গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কতটা পোড়াবে ইউরোপকে?
অস্বাভাবিক খরা আর তীব্র তাপপ্রবাহে ইউরোপের জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, ঠিক তখনই আসন্ন শীতে জ্বালানির সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকারের কপালে।
ইউরোপীয় দেশগুলো বিশেষত, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো যে, রাশিয়ার জ্বালানির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল তা কারও অজানা নয়। গোটা ইউরোপের মোট গ্যাস চাহিদার ৪০ শতাংশ মেটানো হয় রাশিয়া থেকে পাইপলাইনগুলোর মাধ্যমে আসা গ্যাস থেকে। ইউরোপের দেশগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদনও অনেকটাই রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।
জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশের সাধারণ জনগণের ঘর উষ্ণ করা থেকে শুরু করে রান্নার চুলা পর্যন্ত জ্বলে রাশিয়া থেকে আসা গ্যাসে। এছাড়া, কলকারখানার নানান উৎপাদন বিশেষ করে সার কারখানা, ইস্পাত কারখানাসহ অনেক ভারি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে রাশিয়ার গ্যাস ব্যবহার করা হয়।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো মস্কোর ওপর কঠোর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পশ্চিমের এমন পদক্ষেপের উদ্দেশ্য বিশ্ব অর্থনীতি থেকে রাশিয়াকে একঘরে করে দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণ ভারি অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করাসহ নানান ধরনের সামরিক সহায়তাও দিয়েছে। তবে, এখন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য পশ্চমা মিত্রারা ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
অন্যদিকে, পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া নিজের জ্বালানি সম্পদকে ব্যবহার করছে হাতিয়ার হিসেবে, যাকে পশ্চিমারা নাম দিয়েছে 'জ্বালানি অস্ত্র'। রাশিয়া থেকে যেসব পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাস সরবরাহ হয়, ইউক্রেন সংকটের পর থেকে নানান অজুহাতে সেসব পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ কখনো কমিয়ে দিয়েছে, কখনো আবার একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া।
ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল হলো জার্মানি। নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনের মাধ্যমে রুশ গ্যাসের যোগান নিশ্চিত হয় এই দেশে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নর্ড স্ট্রিম-১ দিয়ে গ্যাসের সরবরাহ ৮০ শতাংশ কমিয়েছে পুতিনের দেশ। গত শুক্রবার পাইপলাইনের টারবাইনে ফুটো হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে গ্যাস সরবরাহ একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে মস্কো। প্রাথমিকভাবে মেরামতের কাজের জন্য ৩ দিন সরবরাহ বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও পরে ক্রিমিয়ার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেওয়া পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে।
আচমকা রাশিয়ার গ্যাসের সরবরাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেই দেখা দিয়েছে তীব্র জ্বালানি সংকট। দেশে দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। কোনো কোনো দেশে বিদ্যুতের দাম তিন গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কলকারখানাগুলোতে গ্যাসের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। অনেক সার কারখানা গ্যাস সংকটে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। জ্বালানি সংকটে ইউরোপসহ সারাবিশ্বের মুদ্রাস্ফীতিও বেড়েছে লাগামছাড়াভাবে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মুদ্রাস্ফীতির হার ৯.১ শতাংশ, যা গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। হঠাৎ রাশিয়ার গ্যাসের শূন্যতা ইউরোপের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আচমকাই নাড়িয়ে দিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্ব যেমন তাদের হাতে থাকা বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকে মস্কোর বিরুদ্ধে অবরোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, ঠিক তেমনি রাশিয়ার হাতে থাকা জ্বালানি অস্ত্রকেও ইউরোপের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে রাশিয়া। ফলশ্রুতিতে ইউরোপসহ সারাবিশ্বের তেল-গ্যাসের দাম এখন আকাশছোঁয়া। এদিকে, ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে সাইবেরিয়ান পাইপলাইন দিয়ে চীনসহ এশীয় দেশগুলোতে গ্যাস রপ্তানি বৃদ্ধি করেছে রাশিয়া। সস্তা দামে চীন ও ভারতকে জ্বালানি সরবরাহ করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
