‘নিন্দুকের যেন আচ্ছা করিয়া কান মলিয়া দেওয়া হয়’
এক ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। গান গাইতো কিন্তু শাস্ত্র পড়তোনা। লাফাতো, উড়তো কিন্তু কায়দাকানুন জানতোনা। রাজা বললেন 'এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খেয়ে রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটাচ্ছে।'
মন্ত্রীকে ডেকে পাখিটিকে শিক্ষা দিতে বললেন। শিক্ষা দেয়ার ভার পড়লো রাজার ভাগিনার উপরে। পাখিটির শিক্ষার জন্য সোনার খাঁচা বানানো হলো। পন্ডিত পাখিকে বিদ্যা শেখায়। পুঁথি লেখকদের পুঁথির নকল করে করে পাহাড় সমান উঁচু করে তুললো। যে দেখে, সেই বলে, 'সাবাস। বিদ্যা আর ধরে না।' মেরামত তো লেগেই আছে। তারপরেও ঝাড়া, মোছা পালিশ-করা ঘটা দেখে সকলেই বলল, 'উন্নতি হইতেছে।' সংসারে নিন্দুক আছে যথেষ্ট। তারা বলল, 'খাঁচাটার উন্নতি হইতেছে, কিন্তু পাখিটার খবর কেহ রাখে না।'
কথাটা রাজার কানে গেল। তিনি ভাগিনাকে ডেকে বললেন, এ কী কথা শুনি। ভাগিনা বলল মহারাজ, সত্য কথা শোনার জন্য স্যাকরাদের, পন্ডিতদের, লিপিকরদের, মেরামতকারীদের, মেরামত তদারককারীদের ডাকতে হবে। নিন্দুকগুলো খেতে পায়না বলে মন্দ কথা বলে। শিক্ষা যে কী ভয়ংকর তেজে চলছে সবাইকে নিয়ে রাজা দেখতে এলেন। কিন্তু তোষামদী শুনেই চলে যাচ্ছিলেন। এসময় এক নিন্দুক বলে উঠলেন 'মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি।' রাজা চমকে উঠলেন, আরে তাইতো পাখিটিকেতো দেখা হলোনা।
পাখি দেখে রাজা বেজায় খুশি। আয়োজনের ত্রুটি নাই। খাঁচায় দানা পানি নাই, শুধু রাশি রাশি পুঁথি থেকে পাতা ছিঁড়ে কলমের ডগা দিয়ে পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হচ্ছে। গান তো বন্ধই, চিৎকার করার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা। দেখলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়। এবারে রাজা কানমলা-সর্দারকে বললেন নিন্দুকের যেন আচ্ছা করে কান মলা দেয়া হয়।
পাখিটা দিনে দিনে ভদ্র হয়ে আধমরা হয়ে গেল। তবু স্বভাবদোষে সকালবেলার আলোর দিকে পাখি চায়, আর পাখা ঝাপটায়। এমনকি, একদিন দেখা গেল, সে তার রোগা ঠোঁট দিয়ে খাঁচার শলা কাটার চেষ্টা করছে।
তখন শিক্ষামহালে কামার এসে লোহার শিকল বানালো আর পাখির ডানাও গেল কাটা। এরপর পাখিটা মারা গেল। নিন্দুক রটালো 'পাখি মরিয়াছে।' রাজা ভাগিনার কাছে জানতে চাইলেন, একি কথা শুনি!
ভাগিনা বললো, 'মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হয়েছে।' রাজা শুধালেন, 'ও কি আর লাফায়?' ভাগিনা বলল, 'আরে রাম!' 'আর কি ওড়ে?' 'না।' 'আর কি গান গায়?' 'না।' 'দানা না পেলে আর কি চেঁচায়?' 'না।' রাজা বললেন, 'একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।' পাখি এলো। সঙ্গে কোতোয়াাল, পাইক, ঘোড় সওয়ার এলো। রাজা পাখিটাকে টিপলেন, সে হাঁ হু করলো না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্ করতে লাগলো।
বাইরে নববসন্তের দক্ষিণ হাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করে দিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কতশত বছর আগে লিখে গেছেন 'তোতাকাহিনী'। কিন্তু সেই অবস্থার কি কোন উন্নতি হয়েছে আমাদের সমাজে? না হয়নি। শিক্ষা, সমাজ ব্যবস্থা, ব্যবস্থা নেয়ার ধরণ, তোষামদী, শঠতা, রাজার কাছে ভুল তথ্য দেয়ার কাজ চলছেই। একটা সময় ছিল, যখন সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিলনা। ছিলনা কম্পিউটার, ইমেইল, গুগল, ফোন, ফ্যাক্স, মোবাইল। সেইসময়গুলোতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিলনা বলে কি কোন আন্দোলন, অসহযোগ ও বিপ্লব আটকে ছিল?
