কোনো দেশের নাগরিককেই ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করা যাবে না
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মুখপাত্রখ্যাত ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সাম্প্রতিক ভারত সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাক্ষাৎ না দেওয়ার সমালোচনা করে এক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট এস এন এম আবদির লেখা নিবন্ধের আলোকে গতকাল ঢাকা ট্রিবিউন এক নিবন্ধ প্রকাশ করে। আবদি ভারত- বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির কিছু গুরুতর প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন।
আবদি'র মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাক্ষাৎ দিচ্ছেন কি না তার উপর নির্ভর করে কোন বিদেশি অতিথির সফর দিল্লি কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রাধিকারের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তাহলে কোথায়? প্রশ্ন রেখেছেন তিনি।
ভারত- বাংলাদেশ জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠকে যোগ দিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ১৮ জুন ভারত সফর করেন। অথচ এই সফরের ১০দিন আগে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি সফর করেন এবং মোদি তাকে সাক্ষৎ দেন- যা ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়য়ের আনুষ্ঠানিক ওয়েব পেজে ফলাও করে প্রচার করা হয়। এস এন এম আবদি তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ২০১৪ সালে জেসিসি বৈঠকে যোগ দেওয়া বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন। আবদি যদিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের এই নয়া অবস্থানকে কিছুটা কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে 'অন্যায্য' বলে উল্লেখ করছেন।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করছেন এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ হয়নি- এমনটি ঘটেনি। গতবছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধু'র জন্মশতবার্ষিকী ও দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন এবং সেই সময়ই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সফর নিয়ে কাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী সেপ্টেম্বরেই এ সফর অনুষ্ঠিত হবে। ফলে এবারের জেসিসি বৈঠকের দিকে সকলের বাড়তি মনোযোগ ছিল। ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্য, সীমান্তের সহিংসতা, আন্তঃযোগাযোগ, সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, নদীর পানি বন্টন, রোহিঙ্গাসহ অনেকগুলো অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে- যা দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে স্থান পেতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছিল, ১৯ জুন তারিখের দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন মোদির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা সরাসরি তাকে পৌঁছে দিতে পারবেন; কিন্তু তেমনটি ঘটেনি।
ভারত- বাংলাদেশের সম্পর্কের মাত্রা, গভীরতা ও বহুমাত্রিকতা নতুন করে উল্লেখ করার কিছু নেই। তারপরও পারস্পারিক সম-সহযোগিতার মনোভাব দুই দেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত। করোনা এবং করোনা পরবর্তী বিশ্ব এখন আরও জটিল ও সংকটময় অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বে এখন নানা ধরনের মেরুকরণ ঘটছে। এ রকম অবস্থায় প্রতিটি দেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পক্ষালম্বন করতে হচ্ছে। বিশ্ব-রাজনীতির এই পক্ষভুক্ত হবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তেমন মতবিরোধ দেখা যায়নি।
চীন- ভারত সম্পর্কে সীমান্ত প্রশ্নে পরস্পরের মধ্যে বিরোধ ও সহিংসতা রয়েছে। বাণিজ্য প্রশ্নে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। বাংলোদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক নিয়ে, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ, বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণ ভারত- বাংলাদেশের মধ্যে একটু অস্বস্তি তৈরি করলেও ভারত যখন বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ব্রিকসে চীনের সাথে মিলিত হয়, তখন পারস্পারিক অনেক অস্বস্তি ও আপাত বিরোধ আর সামনে থাকে না।
তবে বিশ্ব-রাজনীতির পাশাপাশি আমাদের দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যেভাবে স্থান করে নিয়েছে- তার ফলে ভারত যেমন তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারিয়েছে, তেমনি ভারতের অন্যান্য ধর্মের মানুষ ক্রমান্বয়ে নিরাপত্তাহীন, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। সর্বত্র বিযুক্তকরণ চলছে। এমনকী অন্য ধর্মের নাগরিকদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হচ্ছে না। তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এটা কী, 'প্রত্যেক ক্রিয়ারই- পাল্টা প্রতিক্রিয়া থাকে' সেই কারণে নাকি- একই বীজ এখানেও লুকায়িত ছিল। আমাদের দেশেও ধর্মীয় জাতীয়তার বিকাশ ব্যাপক। এখানেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ভারত ও বাংলাদেশ এখন এই প্রশ্নকে উপেক্ষা করে বেশিদূর এগুতে পারবে না। কোনো দেশের নাগরিককে ধর্মদ্বারা বিভাজিত করা যাবে না- সভ্যতার এই মর্মবাণী যদি নিজ দেশে প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, তবে কোনো সরকারই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না।
ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, একতরফা উজানের পানি নিয়ন্ত্রণসহ সকল ন্যায্য হিস্যা নিয়ে আলোচনার চেয়েও জরুরি হলো ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার জন্য কার্যকর উদ্যোগ ও রাজনৈতিক সংস্কার। তা নাহলে কোনো এক নূপুর শর্মা বা কোনো এক জিন্দাল সকল উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সভ্যতার চাকা থামিয়ে দিতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে নুপুর শর্মার ইস্যুটি সমাধান হয়েছে মনে করলেও- তা সমাধান হয়নি। ভারতের জয়পুরের একটি ঘটনা কিংবা আজমিরের মাজারের সেই খাদেমের বক্তৃতা, সবই নতুন উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক আরো গভীর ও জোরদার হওয়া দরকার নাগরিকদের পূর্ণ নিরাপত্তার জন্যই।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক