তৃণমূল: কেন্দ্রে বিজেপির সমর্থক, বিরোধিতা যা কিছু নিজ রাজ্যে!
পশ্চিমবাংলার রাজ্য, রাজনীতি গত দুই দিন ছিল নাটকে ভরপুর।
পশ্চিমবাংলার বর্তমান শিল্পমন্ত্রী তৃণমূল দলের পশ্চিমবাংলার সাধারণ সম্পাদক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে কেন্দ্রীয় সংস্থা ইনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্টের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। প্রায় ২৭ ঘণ্টা পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এই দীর্ঘ সময় কেন্দ্রীয় সংস্থা তার বাড়িতেই অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিল। ইনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট সারা পশ্চিমবাংলা তথা কলকাতা শহরেও বহু স্থানে অনুসন্ধানে নামে, প্রায় এই একই সময়ে । এতগুলো জায়গায় অনুসন্ধান চালানোর মূল লক্ষ্য কী ছিল? এটা মূলত পশ্চিমবাংলার আদালত কর্তৃক নির্দেশ পেয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই যে তদন্ত পরিচালনা করছিলেএই অভিযান তারই বর্ধিত রূপ।
প্রায় পাঁচ মাস আগে পশ্চিমবাংলা হাইকোর্টের একক বেঞ্চের বিচারপতি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এক আদেশ জারি করেছিলেন। শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত এক দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই আদেশে তিনি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তদন্ত অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবং তার আদেশে তিনি বলেছিলেন প্রয়োজনে তাকে গ্রেপ্তার করা হোক, কারণ পশ্চিমবাংলায় শিক্ষক নিয়োগে চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষায় পাস করেনি এমন পরীক্ষার্থীকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে আদালতের কাছে চাকরি প্রার্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, আদালত এই অভিযোগ আমলে নেয়। অভিযোগকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয় স্কুল সার্ভিস কমিশন প্রথম যে তালিকা প্রকাশ করেছিল সেই তালিকায় যাদের নাম ছিল পরবর্তীতে তালিকা পরিবর্তন করে পরীক্ষায় পাস করেনি এমন অনেককে ঢুকিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো বর্তমান একজন মন্ত্রী কন্যাকে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে।
মন্ত্রী পরেশ অধিকারী, এর আগে বাম আমলে ফরওয়ার্ড ব্লকের মন্ত্রী ছিলেন । পরে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে বর্তমানে মন্ত্রী হয়েছেন ।
মন্ত্রীকন্যাকে প্রকাশিত তালিকায় এক নাম্বার রাখা হয়েছে অভিযোগ উঠলে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একক বেঞ্চের এ অভিযোগ গ্রহণ করে। এবং মন্ত্রীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য ভারতীয় কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআইকে নির্দেশ প্রদান দেয়। কিন্তু সেই নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে হাইকোর্টের যৌথ বেঞ্চ স্থগিত ঘোষণা করে দেয়। এবং এই স্থগিত আদেশ পাঁচ মাসের জন্য বাড়ানো হয়।
কী যুক্তিতে পাঁচ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ বাড়ানো হলে তা অস্পষ্ট এখনো। পাঁচ মাস পর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে আবার হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে তার আইনজীবী তদন্ত অভিযোগই স্থগিত রাখার জন্য আর্জি জানায়। তবে হাইকোর্ট সে ব্যাপারে আর কোন শুনানি গ্রহণ করেনি। এই পর্যায়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআইর পাশাপাশি তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় আরেক বাহিনী ইনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ।
অভিযোগের ভিত্তিমূল তৈরি হয়েছিল বহু আগেই । মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সময়েই এই অভিযোগের ভিত্তি রচিত হয়। এই শিক্ষক নিয়োগ মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিকেই, প্রধানত দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। দলীয় ভিত্তিতে এই নিয়োগ পরে টাকার বিনিময়ে নিয়োগে রূপান্তরিত হয়। নগদ টাকার ভিত্তিত নিয়োগ বণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ ওঠে।
মমতা ব্যানার্জির ক্ষমতার এই সময়ে প্রায় ৬/৭ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। গত শুক্রবার সকাল থেকে এন্ফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট কলকাতা শহরের নানান প্রান্তরে, সম্মিলিতভাবে তল্লাশিতে নেমেছে।
অভিযানের অংশ হিসেবে এন্ফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট হাজির হযয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পার্থ চ্যাটার্জীর বাসভবনে। শুক্রবার সকাল সাতটা থেকে শনিবার দুপুর ১০ টা পর্যন্ত অব্যাহতভাবে তল্লাশি চালিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী পার্থকে গ্রেপ্তার করেছে।
পার্থর এই ঘটনার সঙ্গে উঠে এসেছে তার আরেক বান্ধবীর নাম। সেখানেও ইনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট অভিযান চালিয়ে ২১ কোটি টাকার নগদ অর্থ, বৈদেশিক মুদ্রা ও একাধিক টেলিফোন সেট আবিষ্কার করে। এ বান্ধবীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পশ্চিমবাংলা রাজ্য, রাজ্যের রাজনীতির এই অন্ধকার পর্বের উন্মোচন এই প্রথম নয়। এর আগেও মমতা ব্যানার্জির সময়ে তার একাধিক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এসেছে। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার আগে ভারতের এই রাজ্যটিকে দীর্ঘ ৩৪ বছর শাসন করেছে বাম জোট সিপিএম। তখন বাম জোটের দীর্ঘকালের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। তার জন্ম বাংলাদেশে। তার সময়েও ছেলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল, তবে ৩৪ বছরের বাম শাসনের সময় মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সরাসরি বড় ধরনের কোন দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ পায়নি বা তার প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেনি।
মমতা ব্যানার্জি তৃতীয় দফায় সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচিত হয়েছেন ঠিক, কিন্তু আগের মতোই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছেই। কয়লা দুর্নীতি, গরু পাচার দুর্নীতি, চিট ফান্ডের দুর্নীতি- একাধিক দুর্নীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস শীর্ষস্থান অধিকার করেছে।
ভারত স্বাধীনতার লাভের পর থেকে একটি রাজ্যের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে এত ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ কখনো সামনে আসেনি। এই দলটি সাফল্যের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে, সংখ্যালঘুদের সমর্থ্ন নিয়ে বারবার বিজয় অর্জন করছে।
ভারতীয় কেন্দ্রীয় সংস্থা সমূহের এই অভিযানকে মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক দল সবসময়ই কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষারোপ করেছেন: তারা বলেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের যে রসায়ন তা প্রমাণ করে, কেন্দ্রে মমতা ব্যানার্জি বিজেপি শাসনই অব্যাহত রাখতে চায়।
সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূলের ভূমিকা তাই প্রমাণ করে। বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা যশোবন্ত সিং পরে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেছিল, তাকেই সর্বদলীয় প্রার্থী বানানো কিংবা দীর্ঘদিনের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন, তাকে উপরাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণে তৃণমূল কংগ্রেসের মৌন সমর্থন ছিল এতে এটাই প্রমাণ করে রাজ্য পর্যায়ে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির বিরোধী শক্তি হলেও, সর্বভারত শাসনে তৃণমূল কংগ্রেস আসলে ভারতীয় বিজেপিরই অনুসারী।
এককালে মমতা ব্যানার্জি নিজেও ওই দলেরই মন্ত্রী মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন । পশ্চিমবাংলায় বিজেপিকে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন। পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায়নের সময় তৃণমূল কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল পশ্চিমবাংলার দীর্ঘদিনের বাম শাসনের পরিসমাপ্তি করে ক্ষমতা দখল করা। বাম শাসনের সমাপ্তি ঘটেছে।
তবে বাম শাসন তিরোহিত হয়েছে নিজেদের ব্যর্থতাতেই। উল্টো তৃণমূল কংগ্রেসের বেড়ে ওঠার জন্য বাম সংগঠনগুলোই দায়ী।
রাজ্য পর্যায়ে দুর্নীতির এরকম তালিকা, ভারতের অন্য কোন রাজ্যে, কোন আঞ্চলিক দলের বিরুদ্ধে এত তীব্রভাবে উঠে আসেনি। যদিও বিহারের লালু প্রসাদ যাদবকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িতে হয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ।
তবে পশ্চিমবাংলার তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে কেন্দ্রীয় বিজেপির সুমধুর সম্পর্ক থাকলেও ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্বাধীন সত্তা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছে না। তার প্রমাণ নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশনাগুলো ।
ইনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ও সিবিআইর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক অনুসারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিযোগ উঠলেও তারা যে স্বাধীনভাবে কাজ করছেন তারা যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আমরা যদি আমাদের গণতন্ত্র, বিচার, রাষ্ট্রীয় শাসন, পুলিশ ইত্যাদিকে ভারতীয় আঙ্গিকে বিচার করি তাহলে অনুধাবন করতে পারব আমারা কতটা পিছিয়ে আছি।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আসলে হলে সাত দিন কেটে যায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে। কিংবা পথচারী নারীর মোবাইল ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যুদ্ধের ভাইরাল হওয়া ছবি আমরা উপভোগ করি, আমরা দেখতে পাই রেলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একাই কিভাবে লড়াই করছে! যদি সামনে কোন গভীর অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয় তাহলে এই শাসন, এই বিচার সব মিলিয়ে কোন জায়গায় দাঁড়াবে আমাদের দেশ!