গোটা ইউরোপ যখন জ্বালানি সংকট আর মুদ্রাস্ফীতিতে নাকাল, তখন রাশিয়া তার ফিনল্যান্ড সীমান্তবর্তী পোর্তাভায়া নামের গ্যাস প্লান্টে প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের গ্যাস পুড়িয়ে ফেলছে। এ থেকেই বোঝা যায়, গ্যাস না দিয়ে ইউরোপকে শায়েস্তা করতে চাইছে মস্কো।
যদিও ইউরোপীয় দেশগুলো বিকল্প জ্বালানির উৎস খুঁজতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এত দ্রুত জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা অনেকটা দিবাস্বপ্ন দেখার মতোই। বিকল্প পথ হয়তো ইউরোপ খুঁজে পাবে, তবে তা হবে যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল।
ইউরোপীয় সরকার ও জনসাধারণের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা আসন্ন শীত নিয়ে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই শীতকালে প্রচন্ডরকম ঠান্ডা পড়ে। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে যায়। শীতকালে ঘর ও অফিসগুলো গরম রাখতে যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, তার বেশিরভাগ চালাতেই জ্বালানি হিসেবে বা জ্বালানির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক গ্যাস।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপ উৎপাদনে জ্বালানি তেল বা বিদ্যুতের মত অন্যান্য শক্তির উৎসে রাতারাতি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। গত ২৭ জুলাই বেলজিয়ামের জ্বালানি মন্ত্রী টিমে ড্যান ডের স্ট্রেটেন এক টুইট বার্তায় বলেন, "ইউরোপের দেশগুলোর উচিত অবিলম্বে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সংশোধন করা। আমরা যদি এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নেই, তাহলে আগামী পাঁচটি বা দশটি শীত হবে ভয়াবহ। আমাদের অবশ্যই বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে, এ নিয়ে কাজ করতে হবে।"
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের শুরুর পরপরই ইইউ বুঝতে পারে, আগামীতে তারা ভয়াবহ গ্যাস সংকটে পড়তে যাচ্ছে। বলা যায়, এই আশঙ্কা থেকেই ইইউ রাশিয়ার গ্যাস ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও নেতারা সে সময় বলেছেন, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মস্কোকে শায়েস্তা করতে এ পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, মস্কোকে শায়েস্তা করার চেয়ে রুশ গ্যাসের ওপর থেকে নিজেদের অধিক নির্ভরশীলতা কমানোই ইউরোপের এমন পদক্ষেপের প্রধান লক্ষ্য।
এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ইউরোপের দেশগুলো বেশি ব্যয়বহুল তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ইতোমধ্যে জার্মানি উত্তর সাগর উপকূলে এলএনজি আমদানির টার্মিনাল নির্মাণ কাজও শুরু করেছে, কিন্তু এটি প্রস্তুত হতে আরও অনেক সময় লাগবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু বা এলএনজি টার্মিনাল তৈরি করে তরল গ্যাস আমদানি করতে কয়েকবছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
আগামী শীতের কথা মাথায় রেখে জার্মান সরকার গ্যাস রেশনিংয়ের সিদ্ধান্তও নিয়েছে। তবে ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহের চেষ্টা করলেও সেটি কার্যকর হতে অনেক সময় লেগে যাবে। আর এরমধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মে আসা শীতকালীন তীব্র ঠান্ডাকে নিশ্চয়ই আর থামিয়ে রাখা যাবে না। তাই প্রচণ্ড গরমেও এখন আসন্ন শীতকে নিয়ে ইউরোপীয়দের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট থেকে উদ্ভূত এই গ্যাস সংকট মূলত ইউরোপকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, অত্যাবশ্যকীয় কোনো উপকরণের (যেমন- জ্বালানি, খাদ্য) জন্য একক কোনো উৎসের ওপর নির্ভরশীল হতে নেই। হলে তার ভবিষ্যৎ পরিণতি সুখকর নাও হতে পারে। কারণ অন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো চিরস্থায়ী বন্ধু কিংবা শত্রু নেই। এখানে স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে সম্পর্কের গতি নির্ধারিত হয়। তাই প্রতিটি রাষ্ট্রেরই উচিত নিজের অত্যাবশ্যকীয়তার ক্ষেত্রে একাধিক বিকল্প আগে থেকেই ঠিক করে রাখা।
লেখক: মোঃ রবিউল ইসলাম, সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
.