নারী ফুটবলার দেশে দেশে: নিষিদ্ধ করেও দাবিয়ে রাখতে পারেনি!
"আমাদের কাছে নিত্য অভিযোগ আসছে যে, মেয়েরা আজকাল পেশাদার ফুটবল খেলছেন! আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, ফুটবল মেয়েদের জন্য মোটেও উপযুক্ত খেলা নয় এবং একে উৎসাহ দেওয়াটা অনুচিত। . . . . আজকের সভার পর কাউন্সিল অনুরোধ করেছে-ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলো যেন আর মেয়েদের ফুটবল ম্যাচের জন্য কোনো মাঠ বরাদ্দ না দেয়!"
এই 'ঐতিহাসিক' সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এফএ)-এর কনসালটেটিভ কমিটি, আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে, ১৯২০ সালে। কেনো এই সিদ্ধান্ত এল তা জানতে হলে এর কিছুদিন আগের একটি ম্যাচের কথা জানতে হবে আমাদের। কারণ 'মেয়েদের ফুটবল' কথাটা কেমন শোনালেও তা একেবারে অভূতপূর্ব ছিল না মোটেও। ইতিহাস বলে, এমনকি চীনের হান ডাইন্যাস্টির মত প্রাচীন কালেও মেয়েরা ফুটবল খেলেছে। তখন এর নাম ছিল সু ঝু!
১৮৯৪ সালে অ্যাকটিভিস্ট ও নারীবাদী নেটি হানিবাল এর উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ লেডিস ফুটবল ক্লাব। যদিও শুরু থেকেই পুরুষ পরিচালিত ফুটবল ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর ভ্রুকুটির শিকার হতে হয়েছিল এই ক্লাবকে, তারা খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল সব ধরনের প্রতিকূলতাকে সামলেই। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছিল প্রিস্টন ইংল্যান্ডের প্রথম বিখ্যাত নারী ফুটবল দল-ডিক ক্যার লেডিস এফসি। ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ওই কুখ্যাত সিদ্ধান্ত আসার কিছুদিন আগেই ফুটবল টিম ডিক ক্যার লেডিস তাদের অসামান্য ফ্রান্স সফর শেষ করে ইংল্যান্ডে ফিরেছে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে, আর বিখ্যাত গুডিসন পার্ক মাঠে সেন্ট হেলেনস এর বিপরীতে মাঠে নেমেছে ১৯২০ সালের ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ।
ব্রিটেনের ঘোর পুরুষতান্ত্রিক ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করছে নারী ফুটবলারদের ক্রমবর্ধমান এই জনপ্রিয়তাকে, হতবাক হয়ে যাচ্ছে শুনে যে ম্যাচের দিন ৫৩ হাজার দর্শক গ্যালারি দখল করে রেখেছিলেন ওইদিন, আরও ১০ থেকে ১৫ হাজার সমর্থক আসন না পেয়ে মাঠের বাইরে হইচই করছিলেন। কিন্তু তাদের সমস্যা কেবল এদের জনপ্রিয়তায় নয়, টাকা পয়সার জন্যও বটে। কারণ তার পরদিন (২৮ ডিসেম্বর ১৯২০) ল্যাংকশায়ার ইভনিং পোস্ট সংবাদ পরিবেশন করেছে-'এটি একটি চ্যারিটি ম্যাচ ছিল, যার আয় বেকার এবং অথর্ব মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। অবিশ্বাস্য যে ৫৩ হাজার দর্শক মাঠে উপস্থিত ছিলেন খেলার সময়, আর ম্যাচ থেকে আনুমানিক আয় হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড!' বলাই বাহুল্য মেয়েদের ম্যাচ খেলার এই অর্থকড়ির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না এফএ'র; আর এ ব্যাপারটি তাদেরকে ক্রমাগত ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত করে তুলছিল। তারই ফলাফল এই কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কোনো ক্লাব যেন তাদের মাঠে মেয়েদের খেলতে অনুমতি না দেয়! দিলে এফএ সংশ্লিষ্ট ক্লাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল মিডিয়াও পক্ষ নেয় অ্যাসোসিয়েশনের, দি হাল ডেইলি মেইল সম্পাদকীয় লেখে এফএ'র 'বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত' আর 'ফুটবল খেলার প্রেস্টিজ' রক্ষায় চলমান প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়ে! এক দুই বছর নয়, ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন নারীদের মাঠে খেলতে না দেওয়ার এই নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছিল পরবর্তী ৫০ বছর!
কেবল ব্রিটেন নয়, এই ঘটনা নারী ফুটবলারদের সঙ্গে ঘটেছে পৃথিবীর সর্বত্র। জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন কোনো কারণ ছাড়াই ১৯৫৫ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মেয়েদের ফুটবল খেলা ব্যান বা নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। ব্রাজিল হচ্ছে ফুটবলের সূতিকাগার, সেই ব্রাজিলেও মিলিটারি ও ভার্গাস এর শাসনামলে ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত মেয়েদের ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু কেনো? কী সেই ভয়? কাকে ভয় কর্তৃপক্ষের?
আমরা জানি, আজকের দিনেও খেলা মানে কেবল সামর্থ্য আর শক্তির প্রদর্শন নয়, এ এক বিপুল আয়ের উৎসও বটে। এক একটি টুর্নামেন্টকে ঘিরে যে প্রস্তুতি, স্পনসরশিপ, জার্সি জুতো বিক্রি, দর্শক উন্মাদনা, মিডিয়ার তোলপাড়, টেলিভিশন সম্প্রচার, বিজ্ঞাপন-সব মিলে এ কোটি কোটি টাকার যজ্ঞ। মেয়েরা এই বিপুল যজ্ঞে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হবে, খেলার মাঠের সাথে সাথে কেড়ে নেবে স্পনসরশিপ বা বিজ্ঞাপনের মাঠও, পা দুটোর পেশীশক্তি চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করার সাথে সাথে অর্থশক্তিও প্রদর্শন করবে। পুরুষ হয়ে ফেডারেশন আর অ্যাসোসিয়েশনগুলো তা কী করে মেনে নেয়? এ এক বিরাট অপমান, চপেটাঘাত পুরুষদের জন্য। পৃথিবীর সকল ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাস প্রমীলা ফুটবল বা প্রমীলা ক্রিকেট নারী দর্শকদের জন্য, মেয়েদের খেলা দেখতে দুনিয়ার সবাই হামলে পড়লে নিজেদের পাতে আর রইল কি? মেয়েরা রাজত্ব করতে পারে বড়োজার টেনিস বা ভলিবলে, ওতেই সুন্দর দেখায় তাদের, তাই তো ২০০৪ সালে ফিফা প্রেসিডেন্ট স্যাপ ব্লাটার প্রস্তাব করেছিলেন ফুটবল খেলার সময়ও যেন মেয়েরা শর্টস এর পরিবর্তে ছোট স্কার্ট পরে, তাতে খেলার সৌন্দর্য নাকি বৃদ্ধি পাবে! নারী ফুটবলারদের প্রবল আপত্তির মুখে সেই কথা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন তিনি পরে।
লেখক সুজান র্যাক ডিক ক্যার লেডিস এর সাফল্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তাঁর বইয়ে লিখেছেন-"১৯২০ সালে গুডিসন পার্কে ডিক ক্যার লেডিস দলের অভাবনীয় সাফল্যই নারীদের খেলার সর্বনাশ ডেকে এনেছিল, এই সাফল্য এই স্পর্ধা মেনে নিতে পারেনি পুরুষতান্ত্রিক ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, ৫০ বছরের জন্য তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল ফুটবলের নিয়ন্ত্রকরা!"
কিন্তু তাতে কী পেয়েছে? এই নিষেধাজ্ঞার কিছুদিন পরই, ১৯২১ সালে গঠিত হল ইংলিশ লেডিস ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, আর ৫৮টি ক্লাব নাম লেখালো ওতে। দেশজোড়া নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই একের পর এক ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট খেলে যেতে লাগলো ক্লাবগুলো, পাড়ার ছোট ছোট মাঠ এবং রাগবি খেলার মাঠ ব্যবহার করে। এর প্রেসিডেন্ট লেন ব্রিজেট সিলভার কাপ ঘোষণা করলেন চ্যাম্পিয়ন দলের জন্য। নিষেধাজ্ঞা জারির ঠিক দু'বছর পর ১৯২২ সালে প্রথম কমপিটিশনে সেই কাপ জিতে নিল স্টোক লেডিস টিম, মোট ২৩টি দল অংশ নিয়েছিল ওই টুর্নামেন্টে। আর আশ্চর্য ব্যাপার, দর্শক সমাগম, আগ্রহ আতিশয্য ক্রমে বেড়েই চলছিল নারীদের ফুটবলকে ঘিরে। ১৯৬৬ সালে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ড ফুটবল বিশ্বকাপ জেতার পর নারী দলের খেলার অধিকারের প্রতি অ্যাকটিভিস্টদের দাবী আরও জোরালো হল। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালে গঠিত হল ইংলিশ উইমেনস ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। ও হ্যাঁ, ১৯২০ সালের সেই ঈর্ষান্বিত, ক্রুদ্ধ, অমানবিক পুরুষতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের জন্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন শেষ অবধি দুঃখ প্রকাশ করেছে বটে, কবে জানেন? ২০০৮ সালে, মানে ৮৭ বছর পর!
