‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী গ্র্যাজুয়েটদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে হবে’
৫ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে 'শিক্ষক দিবস'। বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে দিনটি। জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরিবার থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে আমরা বহুকিছু শিখি। শৈশবে আমরা যেদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরজায় পা দেই, সেদিন থেকেই শুরু হয় আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার। সে বিদ্যায় আমরা পাশে পাই পাই বহু মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে যারা আমাদের হৃদয়ে জ্বেলে দেন শিক্ষার আলো, যাদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে আমরা মোহিত হই, যাদের জীবনযাপনে হই মুগ্ধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, যিনি তাঁর সুদীর্ঘ ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবন শেষে অবসরের দ্বারপ্রান্তে। শিক্ষক দিবসে তিনি বললেন তার জীবনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব রাখা শিক্ষকদের কথা, জানালেন পেশা হিসবে শিক্ষকতা কেনো আকর্ষণ হারাচ্ছে তার কারণ।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনলাইন সাংবাদিক তারেক হাসান নির্ঝর।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড: দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। দেশের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর পাশাপাশি শত শত শিক্ষকেরও শিক্ষক আপনি। পেশা হিসেবে শিক্ষকতা কেমন লেগেছে আপনার কাছে? কোন বিষয়টি আপনাকে এই পেশায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছে?
অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকঃ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি ১৯৮০ সালে, শিক্ষকতা থেকে অবসরকালীন ছুটিতে (এলপিআর) গেলাম এ বছর। আমি অবসর নেব ২০২০ সালে। সেই হিসেবে আমার এই শিক্ষকতা জীবন ৪০ বছরের একটি লম্বা ইনিংস।
৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে আমার মনে হয়েছে, এর চেয়ে ভালো পেশা আমার দৃষ্টিতে আর হতে পারে না। এর মাঝে প্রতিদিনই আমরা নতুন করে শিখি, আমাদের শক্তি, আমাদের লক্ষ্য, আমাদের ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন করে থাকি। আমার জীবনে আমি শৈশব থেকে যৌবনে গিয়েছি, যৌবন থেকে থেকে বার্ধক্যে এসেছি। কিন্তু যে সময়টা আমি শিক্ষকতা করলাম সেই পুরোটা সময়ই আমি কাটিয়েছি তরুণদের সাথে।
প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছেলে-মেয়েরা ভর্তি হয়েছে। আমি তাদের ক্লাস নিয়েছি। আমার কখনো মনেই হয়নি, আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো, তরুণদের সাথে সারাক্ষণ কথা বলা, চলাফেরা, সময় কাটানো। পরবর্তীতে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্বে (উপাচার্য) এলাম তখন তরুণদের সঙ্গে আরও বড় পরিসরে মেশার সুযোগ পেয়েছি। তরুণদের প্রাধান্য থাকে যে পরিবেশে সেখানে থাকার কারণে মনে হয়েছে, আমার বয়স হয়তো স্থবির হয়ে আছে। এই তারুণ্যের শক্তিই আমাকে উৎসাহিত করেছে, উদ্দীপিত রেখেছে, আশাবাদী করেছে।
আমি মনে করি, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় যে পর্যায়েই হোক না কেন, শিক্ষক যারা আছেন, তারা সবাই তরুণদের সাথে বা শিশুদের সাথে মিশতে ভালোবাসেন। ফলে তাদের মনেও শিশুদের মতো সরলতা কাজ করে, তারা তরুণদের মতো উজ্জীবিত থাকেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, আর কোনো পেশায় এই সুযোগটা থাকে না।
আরেকটা দিক হল, আমি কখনও মনে করিনি শিক্ষার্থীদের আমি কেবল ক্লাসেই শেখাব। ক্লাসরুমের বাইরেও আমি তাদের শেখাতাম। আমি যখন উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলাম তখন অনেক শিক্ষার্থীই রাত দুইটা-আড়াইটায় আমার বাসায় এসেছে, আমি তাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের কথা শুনেছি। ব্যক্তিগত জীবনে হতাশা, নানা ব্যর্থতায় পড়ে বা লেখাপড়ার বাইরেও কোন সমস্যায় পড়ে কেউ এলে, তাদের সাথে কথা বলে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছি, আশা যারা ছেড়ে দিয়েছিলো তাদের আশাবাদী হতে শিখিয়েছি, এটা আমার কাছে শিক্ষকতা পেশার একটি দারুণ জায়গা মনে হয়েছে।
তরুণদের থেকে আমি যেমন নিয়েছি, তেমনি তরুণদের আমি দিয়েছি। এই দুটো জায়গায় আমি মনে করি, শিক্ষকদের অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু সেটা হতে হবে শিক্ষকসুলভ মনোভাবের মাধ্যমে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড: বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের মধ্যে অন্যতম সম্মানজনক পদটি হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ। সে পদটিতে আপনি দায়িত্ব পালন করেছেন আট বছর। তবে এ জায়গায় আসতে আপনাকেও পেরিয়ে আসতে হয়েছে দীর্ঘ এক শিক্ষাজীবন। সেখানে আপনিও এসেছিলেন বহু শিক্ষকের সংস্পর্শে। আপনার ছাত্রজীবনের কোন শিক্ষকের কথা এখনও মনে পড়ে? কোন শিক্ষকের আচরণ এখনও আপনাকে প্রভাবিত করে?
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: সব ছাত্রছাত্রীদের কাছেই তাদের শিক্ষকরা প্রিয়। এর মধ্যে কিছু কিছু শিক্ষক থাকেন যাদের তারা আদর্শ হিসেবে ধরে নেন। আমার বাবা সরকারি চাকুরীতে ছিলেন বলে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় লেখাপড়া করেছি। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকায় হলেও সারা দেশে এভাবে ঘুরে বেড়ানোর ফলে আমার মধ্যে একটা কসমোপলিটন মনোভাব গড়ে ওঠেছিল। বিভিন্ন জায়গার মানুষের সাথে মেলামেশার ফলে আঞ্চলিক এই সংকীর্ণতা আমার মধ্যে কাজ করেনি কখনও। আমার কাছে মনে হয়েছে সারাদেশই আমার দেশ।
আমার জীবনে প্রাথমিক শিক্ষকদের যে অবদান, সেটা আমি কখনওই ভুলতে পারব না। আমি সিরাজগঞ্জের ভিক্টোরিয়া স্কুলে লেখাপড়া করেছি। সেখানে দেবেন্দ্রনাথ সাহা আমার শিক্ষক ছিলেন। সুদীর্ঘ গড়নের অত্যন্ত সুদর্শন একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কীভাবে কথা বলতেন, কীভাবে আচরণ করতেন সেগুলো আমাদের আকৃষ্ট করত।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলাম তখন একদিন হঠাৎ তিনি আমার অফিসে উপস্থিত হলেন। তিনি আমাকে তাঁর কিছু সমস্যার কথা বলেছিলেন। তাঁর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। স্যার অবসরে যাওয়ার পর অবসর ভাতা নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। অবসর ভাতা দেওয়ার প্রক্রিয়ার সাথে সেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত ছিলেন তাদের কেউ কেউ স্যারের কাছে উৎকোচ দাবি করেছিলেন। তবে স্যার সেটা দিতে রাজি হননি। উৎকোচ না দেওয়ার ফলে যখন তিনি তার ভাতা পাননি, তখন তিনি আইনের আশ্রয়ে গিয়ে মামলা করেছিলেন। যে টাকা তিনি অবসর ভাতা পাবেন, তার চেয়ে বেশি টাকা তিনি ওই মামলার পেছনেই খরচ করে ফেললেন। মামলায় উনার পক্ষে রায় গেলেও সরকারের ওই পক্ষটি বলেছিল তারা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে।
প্রাথমিক শিক্ষকের এই অবসর ভাতা সামান্য কিছু টাকা। আজকের দিনে ওই টাকা এমন বড় কিছুও নয়। স্যার এতটাই আদর্শবান মানুষ যে এরপরও উনি ওদের সাথে কম্প্রোমাইজ করেননি। পরে যখন দেখলেন, মামলা চালিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তাঁর নেই, তখন তিনি আমার সাথে দেখা করেন, বললেন এই সমস্যার কথা। তারপর এই বিষয়টির সমাধান পেলেন তিনি।
আমি শুধু দেখলাম, একজন শিক্ষক, তার কী-ই-বা বেতন ভাতা, কী-ই-বা সুযোগ-সুবিধা। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই যে আদর্শটা উনি ধরে রেখেছেন, এটা আমাকে অবাক করেছে। তিনি আমাকে প্রাথমিক পর্যায়ে যে শিক্ষা দিয়েছেন, আমার পরিণত এই বয়সে এসেও একই শিক্ষা দিয়েছেন। এই ধরনের মানুষ বা এই ধরনের সততা আজকের দিনে বিরল।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমি পেলাম অধ্যাপক কিউ এ আই এম নূরউদ্দীনকে। নূরউদ্দীন স্যার ছিলেন আমাদের প্রত্যেকের সত্যিকার অর্থে অভিভাবক। শিক্ষার্থীদের যত ধরনের সমস্যা ছিল, সবকিছুই উনি উপলব্ধি করতেন। শিক্ষার্থীদের সাথে তিনি এমনভাবে মেলামেশা করতেন যে আমরা সবাই মনে করতাম, আমরা সবাই বুঝি স্যারের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। কারণ একটাই, তিনি সবার সাথে সমানভাবে আচরণ করতেন।
উনি মাথা থেকে পা পর্যন্ত একজন জাত শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কখন অফিস খুলছে, কখন বন্ধ হচ্ছে এটা তাঁর কাছে কখনো কোন বিবেচ্য বিষয় ছিলো না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি বিভাগে থাকতেন। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন দূর থেকে দেখেছি, এরপর যখন উনার সহকর্মী হলাম তখন আরও কাছে থেকে দেখতাম। দেখতাম যে অফিসে কোনো শিক্ষক নাই, সেই সময়ও উনি বসে বসে কাজ করছেন। আমাদেরকেও ডেকে এনে বলতেন, এটা করো, ওইটা করো। অর্থাৎ তিনি আমাদের শেখাতেন নিয়মিত। ছাত্রদের সাথে কিভাবে মিশতে হয়, শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীদের পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে গিয়ে কিভাবে পড়াতে হয়, তিনি আমাদের সেসব শেখাতেন।
আজকে আমাদের যা কিছু অর্জন তার পেছনে প্রফেসর নূরউদ্দীন স্যারের একটা বিরাট অবদান আছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা শিক্ষার পথিকৃত হিসেবে তাঁর ভূমিকা সবসময় স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড: বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুটা হয় প্রাথমিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে। তবে সেখানে মেধাবী শিক্ষকের অভাব যে অনেকটাই বেশী সেটা বহুজনস্বীকৃত। প্রাথমিক পর্যায়ে যারা শিক্ষকতা করেন তারা সরকারি একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর চেয়েও কম বেতনে কাজ করেন। এই সংকটের মূল কারণ কী বলে মনে হয় আপনার? কীভাবেই-বা হতে পারে এর সমাধান?
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: যে জায়গায় আমাদের শিক্ষকের প্রতি মর্যাদার প্রচুর ঘাটতি আছে সেটা হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদেরকে আমরা এমন অবস্থায় নিয়ে গেছি যে, সরকারি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাও যে বেতন ভাতাভাতা সুযোগ-সুবিধা পান আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা সেটা পান না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন আমাদের কোষাগার শুন্য, অর্থনীতি বিধ্বস্ত সেসময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সকল প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করে দিলেন। অর্থাৎ সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকার থেকে বেতন ভাতা পাবে। কারণ বঙ্গবন্ধু জানতেন, নতুন এই প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি যদি শক্ত করতে হয় তাহলে শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। এই শিক্ষা হলো প্রাথমিক শিক্ষা। সেটি তিনি সংবিধানে যোগ করে দিলেন যে 'প্রজাতন্ত্রের সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক'।
বাধ্যতামূলক যেহেতু করেছেন সেকারণে সেটাকে তিনি অবৈতনিক করে দিলেন। শিক্ষকদের বেতন ভাতার যাতে কোন সমস্যা না হয় সেকারণে এটাকে তিনি সরকারের অধীনে নিয়ে আসলেন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলেজের শিক্ষক বা সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের যে বেতন-ভাতা, সুযোগ সুবিধা রয়েছে তার তুলনায় প্রাথমিক পর্যায়ের বহু শিক্ষক আছেন যারা একেবারে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই জায়গায় আমার মনে হয় অনেক কিছু করার আছে, একটা বড় ধরণের পরিবর্তন আনার দরকার আছে এখানে। কারণ শিশুদেরকে যারা শিক্ষা দিচ্ছেন, তারাই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি রচনা করছেন। এই শিশুদের জীবনের ভিত্তি রচনা করে দিচ্ছেন।
এই শিক্ষক কারা হবেন? এই শিক্ষকরা হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী তরুণরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ভালো ফলাফল করে বেরিয়েছেন, এমন তরুণরা প্রাথমিক শিক্ষায় আকৃষ্ট হবেন। এই মেধাবীরা যদি শিশুদের শিক্ষা দেন তবে সেই শিশুরা সঠিক শিক্ষা নিয়ে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে যাবেন। কিন্তু আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে কি তেমন শিক্ষক পাচ্ছি? প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকতায় আমরা কাদেরকে দেখতে পাচ্ছি?
যারা জীবনে কোথাও কোনো সুযোগ পাচ্ছে না তারা বাধ্য হয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় যাচ্ছেন। সেখানে গিয়েও তারা কিন্তু স্থির থাকছে না, চেষ্টা করে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য। একটা সরকারি কেরাণীর চাকরি পেলেও তারা শিক্ষকতা ছেড়ে চলে যায়।
আবার আগে একটা সামাজিক মর্যাদা ছিল। আমরা দেখেছি, আমাদের শিক্ষদের অভিভাবকরা সম্মান করতেন, সমাজের সবাই সম্মান করতেন। এখন কিন্তু পরিবারেও সেই সম্মানটা দেওয়া হচ্ছে না। একই পরিবারে যদি পাঁচজন সন্তান থাকে; একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন ব্যাংকার একজন চিকিৎসক, একজন প্রকৌশলী এবং একজন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক; দেখা যাবে যে অভিভাবকরাও বাকি চার সন্তানকে যত উৎসাহের সাথে অন্যদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, প্রাথমিকের শিক্ষক সন্তানটিকে সেভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন না। তারা বলেন, ও এখন একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে, ওটা ছেড়ে দেবে, বিসিএস এর জন্য চেষ্টা করছে। মানে পরিবার থেকেই আমরা মূল্য দিচ্ছি না। আর সরকার থেকে বেতন ভাতাও দিচ্ছি না। তাহলে এখানে মেধাবী ছেলে মেয়েরা যাবে কেন? তাদের হাতে তো আরও বহু বিকল্প চাকরি রয়েছে।
তাই আমাদের এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে প্রাথমিক স্কুলে পড়ানোটা মেধাবীদের একটা লক্ষ্য হয়।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে মেধাবীরাই শিক্ষক হচ্ছেন। তবুও এখানে শিক্ষার মান, শিক্ষকদের কার্যকলাপ নিয়ে নানা সময়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদেরকে আগের দিনগুলোতে যেভাবে সম্মান করতেন, বর্তমানে কিছু কিছু শিক্ষক বাদে অন্যদেরকে সেভাবে সম্মান করেন না। এর কারণ কী?
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। সেই স্বায়ত্তশাসনটা হল, আমরাই আমাদের শাসন করব। বাইরে থেকে কেউ এসে শাসন করবে না, সরকারের এখানে কোনও খবরদারি নেই। আমাদের সিনেট, আমাদের সিন্ডিকেট, আমাদের একাডেমিক কাউন্সিল এগুলোর মাধ্যমেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালিত করব।
যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ তৈরি করা হয়, তখন কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, 'বঙ্গবন্ধু আপনি যেভাবে বলেছেন আমরা সেভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ তৈরি করেছি। তবে একটা বিষয় আপনি একটু চিন্তা করে দেখবেন, শিক্ষকদেরকে এত স্বাধীনতা দেওয়া উচিত হবে কি না?'
বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, 'শিক্ষকদেরকে তাদের স্বাধীনতা দিয়ে দাও। শিক্ষকরা তাদের বিবেক দ্বারা চলবে'।
এখানেই আমাদের কথা। আমরা যারা শিক্ষকতায় এসেছি তাদের বিবেকটা কি সবসময় ন্যায়নিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ আচরণ করছে? এখন দেখা যাচ্ছে আমরা এই স্বায়ত্বশাসনের অপব্যবহার করছি। এই দোষটা কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের নয়, আমাদের বিবেকের। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অপরাধ, অনিয়ম হচ্ছে এইগুলো কি সিনেটে সিন্ডিকেটে আলোচনা হচ্ছে না? সিনেট সিন্ডিকেটে কিন্তু বহুজনের প্রতিনিধিত্ব আছে। সবাই মিলে যদি একটা বিষয় নিয়ে বসেন, আলোচনা করেন, আমার মনে হয় সেটার সমাধান সম্ভব। স্বায়ত্তশাসনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাবে তখনই যখন একজন শিক্ষক তার বিবেক দ্বারা পরিচালিত হবেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড: বিশ্ব শিক্ষক দিবসে একজন শিক্ষক হিসেবে সবার প্রতি আপনার কী বার্তা থাকবে?
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: শিক্ষক দিবসে আমার বার্তা, আমরা আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে শিক্ষকদের কাছে শিখেছি, তাদের যেন সম্মান করি। এই শিক্ষক শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক না। এই শিক্ষক বলতে পরিবার থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের শিক্ষককে বুঝি। আমাদের মা, বাবা, ভাই, বোন, চাচা, খালা প্রত্যেকেই আমাদের কিছু না কিছু শিখিয়েছেন। যিনি আমাদের শিখিয়েছেন তিনিই আমাদের শিক্ষক।
এই শিক্ষকদের সম্মান করা, মর্যাদা দেওয়ার চর্চা আমাদের করতে হবে। সমাজ থেকে ভদ্রতাবোধ, সৌজন্যতাবোধের মতো যে বিষয়গুলো আমাদের হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলোকে ফিরিয়ে আনতে মানবিক ও সুন্দর এই চর্চাগুলো অব্যাহত রাখা জরুরি।