দুদের জন্য আছে ভারত। কিন্তু, আমাদের বাড়ি এখানেই, এই মাটি আমাদেরও, আমাদের স্বজনেরা এখানকার, আমাদের ভাষা, বাচনভঙ্গি, খাদ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক গড়ন সবকিছুই বাংলাদেশের আর দশটা মানুষের মতোই। তারপরও, হিন্দু হিসেবে নিরাপত্তাহীনতাই ছিল আমার বাবার অতি-সতর্কতার কারণ।
বাবার সেই নিরাপত্তহীনতার বোধ উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি। ছোটবেলায় আমি মাঝেমধ্যেই ভাবতাম এসব ভয় বাড়াবাড়ি ধরনের। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে নিজ অস্তিত্বকে বুঝতে শিখেছি। অনেক সময় আমরা অনুভূতিকে, কান্নাকে চাপা দিয়েছি। তবে এবছরের পূজোয় যখন আমাদের ওপর হামলা হলো, আমাদের প্রতিমা ভাঙচুর করা হলো, যখন আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো, তখন আমি নিজের বাবার ভয়কেও বুঝতে পারলাম। সারা জীবন তিনি যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন- প্রথমবার আমি তার মূল কারণ উপলদ্ধি করলাম।
এবার যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অনুভূতি গ্রাস করলো আমাকে। যেকোনো ধর্মীয় বিবাদ বা রাজনৈতিক ফলাফলে আমাদেরকেই লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে এটাই প্রচলিত চর্চা। আমরা যদি কথা বলি, প্রতিবাদ করি, যদি প্রবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি, আমাদের চুপ করানো হয়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন...???
আমার মনে হয় না- সরকার, প্রশাসন বা পুলিশ আমাদের নিরাপদ বোধ করতে সাহায্য করতে পারে। এ ধরনের ধর্মীয় উন্মাদনাকে একমাত্র সমাজ নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমাদের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে অন্য ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল সহমর্মিতা দেখাতে হবে। এরমধ্যেই আপনাদের অনেকেই ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে সে সহানুভূতি ও সমর্থন জানাতে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু, যখন আমাদের ওপর হামলা হয়েছিল বা পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছিল- তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?
আমি জানি, কিছু প্রশ্নের উত্তর সহজে দেওয়া যায় না। আমার কিছু মুসলমান বন্ধুদের জানি যারা সবসময় আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। প্রিয় বন্ধুরা, সমবেদনা ও সমর্থনই আমাদের একমাত্র কাম্য নয়। আমরা চাই ভার্চুয়ালি হোক বা বাস্তব জগতে, আপনার সংখ্যালঘু বন্ধুটিকে যখন হয়রানি করা হবে বা পিটিয়ে মেরে ফেলতে কেউ উদ্ধত হবে, তখন যেন আপনারা শিরদাঁড়া সোজা করে অবস্থান নেন। রুখে দিতে এগিয়ে আসেন।