চা শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির ন্যায্য দাবি মেনে নিতে গড়িমসি কেন?
চা শ্রমিকরা মাত্র ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ধর্মঘট করছেন; তারা বর্তমানে পাচ্ছেন মাত্র ১২০ টাকা। ৯ আগস্ট থেকে এই নিয়ে শ্রমিকরা আন্দোলন করে যাচ্ছেন; প্রায় ১১ দিন হয়ে গেল। এত কম মজুরি দিয়ে বেঁচে থাকা যায় না, এই বিষয়ে নিশ্চয়ই কেউ বিতর্ক করবেন না। কিন্তু আশ্চর্য যে চা-শ্রমিকদের দাবির প্রতি মালিক পক্ষ কোনো সাড়া দিচ্ছেন না।
ইতোমধ্যে, চা–শ্রমিক নেতাদের নিয়ে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী শ্রীমঙ্গলের শ্রম অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন; সেখানে কোনো সমঝোতা করতে পারেননি।
ঢাকার শ্রম অধিদপ্তরের কার্যালয়ে শ্রমিকপক্ষ ও মালিকপক্ষকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে গত ১৭ আগস্ট তারিখে। সেখানে চার ঘণ্টার বেশি বৈঠকের পরও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির দাবির বিপরীতে মালিকপক্ষ 'অনুগ্রহ' করে ১৪০ টাকা করতে সম্মত হন। অর্থাৎ তারা মাত্র ২০ টাকা বাড়াতে রাজি হয়েছেন!! এর প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকরা তাদের ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। মাত্র ২০ টাকা বৃদ্ধির জন্য তারা খেয়ে না খেয়ে কর্মবিরতি করছেন না, এই কথা না বোঝার মতো বোকা এই মালিকপক্ষ নয়।
চা শ্রমিকরা আরো ক্ষুব্ধ হয়েছেন এজন্য যে, দুই বছর পর পর মজুরি বৃদ্ধির যে চুক্তি ছিল তাও মানা হচ্ছে না। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ চা সংসদের মধ্যে দুই বছরের চুক্তি শেষ হয়েছে ডিসেম্বর ২০২০ সালে। এরপর জানুয়ারি ১৯, ২০২১ তারিখে চা শ্রমিক ইউনিয়ন মজুরি বৃদ্ধিসহ ২০ দফা দাবি পেশ করে; পরবর্তী কালে প্রায় ১৩টি সভা হয়েছে কিন্তু আজও তাদের দাবি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শেষপর্যন্ত ২০২২ সালের ৩ আগস্ট তারা মালিকপক্ষকে তাদের দাবি মানার জন্য চূড়ান্ত আহবান জানান। কিন্তু মালিকপক্ষ এতে কোনো কর্ণপাত করেনি। বোঝাই যাচ্ছে, মালিকপক্ষ কালক্ষেপণ করার কৌশল নিয়েছেন- যেন শ্রমিকরা বাধ্য হয় তারা যে মজুরি দেবে, সেটাই মেনে নিতে। কিন্তু এবার বোধ হয় সেটা হবে না।
বাংলাদেশে চা একটি অর্থকরী ফসল। মাত্র আটটি অর্থকরী ফসলের মধ্যে চা দ্বিতীয়। চা উৎপাদনের জন্যে ঢালু জমি, কম তাপমাত্রা এবং বেশি বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয়। সিলেট, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়ে চা উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্থান।
২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে চায়ের বাজারের মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫শ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। বাংলাদেশ চা বোর্ডের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসাবে দেশের ১৫৯টি চা বাগানে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৪৩ জন শ্রমিক রয়েছেন। এদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। তারা যে এই টাকায় জীবন নির্বাহ করতে পারছেন না, খেয়ে না খেয়ে আছেন তা বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন এবং আইএলও- এর গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেটের চা বাগানের চা শ্রমিকদের ৭৪% দারিদ্রসীমার নীচে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ, তাদের দৈনিক আয় ১.৯০ মার্কিন ডলারেরও কম। বর্তমান ডলারের বাজারমূল্য অনুযায়ী তা ১৭৮ টাকা হয়। চা শ্রমিকরা সেই মজুরিও পাচ্ছেন না; এমনকী মালিকপক্ষ করুণা করে যে মজুরি প্রস্তাব করছেন, তাও এর চেয়ে অন্তত ৩৮ টাকা কম। এই হিসাবটুকুও কি মালিকপক্ষ বোঝেন না? কিন্তু সরকারের শ্রম অধিদপ্তরই বা কি করে তা মেনে নেন? ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
চা-বাগান মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ টি-অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) দাবি যে, শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধা মিলে তারা প্রায় ৪০০ টাকা পেয়ে থাকেন। প্রত্যক্ষ সুবিধার মধ্যে আছে ওভারটাইম, বার্ষিক ছুটি ভাতা, উৎসব ছুটি ভাতা, অসুস্থতাজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিলের ওপর প্রশাসনিক ভাতার মাধ্যমে সর্বমোট গড়ে দৈনিক মজুরির প্রায় দ্বিগুণ নগদ অর্থ দেওয়া হয় বলে ১৬ আগস্ট এক বিবৃতি দেয় বিটিএ। কিন্তু এই ভাতাগুলো নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট কারণে দেয়া হয়- তা কি করে দৈনিক মজুরি হয়, এটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয় কিছুতেই।
এই সুবিধা যখন পাওয়া যাবে তখন সেটা যোগ হয় মাত্র; সারা বছরে প্রতিদিনের মজুরির সাথে এই টাকা নিশ্চয়ই যোগ হয় না। তাদের চিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা নেই। খবরে দেখেছি- একজন নারী শ্রমিক বলছেন, অসুখ হলে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ দেয় না। তাদেরকে রেফার করা হয় অন্য হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা নিতে হলে যে অর্থের প্রয়োজন, সেটা এই শ্রমিকদের নেই। তাদের পুষ্টিহীনতা এতো বেশি যে, তারা জাতীয় গড় আয়ুর চেয়ে ২০ বছর কম বাঁচেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একটি গবেষণায় এই তথ্য পাওয়া গেছে।
চা শ্রমিকদের ৭০% নারী শ্রমিক। তাদের প্রতি বৈষম্য অনেক বেশি। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই তাঁরাই বেশি সোচ্চার হয়েছেন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে নারীদের দেখা যাচ্ছে।
একজন নারী চা–শ্রমিক মূর্তি হাজরার কথা একটু তুলে ধরছি (প্রথম আলো, ১৭ আগস্ট, ২০২২)। তিনি বলছেন, 'আমরা ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করছি। আমাদের শ্রমিকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চা–বাগানে কাজ করতে হয়। চা–বাগানের সেকশনে যেতে কত পথ হাঁটতে হয়। কত নালা, খাল পাড়ি দিয়ে আমরা চা–পাতা তুলি। রাতে যখন খাবার খেতে বসি, তখন মাছ, মাংস কিছুই থাকে না। কোনোরকমে ভাত খাই। আমাদের সন্তানেরা যখন বিভিন্ন জিনিস কেনার জন্য টাকা চায়, আমরা দিতে পারি না। গত সপ্তাহে দোকানে জিনিসের যে দাম ছিল, এক সপ্তাহের মধ্যে তার থেকে অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়। জিনিসেরও দাম বাড়বে, আমাদের মজুরি বাড়বে না, তাহলে আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব।'
কত কষ্ট সহ্য করার পর মূর্তি হাজরার মতো শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে রাস্তায় নেমেছেন- সেটা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন মালিকপক্ষ। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চা পাতা উত্তোলনের সময়। এই সময় দিনে শ্রমিকরা যতো বেশি পাতা তুলতে পারবেন ততই তাদের আয় বেশি হবে। শ্রমিকরা জানেন ধর্মঘট চলার কারণে চা পাতা উত্তোলন করা হচ্ছে না, যা এরপর উত্তোলন করার উপযোগী থাকবে না। এবং যে পাতা উত্তোলন করার পর প্রক্রিয়াজাত করণের অপেক্ষায় ছিল- তাও নিশ্চয়ই পাতা পচে নষ্ট হচ্ছে। ফলে তাদের আয়ের মূল সময়টাও নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে, দিনে ১৫-১৬ কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে চা শিল্পের মালিকদের। বলাই বাহুল্য, আন্দোলন চলতে থাকলে এই লোকসানের পরিমাণ আরো বাড়বে।
আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২ ঘন্টা কর্মবিরতি দিয়ে, কিন্তু মালিক পক্ষের গোঁয়ার্তুমির জন্য এখন পূর্ণ দিবস ধর্মঘট পালন করছেন শ্রমিকরা। তারা সরকারের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল থেকে শোকের মাসে কঠোর কর্মসুচিতে যাননি, ১৪ এবং ১৫ আগস্ট ২ দিন কর্মসূচি স্থগিত রেখেছেন; কিন্তু বারে বারে সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হওয়ায়- তারা এখন মহাসড়ক অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতোমধ্যে, হবিগঞ্জে মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে।
চা শিল্পের ক্ষতি হোক তা শ্রমিকরা মোটেও চান না। তারা জানেন, এটা তাঁদের রুটি-রুজির জায়গা। বরং মালিক পক্ষের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারাই এই শিল্পের প্রতি আন্তরিক নন; তারা লোকসান হচ্ছে জেনেও শ্রমিকের দাবি মানছেন না। কিন্তু শ্রমিকরাও বুঝে গেছেন যে, মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি ছাড়া তারা দাবি মানবে না।
মালিকপক্ষ চা শ্রমিকদের দীর্ঘদিন ক্রমাগত শোষণ করে আসছেন এবং এই শ্রমিকদের দাসতূল্য করে রেখেছেন। কিন্তু এমন শোষণ তো অনন্তকাল চলতে পারে না। কাজেই আন্দোলন চলবে। দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা দাবির প্রতিও সংহতি জানাই।
পুনশ্চ: সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ন্যূনতম ১৪৫ টাকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন চা শ্রমিকরা।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।