পাকভারত উপমহাদেশে এবং পরে এই বাংলাদেশে যতো জোরালো আন্দোলন হয়েছে সবইতো রাস্তাতেই হয়েছে। সেইসব আন্দোলন শুরু করেছে ছাত্রছাত্রীরা, নেতৃত্ব দিয়েছে তারাই, নেতার পিছনে পতাকা নিয়ে এগিয়ে গেছে সেই তারা। সে সময়টাই ছিল ছাত্রদের শক্তি ও সাহস দেখানোর সময়।
সেই তরুণ-তরুণীদের উপর ভিত্তি করেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে, হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। সেসময়ে তারুণ্যের মধ্যে ছিল ক্ষোভ, জ্বলে ওঠার শক্তি, জাতীয়তাবাদের অহংকার, স্বদেশপ্রেম, এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ। ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর অসহযোগ আন্দোলন এবং সবশেষে এসে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন সবই ছাত্র আন্দোলনের ফসল।
দেশের ভালমন্দ নিয়ে ছাত্ররাই সবচেয়ে আগে কথা বলে। ছাত্রছাত্রীরাই সবসময় অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত, অনাচার, অত্যাচার ও মন্দ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হয়। যদিও বেশ কয়েকবছর ধরে সেইসব সংগ্রামের পথ ও ধরণ অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখন এমন কতগুলো ইস্যু যেমন রাজনৈতিকায়ন, ব্যবসায়ীদের প্রভাব, দুর্নীতি, নির্যাতন, বৈষম্য এসে যোগ হয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর চরিত্র ও ধরণ পাল্টে দিয়েছে।
ছাত্ররাই দেশে দেশে সবচেয়ে আগে মানুষের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে শাসক ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর কাছে অপছন্দের হয়েছে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে একথাও ঠিক যে, সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশে ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র আন্দোলন তাদের জৌলুস হারিয়েছে। ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করায় তাদের অনেক দুর্নামও কুড়াতে হয়েছে। দেশে সব কালে ছাত্র রাজনীতি এক রকম ভূমিকা রাখেনি। কোনও দেশেই ছাত্রস্বার্থ ইস্যুতে ছাত্ররাজনীতি আবদ্ধ থাকে না সবসময়। সমাজ বদলের জন্য ছাত্র সমাজ-ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসের বাইরেও। বাংলাদেশের ইতিহাস একথাই বলে। অথচ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের মতামত প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। ছাত্রদেরকে সেই তোতাপাখি বানানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
সময় এগিয়েছে, প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রী, চাকুরিজীবি, পেশাজীবি সবার হাতেই প্রযুক্তি। এখন রাস্তার একটিভিজমের জায়গা নিয়েছে অনলাইন একটিভিজম। তাই সরকার এবং অন্যান্য অনেকেই চাইছে সামাজিক মাধ্যমে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের উপর নিয়ন্ত্রণ টানতে। সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনো পোস্ট, ছবি,অডিও বা ভিডিও আপলোড করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এমনকি এ রকম পোস্টে কমেন্ট, লাইক বা শেয়ারও করা যাবে না। এই যে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো পেশাকে হেয় করে পোস্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়, কিন্তু কোথাও উল্লেখ করা হয়নি নারীর প্রতি অবমাননাকর কোন উক্তিও করা যাবেনা। যদি কেউ করে তাকে সরাসরির শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে।
প্রথমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির একটা সংজ্ঞা দাঁড় করানো উচিৎ। নতুবা ছাত্রছাত্রীরা কিভাবে বুঝবে যে কোন মন্তব্য করে তারা নিয়ম ভঙ্গ করেছে। আর ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় থাকতে পারে, যে বিষয়ে তারা সামাজিক মাধ্যমে মতামত প্রকাশের অধিকার রাখে। যেমন সরকার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সবাইতো এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত নাও হতে পারেন। সবারই অধিকার আছে, এপ্রসঙ্গে কথা বলার। সরকার অটো প্রমোশনের সিদ্ধান্ত নিলেও ছাত্রছাত্রীরা মতামত প্রকাশ করতে পারে।
সেক্ষেত্রে একদম স্পষ্টভাবে বলে দিতে হবে সরকারি সিদ্ধান্ত, পুলিশের বা সামরিক বাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করে বা গালিগালাজ করে কোন কথা বলা যাবেনা। এই অবমাননার বিষয়টি এমন হবে যে কোন মানুষ যদি ইচ্ছা করে অন্য কোন মানুষ বা তার কাজকে অবমাননা করে, নোংরা কথা বলে বা মিথ্যে তথ্য দেয়, বা সরকারের কার্যক্রমের সমালোচনা করতে গিয়ে গালিগালাজ করে, তাহলে সেটাই হবে অবমাননা। আর এই অবমাননা যেমন শুধু সরকার বা মর্যাদাবানদেরই হবে, তা নয়। সবার হতে পারে। আর শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয় সবাই অবমাননা করতে পারে।
ফেইসবুকে বা পত্রিকার স্পর্শকাতর কোন খবরের বা নিবন্ধের নীচে যে সব মন্তব্য করা হয়, সেটা যদি কর্তৃপক্ষীয় লেভেল থেকে কেউ লক্ষ্য করে থাকেন, তাহলে বুঝবেন দেশের মানুষের চিন্তা চেতনা কোন অশ্লীল পর্যায়ে চলে গেছে। মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী, ড. আনিসুজ্জামান থেকে শুরু করে শমী কায়সারের বিয়ে নিয়ে যে অশ্লীল, অশ্রাব্য গালাগালি করা হয়েছে, সেটা কি অপরাধ নয়? শমী কায়সারের বিয়েকে কেন্দ্র করে রিপোর্টের নীচে মন্তব্যে তার বাবা শহীদুল্লাহ কায়সার, মা পান্না কায়সারকেও ছাড়া হয়নি। মন্তব্যগুলো পড়ার পর মনে হয়েছে এই মন্তব্যকারীরা সবাই ভেতরে ভেতরে একজন ধর্ষক। ব্লগে বা ফেইসবুকে নিজেদের প্রগতিশীল চিন্তার কথা প্রকাশ করে, নিহত হয়েছে কতজন। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তৃতা আওয়ামীলীগের পেইজ থেকে লাইভ হচ্ছিল, সেখানেও দেখেছি লোকজন কিছু বাজে মন্তব্য করছে।
'রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি' বা 'জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি'র সংজ্ঞা উল্লেখ না করেই ঘোষণায় সোশ্যাল মিডিয়ায় বর্জনীয় সম্পর্কে আরও বলা হয়, জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে এমন কোনো পোস্ট দেওয়া চলবে না। অথচ দেশের বিভিন্ন কোণা থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার মতো সামাজিক মাধ্যমে বহু প্রচারণা আমরা দেখেছি।
সরকার মোটামুটি ধমক বা হুকুম দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মুখ বন্ধ করতে চাইছে। অথচ দেশের সংবিধান অনুযায়ী মানুষ স্বাধীনভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে এই স্বাধীনতা মানে অনিয়ন্ত্রিত মতামত প্রকাশ নয়। রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় এমন কোনো পোস্ট যদি কেউ দেন, এটা খুব বড় অপরাধ। সেজন্য তাকে আইনের আওতায় আনা যেতেই পারে। জনগণের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট যেকোন বিষয় নিয়ে শুধু ছাত্রছাত্রী কেন, সব মানুষের মত প্রকাশের অধিকার আছে, তা যেকোন মাধ্যমেই হোকনা কেন? তাছাড়া যারা আইসিটির অপব্যবহার করছে তারা সবাই তো আর শিক্ষার্থী নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বারবার এইচএসসি পরীক্ষার তারিখ সম্পর্কে ভুয়া তথ্য দেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেইজ নকল করে এসব করা হয়েছে, সেটাও তো আইসিটির অপব্যবহার ছিল। অথচ তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি কেন?
সরকার ছাত্রছাত্রীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে কেন? শুধু ছাত্রদের মতামত প্রকাশের অধিকার রুদ্ধ করে কী হবে? উচিৎ হবে সেইসব প্রতিক্রিয়াশীলদের ঠেকানো, যারা সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করার ও বক্তব্য দেয়ার নামে নিজের ভেতরে থাকা ঘৃণা ও বিষ ছড়াচ্ছে। মানুষের প্রতি বিশেষ করে নারীর প্রতি অবমাননামূলক ও উস্কানিমূলক বক্তৃতা, বিবৃতি ও মন্তব্য ঠেকাতে না পারলে, এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের দেশে হিংসা, দ্বেষ ও জঙ্গিবাদ ছড়ানোর একমাত্র হাতিয়ারে পরিণত হবে। যারা নীতিনির্ধারকদের অবস্থানে থেকে শুধু ছাত্রদের তোতাপাখি বানিয়ে পুঁথি গেলাতে চাইছেন, তারা ভুল করছেন।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন