ধর্মীয় বিষয়ে মানুষ কেন দ্রুতই ক্ষেপে যায়?
'আইজ পর্যন্ত এরকম ঘটনা নড়াইলে ঘটিনি। এই প্রথম। তো আপনারা যারা দিঘলিয়ার আশপাশের মানুষ আছেন, আপনাদের লজ্জা লাগা উচিত। নড়াইলে এই ধরনের গ্যাঞ্জাম আপনাদের এখান থেকে শুরু হইছে। আপনাদের লজ্জা লাগা উচিত। একবার ভেবে দেখেন আপনার পরিবারের কেউরে যদি এরমভাবে আঘাত করা হয়, আপনার কেমন লাগবে! যাই হোক, আপনাদের পায়ে দুইটা ধরছি এই ধরনের ঘটনা আর ঘটান না।'
আঞ্চলিক টোনে ক্যাপ্টেন মাশরাফির এই বক্তব্যটি হয়তো এরইমধ্যে আপনিও শুনেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া সাহাপাড়ায় গিয়ে নিজের এই রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ঝাড়েন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মোর্তজা।
কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো যে একজন এমপিকে তার ভোটারদের কাছে বলতে হলো যে আপনাদের পায়ে ধরি?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, আকাশ সাহা নামের এক যুবকের কথিত ফেসবুক স্ট্যাটাসে ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানার অভিযোগ এনে সংঘবদ্ধ কিছু লোক গত ১৫ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় দিঘলিয়া সাহাপাড়া এলাকায় হিন্দুদের বাড়ি–ঘর, দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এর কিছুদিন আগে এই নড়াইলেই মহানবীকে (স.) নিয়ে মন্তব্যের জন্য সমালোচিত ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে এক কলেজ ছাত্রের পোস্টকে কেন্দ্র করে কলেজটির অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়।
শিল্পী এস. এম সুলতানের স্মৃতিবিজড়িত চিত্রা নদীবিধৌত নড়াইলে কেন এরকম সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে? কারা এ ধরনের ঘটনা ঘটায়? একটি এলাকায় যদি দশ হাজার মানুষ বসবাস করেন, তার মধ্যে বড়জোর একশো বা দুইশো লোক এসব হামলা ও ভাংচুরের সঙ্গে জড়িত থাকে। অর্থাৎ এলাকার অধিকাংশ মানুষই এসব হামলায় জড়িত থাকে না। কিন্তু তারা কি এসব ঘটনায় বাধা দেয়, না কি তাদেরও মৌন সম্মতি থাকে?
ফেসবুকে কে কী লিখলেন, সেটা সবার দেখা কথা নয়। কিন্তু তার ওই স্ট্যাটাস বা মন্তব্য এমন কারো নজরে আসে যার সঙ্গে পোস্ট বা কমেন্টকারীর কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলা রয়েছে। অনেক সময় এখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিরোধও কাজ করে। ফলে তিনি ওই পোস্ট বা কমেন্ট নিয়ে প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং এরপরে কমিউনিটির লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। আবার অনেক সময় কোনো ধরনের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক বিরোধ না থাকলেও ধর্মীয় ইস্যুতে কোনো পোস্ট বা কমেন্ট কারো দৃষ্টিতে আপত্তিকর বা অবমাননাকর মনে হলেও তিনি অন্যদেরকে উসকানি দেয়ার চেষ্টা করেন। এভাবে ওই পোস্ট বা কমেন্টকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছোট ছোট ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাঁধতে বাঁধতে মানববন্ধন, মিছিল এবং সর্বোপরি আক্রমণের ঘটনা ঘটে।
যারা বারবার এরকম কথিত ধর্ম অবমাননা অভিযোগে স্থানীয় মানুষজনকে ক্ষেপিয়ে তোলে বা উসকানি দেয়, তারা কারা? তারা তো এই সমাজেরই লোক। আবার কেউ উসকানি দিলেই লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নেমে যেতে হবে কেন? যাদের উসকানিতে তারা রাস্তায় নামলো তারা কি উসকানিদাতাদের রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েছে নাকি তারা নিতান্তই ধর্মের মান রক্ষায় তথা পারলৌকিক কল্যাণ লাভের আশায় তার প্রতিবেশির বাড়িতে হামলা চালালো?
আপনি কার বাড়িতে হামলা করলেন? সে তো আপনার প্রতিবেশি। আপনি মধ্যরাতে অসুস্থ হলে ওই প্রতিবেশিই তো সবার আগে ছুটে আসে। কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ কিংবা গুজবে আপনি সেই প্রতিবেশির বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলেন, তাতে আপনার বুক কাঁপলো না? রাতে যার বাড়িতে আগুন দিলেন, ভোরে তো তার সঙ্গেই রাস্তায় কিংবা বাজারে আপনার দেখা হবে। আপনি তার মুখের দিকে তাকাবেন কী করে? মানুষের সাথে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের চেয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ কিংবা গুজব বড় হয়ে গেলো আপনার কাছে?
কোন ধর্মীয় গ্রন্থের কোন পৃষ্ঠায় এটা লেখা আছে যে, ধর্ম অবমাননার গুজব শুনলে তুমি তার বাড়িতে গিয়ে আগুন দাও? কোন ধর্ম এটা বলে যে, তুমি তোমার প্রতিবেশির বাড়িতে ভাংচুর করো? ইসলামের নবী (স.) কবে কোন প্রতিবেশির বাড়িতে আগুন দিয়েছেন? বরং তাঁকে যারা কষ্ট দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গেও তো মানবিক আচরণ করেছেন। ভালোবাসা দেখিয়েছেন। তো কোন ইসলাম আপনারা আমদানি করলেন?
যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাদের একটা বড় অংশই যে এটার ব্যবহার জানেন না এবং জেনে বুঝেই এটার অপব্যবহার করেন, তা নিয়মিত বিরতিতে নানা ঘটনায় প্রমাণিত হয়। চোখ খোলা রাখলে দেখা যাবে, এদের মধ্যে কথিত শিক্ষিত লোকজনও রয়েছেন। অর্থাৎ কালচারড বা সংস্কৃতিবান হওয়ার জন্য শিক্ষাই যে একমাত্র শর্ত নয়, তা ফেসবুকে অনেক শিক্ষিত লোকের স্ট্যাটাস, মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট হয়। কিন্তু আখেরে এর ভিকটিম হয় সাধারণ মানুষ। যার বড় উদাহরণ ভোলার বোরহানউদ্দিন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ তাণ্ডব হয়।
তখনও বলা হয়েছিল যে একজন হিন্দু নাগরিকের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে মহানবী (স.) সম্পর্কে অবমাননাকর কথা লেখা হয়েছে। যদি আসলেই এটা হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এই হ্যাককারীও একজন অতি উৎসাহী এবং তার এই অতি উৎসাহের পেছনে অবশ্যই কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। কারণ প্রযুক্তি জ্ঞানে পারদর্শী লোক ছাড়া একজন সাধারণ মানুষ অন্যের ফেসবুক আইডি হ্যাক করতে পারেন না। তার মানে যিনি আইডি হ্যাক করেছেন তিনি প্রযুক্তি জ্ঞানে পারদর্শী এবং বড় কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এটা করেছেন। তার উদ্দেশ্য যদি থাকে এই যে, তিনি মহানবীর (স.) অবমাননার মতো একটি অতি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে উত্তেজনা তৈরি করে একটি সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করবেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এর পেছনে বড় কোনো শক্তি আছে।
প্রযুক্তি জ্ঞানে পারদর্শী কিন্তু বড় কোনো উদ্দেশ্য নেই—এমন কেউও হয়তো ব্যক্তিগত শত্রুতার বশে ফেসবুক আইডি হ্যাক করে সামাজিকভাবে তাকে হেয় করতে পারেন। ফলে প্রতিটি ঘটনাই নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধান করা জরুরি যে, কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কার পোস্ট বা মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সমাজে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিলেন বা উসকানি দিলেন।
ধরা যাক কেউ একজন মহানবীকে (স.) নিয়ে ফেসবুকে কিছু একটা লিখলেন। এটা হতে পারে তার জ্ঞানের অভাব অথবা দৃষ্টিভঙ্গি। এ কারণে তার বা তার পরিবার কিংবা তার সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা করতে হবে, আগুন দিতে হবে, এ কথা ইসলামের কোথায় আছে? মহানবীর (স.) জীবিতকালে তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলার লোকের অভাব ছিল না। তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছেন, এমন লোকও ছিলেন। মহানবী (স.) চাইলে এদের সবাইকে চূড়ান্ত শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান ছাড়া তিনি কখনো অস্ত্র ধরেছেন, কারো গায়ে সামান্য একটা আঁচড় দিয়েছেন, এরকম উদাহরণ নেই। তাহলে তাঁর অনুসারী ইসলাম ধর্মের মানুষ কেন এত অসহনশীল হবে? কেন সে ধর্ম অবমাননার গুজবে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করবে?
কেউ যদি ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে কোনো খারাপ কথা লেখে, তার জবাব ফেসবুকেই দেয়া যায়। তাকে যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায়। কিন্তু তারপরেও যদি কেউ বিষয়টা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তার জন্য আইনি প্রতিকার আছে। এসবে না গিয়ে হাজার হাজার লোককে রাস্তায় নামিয়ে ইসলাম ও মহানবীর ভাবমূর্তি রক্ষায় যে কথিত জিহাদের ডাক দেয়া হয়, তাদের উদ্দেশ্য যে ভিন্ন, তা বুঝতে গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই।
বস্তুত মানুষের জীবনে যত বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, সে তত বেশি ধর্মের প্রতি মনোনিবেশ করে। এমন অনেক আছে, জীবনের অনিশ্চয়তাজনিত ভীতি থেকে, ধর্মে সে পরমেশ্বরের আশ্রয় খোঁজে। ফলে যখনই সে নিজ ধর্মের বিষয়ে কোনো খারাপ মন্তব্য শোনে, সে এটার প্রতিবাদ করে একধরনের দায়িত্ব মনে করে। অন্যদিকে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে মানুষের অনুভূতির তীব্রতা ও সংবেদনশীলতা অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও স্বচ্ছল দেশগুলোর মানুষের মধ্যে কম। কারণ তাদের জীবনে অনিশ্চয়তা কম। জীবন নিয়ে তাদের শঙ্কা ও উদ্বেগ কম।
তবে ধর্ম বিষয়ে যেহেতু সাধারণ মানুষ এবং রাষ্ট্রে নীতিনির্ধারকরাও বেশ সতর্ক থাকেন; অসৎ ও দুর্নীতিবাজ লোকও যেহেতু নিজের ধর্ম বা ধর্মের অবতারের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়—ফলে যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাদেরও ধর্মীয় ইস্যুতে কিছু লেখার বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। মনে যা এলো লিখে দিলাম; কাউকে চোর বা রাজাকার বলে গালি দিলাম—এটাও কোনো সভ্য লোকের আচরণ হতে পরে না। অর্থাৎ সমস্যাটা এখানে সোশ্যাল মিডিয়া বা ফেসবুকের না। সমস্যাটা ব্যক্তির কালচার ও মূল্যবোধের।
কিছু লোক সমাজে সব সময়ই থাকবে যারা অন্যকে হেয় করে মজা পাবে। কিছু লোক সমাজে থাকবেই যারা সব সময়ই কোনো একটি ঘটনা থেকে ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ফায়দা সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। তাদের সবাইকে চিহ্নিত করাও সহজ নয়। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। তাই বলে কেউ কিছু একটা লিখলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, বড় ধরনের সহিংসতা উসকে দিতে হবে, এটিও কোনো কাজের কথা নয়। ধর্মের কোনো বিষয় নিয়ে যদি সত্যিই বাহাস করতে হয়, সেটি অন্য প্লাটফর্মে করা যেতে পারে। যদিও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বাহাসের পরিবেশ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় ইস্যুতে যেসব ঘটনা ঘটে, অনেক সময় সেখানে রাজনীতি তথা ভোটের হিসাব-নিকাশও দায়ী। অর্থাৎ ধর্মীয় ইস্যু না থাকলে বা সংখ্যালঘুদের (সংখ্যালঘু শব্দটাই অবমাননাকর) ওপর অত্যাচার নির্যাতন না হলে রাজনীতিবিদরা ভোটের রাজনীতি করবেন কাদের নিয়ে? অমুক দলের আমলে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়; তমুক ধর্মের লোকেরা শুধু অমুক দলকে ভোট দেয়; অমুক দল ক্ষমতায় গেলে হিন্দুরা দেশে থাকতে পারবে না; তমুক দলের আমলেই সংখ্যালঘুরা নিরাপদ ইত্যাদি কথাবার্তা বলার জন্যও মাঝেমধ্যে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাংচুর করতে হয়। না হলে তো রাজনীতিই থাকে না।
- লেখক নেক্সাস টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর