“ডিজিটাল অর্থ বিপ্লবকে সবার জন্য কার্যকর করে তোলা”
ইতিহাস অসমান্তরালভাবেই এগিয়ে চলে। যেভাবে উনবিংশ শতাব্দীতে টেলিগ্রাফ সময় এবং দূরত্বকে কমিয়ে দিয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই ডিজিটাল অর্থ আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রায় বয়ে আনতে পারে এক বিশাল পরিবর্তন। মহামারীর কারণে ইলেকট্রনিক পেমেন্ট এবং সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ায় যে পরিবর্তন এসেছে তা একইভাবে খুব দ্রুতই ব্যাপক রূপান্তরের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তবে আমাদের অবশ্যই প্রযুক্তির ঝলকানি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিষেবাগুলোর লোভনীয় চিত্রের বাইরেও নজর দিতে হবে। আইএমএফ -এ আমাদের অবশ্যই বাণিজ্য ভারসাম্যের জটিলতা এবং উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলোর সামনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদেরকে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে হবে।
পরিবর্তনের বর্তমান দ্রুতগামীতা বিশ্বের দেশগুলোকে আজকের এই রূপান্তরের দ্বারা নির্দ্বিধায় পরিচালিত হতে নির্দেশ করে না, বরং দেশগুলোকে সঠিক পথ প্রদর্শনের অপরিহার্যতাকে নির্দেশ করে। দেশগুলোর এরূপ কার্যক্রমের সাথে আইএমএফ-এর উচিত দ্রুতই জড়িত হয়ে আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বয়ে আনবে এমন রূপান্তরকে উৎসাহিত করা এবং চ্যালেঞ্জগুলোর এমন সমাধান সামনে নিয়ে আসা যেগুলো সব দেশের জন্যই উপযোগী হবে। আর এখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও আর্থিক অবস্থার উপর, বাজার ব্যবস্থায় সমন্বয় বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, অর্থনৈতিক দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা এবং আর্থিক সমন্বয় সাধনের উপর নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
ডিজিটাল অর্থের দ্রুত উন্নয়ন
ডিজিটাল অর্থ বৈচিত্রময়তার সাথে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। ডিজিটাল নগদ অর্থ হিসেবে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশ্যে ইস্যুকৃত ডিজিটাল মুদ্রাকেও (Central Bank Digital Currencies -CBDC) অন্তর্ভুক্ত করেছে। তবে অবৈধ লেনদেন এড়ানোর জন্য এখানে যথেষ্ট সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগও দিন দিন বিস্তৃত এবং সমৃদ্ধ হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ই-মানি (যেমন কেনিয়ার মোবাইল মানি ট্রান্সফার সার্ভিস MPesa) এবং স্ট্যাবলকয়ন (এক প্রকার ডিজিটাল টোকেন যা ইউএসডি-কয়েনের মত বহিঃবিশ্ব দ্বারা সমর্থিত)- এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এগুলো হলো মূল্য মানের ডিজিটাল উপস্থাপনা, যা দেশের অভ্যন্তরে এবং বহিঃবিশ্বেও মাত্র একটি বাটন চেপে, ই-মেইলের মাধ্যমে লেনদেনের সুবিধা দেয়। তবে লেনদেনের এইসব মাধ্যম সব সময় জাতীয় মুদ্রামানের সাথে স্থিতিশীল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এগুলোর মধ্যে ক্রিপটোএসেটসের (যেমন-বিটকয়েন) কিছুটা স্থিতিশীলতা রয়েছে, যা খুব কমই নগদ অর্থে রূপান্তর করা যায়। তবে এগুলো আবার বাজার ব্যবস্থার উত্থানপতনে ব্যাপকভাবে অসুরক্ষিত হয়ে পড়ে।
ডিজিটাল অর্থব্যবস্থার এই আবিষ্কার এখন বাস্তব এবং দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করছে। আইএমএফ-এর তথ্যমতে, সিবিডিসিগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে এবং এগুলো কমপক্ষে একশ দশটি দেশে ইস্যু করা হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বাহামার স্যান্ড ডলারের কথা বলা যেতে পারে, যার ব্যবহার ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে, চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ই-সিএনওয়াই পাইলট প্রজেক্ট, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কথাও বলা যেতে পারে, যেখানে এখনও ডিজিটাল ডলারের সুবিধা ও ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা চলছে। স্ট্যাবলকয়েন, যা গত দুই বছর আগেও জনসমক্ষে আসেনি, মাত্র ছয় মাসের ব্যাবধানে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে তিন গুণ (২৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৭৫ বিলিয়ন ডলার); যেখানে ক্রিপটোএসেটস (৭৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার) হয়েছে দ্বিগুণ। এবং একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর তুলনায় স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় ই-মানি একাউন্ট খোলার সংখ্যা অনেক বেশি। বিশেষ করে আফ্রিকায় এর জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডিজিটাল মুদ্রাব্যবস্থায় সুযোগসীমা অসীম। একজন স্থানীয় কারিগর তাৎক্ষণিকভাবে বিদেশী গ্রাহকদের কাছ থেকে খুব সহজেই পেমেন্ট পেতে পারেন। বৃহৎ আর্থিক সংস্থার সম্পদ ক্রয়জনিত ব্যাপারগুলো আরও দক্ষতার সঙ্গে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। বন্ধুরা সহজেই বিল ভাগাভাগি করে নিতে পারে কাগজি মুদ্রা বহন করা ছাড়াই। ব্যাংক একাউন্ট নেই এমন ব্যাক্তিও সহজেই ক্ষুদ্রঋণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে লেনদেন কার্য সম্পাদন এবং সঞ্চয়ও করতে পারে নিরাপদে। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বা কাজে এই অর্থ প্রোগ্রামড করা যেতে পারে, এবং আর্থিক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপ্লিকেশন দ্বারা নির্বিঘ্নে অর্থের অ্যাক্সেস করা যেতে পারে। এমনকি এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারও রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরো দক্ষ এবং স্বচ্ছভাবে পুনর্বণ্টন করতে পারে।
নীতির প্রভাব- আগত সুযোগ সুবিধা ও ঝুঁকি সমূহ
আমরা এই ব্যবস্থা থেকে যথেষ্ট সুবিধা গ্রহণ করতে পারি, তবে আমাদেরকে অবশ্যই এর সম্ভাব্য ঝুঁকির ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে। নীতি নির্ধারকদের সামনে যে ধরণের চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে তা নিঃসন্দেহে জটিল এবং বিস্তৃত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এর প্রভাব সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী। তাই এই অর্থ এমনভাবে নকশা, পরিচালনা এবং সরবরাহ করতে হবে যেন মূল্যের স্থিতিশীলতায় আর্থিক নীতি এবং বিনিময় হারের স্থিতিশীলতায় মূলধন প্রবাহের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এবং এই নীতিমালার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ প্রয়োজন, যেন তা অবশ্যই জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা করে। লেনদেন ব্যবস্থা এমন হতে হবে যেন তা দেশগুলোকে আলাদা আলাদা অঞ্চলে বিভক্ত না করে, তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনে কাজ করে। এবং সতর্ক থাকতে হবে যেন যেসব দেশ ডিজিটাল অর্থব্যবস্থা থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং যেসব দেশে এখনো এই ব্যবস্থা চালু হয়নি- এই দুই পক্ষের মাঝে যেনো ডিজিটাল বৈষম্য সৃষ্টি না হয়। এছাড়া ক্রস-বর্ডার পেমেন্টের সহজ প্রাপ্যতা এবং স্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। প্রান্তিক গ্রাহক পর্যন্ত অর্থ সরবরাহের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি খাতগুলোর উচিত একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়া, এবং উদ্ভাবনকে বাধা না দিয়ে বরং স্থিতিশীলতা এবং সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে কাজ করা। এই ব্যবস্থায় লেনদেন এবং সঞ্চয় পরিষেবা খরচ কমিয়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে জোরদার করারও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
অবশেষে, অর্থের এই নতুন ব্যবস্থায় অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। এখানে অবশ্যই ভোক্তাদের সম্পদ সুরক্ষা, নিরাপত্তা, শক্ত আইনী কাঠামো থাকতে হবে এবং যেকোনো ধরণের অবৈধ লেনদেন এড়ানোর কার্যকরী নীতিমালাও থাকতে হবে।
ডিজিটাল অর্থ বিপ্লবের চ্যালেঞ্জগুলো এবং এর সম্ভাব্য ফলাফল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এ বিষয়ে অবিলম্বে নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির জন্য একটি সাধারণ লক্ষ্য প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা, নীতিমালা কার্যকর করা এবং ঝুঁকি নিরসনের ক্ষেত্রে সকল দেশের স্বার্থের অনুকূলে উদ্ভাবনকে সঠিক পন্থায় পরিচালিত এবং উৎসাহিত করার আইনী ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রতিষ্ঠার এখনই উত্তম সময়।
তবে এই মুহূর্তে সঠিক পন্থা নির্ধারণ বেশ জটিল। এই জটিলতায় পরিচালনা নীতি, বাজার কাঠামো, পণ্যের বৈশিষ্ট্য, এবং পাবলিক সেক্টরের ভূমিকা কম আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনতে পারে। পরবর্তীতে আবার পিছনে ফিরে যাওয়াও যথেষ্ট ব্যয়বহুল হতে পারে।
ডিজিটাল অর্থের ব্যাপক বিস্তৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক স্থায়ীত্ব এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতায় উৎসাহিত করা আইএমএফ-এর ম্যান্ডেটভুক্ত। আমরা রাষ্ট্রগুলোর সুনির্দিষ্ট নীতিসমূহ মূল্যায়ন করতে, ডিজিটাল বিভাজন এড়াতে সক্ষমতা বিকাশ, এবং নীতিগত বিকল্প ও ট্রেড অফ শনাক্তের জন্য বিশ্লেষণাত্মক ভিত্তি বিকাশে নিয়মিতভাবে রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জড়িত থাকার পরিকল্পনা হাতে নেই।
আর এটি বাস্তবায়নের জন্য, আইএমএফকে অবশ্যই তার দক্ষতার পরিধি আরও প্রশস্ত করতে হবে, সেই সঙ্গে সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে এবং সর্বজনীন সদস্যপদ অর্জনের সুবিধাগুলোও কাজে লাগাতে হবে। তবে এটা আমাদের পক্ষে এককভাবে করা সম্ভব নয়। চ্যালেঞ্জগুলো অত্যন্ত জটিল এবং বহুমুখী হওয়ায় অন্যান্য স্টোকহোল্ডারদের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আমাদের একান্ত কাম্য। বিশ্বব্যাংক, দ্য ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট এবং তাদের ইনোভেশন হাব, আন্তর্জাতিক কর্মসংস্থাসমূহ এবং নীতি নির্ধারণকারী কর্তৃপক্ষ, সেই সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ভুক্ত কর্তৃপক্ষ- এদের প্রত্যেকেই একে অপরের পরিপূরক অংশীদার, যাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং তা বাস্তবায়নে কর্মদক্ষতা রয়েছে। একযোগে হাত মিলিয়ে কাজ করার মাধ্যমে আমরা পরিবার ও সংস্থাসমূহের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করতে পারি এবং ডিজিটাল অর্থ বিপ্লবের ক্ষতিকারক দিকগুলো সহজেই এড়াতে পারি।
- মূল লেখক: টবিয়াস আড্রিয়ান ও টম্মাসো মানচিনি গ্রিফফোলি
- অনুবাদ: জান্নাতুল তাজরী তৃষা