যতই প্রতিবন্ধকতা থাকুক, নারীদের পেশাদার ফুটবল খেলা এখন বিশ্বজুড়ে দর্শকদের আগ্রহ ও ভালোবাসার বিষয়। এ বছর মানে ২০২২ সালে বার্সিলোনার অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে মেক্সিকো বনাম ডেনমার্ক নারী ফুটবল দলের খেলা দেখতে দর্শক সমাগম হয়েছে ১১ লক্ষের বেশি, যা হতবাক করে দিয়েছে ফুটবল ফেডারেশনগুলোকে। ফিফা বিশ্বকাপ বা অলিম্পিক ছাড়াও নিয়মিত চালু আছে ওয়েফা নারী চ্যাম্পিয়নশিপ, কোপা লিবার্টাডোরিস ফেমিনিনা, দক্ষিণ এশিয়ায় সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের মত আর্ন্তজাতিক টুর্নামেন্টগুলো।
নারীদের খেলায় বরাবরের মতই এগিয়ে ব্রাজিল বা মেক্সিকোর মত দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো। ব্রাজিলের ফরওয়ার্ড প্লেয়ার মার্তা ভিয়েরা দ্য সিলভা তো সে দেশে কিংবদন্তীসম জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, দেশের লোক তাকে ভালবেসে ডাকে "পেলে ইন স্কার্ট"!
যুক্তরাষ্ট্রের মিয়া হাম ১৫৮টি আন্তর্জাতিক গোল করে রেকর্ড গড়েছেন, জার্মান গোলকিপার নাদিন এনজেরার দু দুবার বিশ্বকাপ উইনার মেডেলে ভূষিত হয়েছেন, কারণ তিনি জার্মান দলকে কখনোই কোনো গোল খেতে দেন নি! নারীদের ফুটবলে সংগ্রামী ও অগ্রগামী ভুমিকা রাখার জন্য ডিক ক্যার লেডিস দলের লিলি পার এর ভাস্কর্য আজ শোভা পাচ্ছে ইংল্যন্ডের ন্যাশনাল ফুটবল মিউজিয়ামের হল অফ ফেমে।
নারী ফুটবলে আজ পিছিয়ে নেই মুসলিম দেশগুলোও। তুরস্ক, প্যালেস্টাইন, মরক্কো, তিউনিসিয়া, জর্ডান, সিরিয়া, মিশর, আরব আমিরাতের রয়েছে নারী ফুটবল দল, আজারবাইজান ২০১২ সালে এবং জর্ডান ২০১৬ সালে নিজ দেশে আয়োজন করেছে ফিফা নারী বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট। ২০০৬ সালে সৌদি আরবে প্রথম নারী ফুটবল টিম গঠিত হয়, প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল এর উৎসাহে। কিন্তু মেয়েদের প্রকাশ্যে লিগ বা টুর্নামেন্ট খেলার অনুমতি মিলতে লেগেছে অনেক সময়। অবশেষে এ বছরই (২০২২) মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত একটি আর্ন্তজাতিক ম্যাচে সিশেলসকে ২-০ গোলে হারিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে সৌদি জাতীয় নারী ফুটবল টিম। জার্মান কোচ মনিকা স্টুব দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই তুখোড় দলটিকে। মুসলিম দেশগুলোকে উৎসাহ দিতে ফিফা সম্প্রতি নারী খেলোয়াড়দের হিজাব পরে খেলায় অংশ নিতে অনুমতি দিয়েছে। তবে আগেও বলেছি, নারীদের খেলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে কেবল রক্ষণশীল সমাজ বা ধর্মীয় নেতারাই সোচ্চার তা নয়, বরং সমাজের ভেতর গভীর ভাবে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিকতা ফুটবলের মত পৌরুষদীপ্ত খেলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারে না এই বিপুল জনপ্রিয় খেলার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়ও। ২০২০ এ চেলসি দল নারী ফুটবলার হার্ডারকে আড়াই লক্ষ পাউন্ডে চুক্তি করার পর নড়েচড়ে বসেছিল পুরুষ ক্লাবগুলো। আর এ মাসেই ব্রিটিশ নারী ফুটবলার কেইরা ওয়ালস বার্সিলোনা ক্লাবে যোগদান করেছেন চার লক্ষ পাউন্ডের বিনিময়ে, যে খবর স্পোর্টস দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
সাফ গেমসে আমাদের সোনার মেয়েদের সাফল্যে আজ আনন্দে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাবার সময় তাই মনে রাখতে হবে, কেবল রক্ষণশীল সমাজ নয়, খোদ খেলার জগতের ভেতরের অনেক মানুষ নিশ্চয় ভ্রু কুঁচকাচ্ছে মেয়েদের এই প্রাপ্তিতে, নিশ্চয় মুখ কালো হয়ে যাচ্ছে অনেকের এই ভেবে যে, হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে জনপ্রিয়তা, অর্থ, বিজ্ঞাপন; খেলার মাঠ আর টুর্নামেন্ট, মিডিয়ার মনোযোগ আর সম্প্রচার স্বত্ত বেদখল হয়ে যাচ্ছে- এই প্রাপ্তি সাবিনা-কৃষ্ণাদের পথ ভবিষ্যতে আরও বন্ধুর করে তুলতে পারে। আজ থেকে ১০০ বছর আগে ডিক ক্যার নারী দলের সাফল্য যেমন কাঁটা হয়ে ফুটেছিল পুরুষশাসিত এই স্পোর্টস দুনিয়ায়। কিন্তু ১০০ বছর আগেও পারেনি, এখনও আমাদের দামাল মেয়েদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না!
- লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসক